সাখাওয়াত টিপু
ছোট প্রাণ বড় কথা, বড় দুঃখ ছোট কথা বলিয়া যে সংজ্ঞা আমি পাড়িয়াছি তাহাতে সাখাওয়াত টিপুর গল্পকে কি গল্প বলা যাইবে?
– রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর/ ঠাকুরবাড়ি/কলিকাতা/ বসন্ত ১৪১৭
‘এই সমাজ খুব নিষ্ঠুর। একেক মানুষ একেক নিষ্ঠুরতার প্রতীক। কারণ নিষ্ঠুরতা সমাজের প্রথা। কেহ যদি নিষ্ঠুরতার বাইরে বাঁচে, সমাজে কোথাও তাহার জায়গা নাই। প্রথার বাইরের মানুষগুলা বাঁচিবে কি করিয়া’- তানিয়াকে আজ সকালে টিপু এমন কথা বলিয়াছে।
উত্তরে তানি, আমি আসলে…
টিপু বলিল, কি জানেন না?
লা জবাব হইয়া তানিয়া চোখের পানি ছাড়িয়া দিল। রোদের আলোকরশ্মি তাহার মুখে পড়িয়াছে। ঘামে মুখ চিকচিক করিতেছে। তানিয়ার মুখে টিপু অকাল সূর্যের অস্ত দেখিতে পাইল। এত আলো তথাপিও কায় অন্ধকার নামিল। তাহাতেও সে সুন্দর খুঁজিতেছিল। দেখিল, চোখের নিচ হইতে আলোকচ্ছটার মতো অমিয় সূর্যের গড়িয়ে নামার দৃশ্য। ভিনসেন্ট ভ্যান গগের লুনাটিক ঘোরের চিত্রকল্পের তদরূপ। সূর্য পশ্চিম পাঠে নামিবার কালে আকাশ আপনা হইতে লাল ঝক মারিয়া থাকে। লাল কালাতে পরিণত রঙের যে বদল হইয়া থাকে সেইরূপ হইয়া উঠিল সে। কিয়তপর কান্না থামিল তানিয়ার। টিপু চোখের পানির ভিতরও সুন্দরের কারণ খুঁজিতে লাগিল। ভাবিল, ঠিক কণ্ঠে আসিয়া সূর্য আসিয়া মিলাইয়া গেল। হয়ত সুন্দরের প্রার্থনা করিতে করিতে মানুষ সহজ হয়। সহজ সরল হইতেও সরল। সরলের দিকে তাকাইয়া সুন্দরকে হৃদয়বৎ করিবার আমলনামাই তো শিল্প।
টিপুকে একবার তানিয়া জিজ্ঞাসিল, আচ্ছা, আপনার চোখে সুন্দর কি?
– দেখিবার চোখ আর বিচার করিবার শক্তি।
তাহা হইলে তো সবার ভিতরে সুন্দর থাকিতে পারে, না?
– না! দেখিবার চোখ না জন্মাইলে বিচার করিবার পথ মিলিবে না।
কিন্তু কোনো কোনো চোখ খালি বস্তুই দেখিতে পায় না, তাহার অন্তরও পরখ করিতে পারে।
– তবে কি হৃদয় পরখ করিবার নামই সুন্দর? হৃদয় পড়িতে পারার মাঝে এতই আনন্দ, এতই অর্থ, এতই সংশয় জাগে তাহাই হয়ত বাঁচিয়া থাকিবার পথ।
তবে কি হৃদয়ের সহাত্মাই সুন্দর?
– প্রভু ছাড়া কাহার সহিত সহাত্মা হওয়া অসম্ভব। সহাত্মা ভক্তিরই সর্বনাম।
আপনার যুক্তিবোধ কেমন জানি লোপ পাইতেছে!
– দেখেন সামাজিক বন্ধনমাত্রই শর্তযুক্ত, আর হৃদয়ের বন্ধন নিঃশর্ত।
বন্ধন নিঃশর্ত হইলে তাহা আর বন্ধন থাকিল না। কি হইল বলেন তো?
– একদম খাঁটি। যে শেকল অদৃশ্য তাহাকে খোলাও সম্ভব নহে। যেহ শিকল পরিতে জানে না তেহ শিকল খুলিতেও পারে না।
শিকল পরিবার নিয়মের নামই অদৃশ্য বন্ধন। আমরা বুঝিতে পারি বন্ধনে অদৃশ্য শিকল আছে, তবে বলিতে পারি না অদৃশ্য শিকলটা কি? যদি পারিতাম তাহা হইলে হৃদয় লইয়া বড় টানাটানি করা লাগিত না।
বুঝিলাম, বন্ধন তো দেখিও নাই। কিন্তু টেরও পান নাই?
