মেহরাব
পঁচিশে ডিসেম্বর বড়দিন। এদিনের ‘হিরো’ সান্তাক্লজ। বিশেষ করে শিশুদের কাছে। সান্তাক্লজের ‘ম্যাজিক্যাল’ অস্তিত্ব প্রমাণ করতে ঘরের কর্তা-কর্ত্রীর ট্যাঁক হাল্কা হয় ঠিকই, কিন্তু শিশুদের এ-কান-ও-কান হাসির ঝলক মনকেও হাল্কা করে। তেমনই এক মন-হাল্কা-করা বড়দিন পালন করা গেল এবারে। সান্তাক্লজ এসেছিলেন – সফেদ শ্মশ্রুমান লাল-সাদা পোশাকের ভুঁড়িওয়ালা সান্তা নয়, ময়ুরকন্ঠী চাদর আর একই রঙের জ্বলজ্বলে টিপ পরা নারীসান্তা। এ সান্তা’র সাথে ছিল শান্তি, উপহার দেয়ার জন্য, ছেলে বুড়ো সকলকে, প্রত্যেককে। ম্যাজিক নয়, মাধুর্যই এ সান্তার শক্তি।
ইনি ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী। আধুনিক বাঙালি/ বাংলাদেশীর কাছে এঁকে নতুন করে পরিচয় করিয়ে দেয়ার কিছু নেই। ফেরদৌসী একজন অগ্রজ শিল্পী, কারো মা, কারো বোন, কারোবা গুরু, বাংলাদেশের বীরঙ্গনা, আমাদের বন্ধু। কাকতালীয় ভাবে বহুবছর পর হঠাৎ দেখা, এক বন্ধুর বাসায়। তারপর জমাটি আড্ডা – প্রসঙ্গ থেকে প্রসঙ্গান্তরে। শুরু হলো” ক্যামন আছিস রে? “দিয়ে, শেষ হলো জাতীয় সঙ্গীত দিয়ে, “জানিস আজকাল অনেক স্কুলেই জাতীয় সংগীত গাওয়া হয়না, আমাদের শিক্ষামন্ত্রীকে বিষয়টা জানাতে হবে” বলতে বলতে খুব কষ্ট করে রিকশায় উঠলেন অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী নাতির হাত ধরে।
যতক্ষণ আড্ডা চললো, নাতির হাত ধরেই বসেছিলেন। ও আবারও অস্ট্রেলিয়া ফিরে যাবে জানুয়ারির এক-এ, তাই যতটা পারা যায় সান্নিধ্য নেয়া-দেয়ার চেষ্টা। টেবিলে সার্ভ করা গাজরের হালুয়া নাতির পাতে তুলে দিতে দিতে এক চিমটি নিজের মুখেও দিলেন, “আজকাল দুপুর পর্যন্ত কিছুই খাই না”। কুটকুট করে চানাচুরের মশুর ভাজা চিবুতে চিবুতে, “তুই আর আমার ছবি তুলে দিলিনা, না?”। আমি বিব্রত, কোনো কথাই রাখতে পারিনা।
– আপনি কি আগের বাসাতেই আছেন?
– না, ঐ বাসা ছেড়ে দিয়েছি, এখন আছি ধানমন্ডির তিন নম্বর রোডে
– আগের বাসাটা অনেক খোলামেলা ছিল
– এটাও খোলামেলা; আমার কাজের জন্য তো খোলা জায়গা লাগবেই, একদিন আয়, দেখবি কত খোলামেলা
– যাব একদিন। শরবত খাওয়াবেন তো? আপনার হাতের শরবত খুব মজার
– আমারবড় মেয়েও খুব ভালো শরবত বানায়
– আমি আপনারটাই খেয়েছি
শরতের আলোচনা শীতে জমেনা; এ বছর শীতটাও জাঁকালো। টেবিলে ততক্ষণে ধোঁয়া-ওঠা চা। শুরু হলো চায়ের গল্প – ছেলেবেলায় শের-ই-বাংলার বাড়ির লাগোয়াই ছিল আমাদের বাড়ি, নানার বাড়ি। উনি বাচ্চাদের খুব পছন্দ করতেন – দু’বাড়ি মিলিয়ে একদঙ্গল,সারাক্ষণ কিচিরমিচির। একদিন শের-ই-বাংলা বললেন, “আজ তোমাদেরকে আমি খাওয়াবো, বলো কি খাবে? “আমাদের মধ্যে