– টের পাই, কেহ একজন লেপ্টে গেছে কোষে-কোষে, জিনে-জিনে, হাওয়ায়-হাওয়ায়। তাহার হাত স্পর্শ করিবার পরও মনে হয় না অপর হাতে হাত দিয়াছি। তাহার মুখের দিকে তাকাইলে মনে হয় নিজের কষ্ট হইতে বাহির হইবার পর ভিন্ন কোন মুখের দিকে তাকাইতেছি না। তাহার কণ্ঠ শুনিলে মনে হয় আপন কণ্ঠই শুনিতেছি। তাহার দেহকে অর্ধাংশ বলিয়া গণ্য করা যাইবে না। তাহার সব মুর্চ্ছনাই আমার মুর্চ্ছনা। দুই দেহ মিলিয়া এক হওয়াই তো টের পাওয়া। ইহাই লীলা। না কি?
যদি তাই হয় আমাদের সুন্দরের লাগিয়া প্রার্থনা করা দরকার।
– আমাদের কোনো প্রার্থনা নাই। আমরা প্রার্থনার ভেতরই তো বাস করিতেছি। কারণ ইহার ভিতরে বাস না করিলে আমাদের জীবনের কোনো অর্থ হয় না। আমরা বাক্যে বাক্যে অর্থ খুঁজি। কথার ভিতরে অর্থ না রাখিলে প্রার্থনা হয় না। দেখেন আমাদের বাসনা শব্দের ফাঁকে ফাঁকে ঘুমাইয়া আছে। ফাঁক আছে বলিয়াই মনে মনে নানা প্রশ্নের উদয়। সংশয় আছে বলিয়াই উত্তরে তাহার অস্ত। আজ আমি যে আপনার মুখের উপর সূর্যের অস্ত যাইতে দেখিলাম, তাহার চাইতে সুন্দর কি আছে?
আপনি এতই স্থূল আমার ভেতরের আগুন দেখিতে পান নাই। একদা আপনি বামপন্থি ছিলেন তো, তাই। আপনি আস্ত একটা কানা! আচ্ছা আমার কথা কি নিষ্ঠুর শোনাইল?
– আপনি কি দেখিতে পাইতেছেন আমার বাম চোখে রক্তক্ষরণ হইতেছে?
না।
– অন্তর একেবার খুলিয়া দেন, দেখিবেন।
কি?
– রক্তের তরে তরে হৃদয় কিভাবে কাতরাইতেছে।
খুব অদ্ভুত। সুন্দর খুব রহস্যময়, না?
– রহস্য আসলে নামে। অন্তর্যামে আমরা সবাই যে যাহার মতো নামপন্থি। যেমন ধরেন, আপনার নামের নি আর আকার (া) বাদ দিলে কি থাকে জানেন তো?
জানি, তয়। মানে তারপর…
– আমি আপনার মত বুঝিতে পারিয়াছি। আপনার শ্বাসের আগুন যেদিন আমার বুকে লাগিয়াছে সেইদিনই টের পাইয়াছি গুণ কি পদার্থ। আপনার আগুন আর আমার আগুনের দূরত্ব ঠিক খোদার দূরত্বের সমান। খোদ আগুন হইয়া আসার পর বুঝিলাম আগুনমাত্রই চরিত্রবান। যেখানে যায় সেখানে পোড়ায়।
আমি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মত বাড়াবাড়ি করিতে চাই না। ঠাকুর তো লাবণ্য নামকে পহেলা বন্য, পরে বন্যা বানাইয়া নিজেই ভাসিয়া গেলেন! জগতের করুণাসিন্ধু আর কাহাকে বলে?
– আসলেই না আপনার হৃদয়ের কোপানলে পড়িয়াছি আমি।
আমি আপনাকে হৃদয়ের দোষে দোষারোপ করিতে পারিতাম। করিব না। কারণ দোষারোপ করিলে হৃদয় চুরির কাহিনী জানাজানি হইবে। লোকে নানা সওয়াল করিবে। ইতোমধ্যে গুজব রটিয়াছে ‘টিপুর হৃদয় চুরি হইয়াছে’। কে চুরি করিয়াছে তাহা কেউ জানে না। কাহারো কাছে তাহার হৃদয় খুঁজিয়া পাওয়া যাইতেছে না। হৃদয় এত এত ছিন্ন হইয়া আছে কোন হৃদয়ে তাহার কোন অধিকার আছে বা নাই কেহই সন্ধান দিতে পারিবে না। তাহার পরও হৃদয়ের এত বদনাম।
– খারাপ আছে বলিয়াই ভালোকে তাহার শ্রেণী লইতে হয়।
নাকি ভালো আছে বলিয়া খারাপ তার বদনাম লয়।
– বলিতে হইবে আপনি চমৎকার ভাবেন। জানি আপনার কথায় খরপোষ আছে। আপনি খারাপের ত্রুটি ধরাইয়া খরপোষ দিতেছেন না, এও এক বড্ড ত্রুটি। খারাপকে খারাপ বলিয়া ভালোয় ভালোয় তালি দিতেছেন। এই তালির তাল সুন্দরকে অনেকদিন ভোগাইবে।
আপনি বড্ড হাওয়ার উপর চলিতেছেন। এই হাওয়া কোনদিকের বোঝা দরকার, তা নয় কি?
– জানেন, যুক্তির টান ঠিক হাওয়ার মতো নয়। হাওয়া সবসময় সামনের দিকটাই টানে। তবে যুক্তি হাওয়াতেও ঘূর্ণি ছোটায়। হাওয়ায় হালকা বস্তু যেই ভাবে ছোটাছুটি করে ঠিক একইভাবে যুক্তি চলিতে পারে না।
আপনার কথার পাক আছে বলিয়াই বুঝিবার শক্তি হারাইয়াছেন। হাওয়া সামনে যায় ঠিক কিন্তু পিছনে কি ঘটে তাহার খবরও রটায়, তাই না?
– যাহা রটে তাহা বাস্তব বটে!
সত্যি কি তাহাই ঘটে? ঘটিবে কোথা হইতে। আপনি যাহা জানিয়া বাস্তব বলিয়া আগলাইতেছেন তাহা বাস্তবের ন্যায় ঘটে। সত্যের আসল চেহারা হইতে তাহা পগার পার। হাওয়ার ভিতরে উত্তাপ কত হিত কত বিরাজিছে তাহা কি কহিতে পারিবেন?
– যদি বলিতে পারিতাম তবে দেখাইতাম আপনার মনের কয়খানা দরোজা বন্ধ রহিয়াছে।
আমি আপনার কথা আমার আমিকে খুলিতেছি। নগ্ন করিয়া কবির কপালের নয়ন তুলিয়া ধরিতেছি।
আহা হাওয়া যদি বুঝিতে পারিত!
– বন্ধ দরোজার ভিতরে যে একখানা মন আছে আপনি টের পাইতেছেন না। আপনি হাওয়ার বহিরাবরণ দেখিতে পারগ। আর অপারগ দরোজার কথা কহিয়া আপনি আপনার কুঠুরিতে ঢু মারিতে পারিলেন কই? আমি বলিতেছি আপনার মন আর আমার মন এক। লোক সমাজে তাহা দুই। দুই চোখ থাকিতে মানুষ কেন একই জিনিস দেখে? তাহা ভাবিলে মন্দ হইত না।
আপনি আমার হৃদয় ধরিয়া টান মারিয়াছেন। আমি আমার হৃদয় দিয়া হৃদয়ের বদনাম করিতে চাহি না। চাহি না বলিয়া আজিকার মতো বিদায় লইতে চাই।
– আসিবেন যখন ফের আসিবেন। বিদায় শব্দের অর্থ ভালো দায় নাকি অন্য কিছুর রাস্তা হইতে দায় মুক্ত হওয়া? আজ বসন্ত মাসে বৈশাখ ডাকিলে গাছের কচি পাতার পরে বড়ই অবিচার হইবে। তবুও বসন্তে মাঝে মাঝে বৈশাখ বহিয়া যায়। পাতাকে তখন খুব করুণ মনে হয়। এমনি সন্ধ্যায় করুণা ডুবিয়া গেলে মন্দ হয় না।
পুনশ্চ: পাঠক-পাঠিকাগণ সামনে খেয়াল রাখিবেন। কোন একদিন দেখিবেন। তারপর কি?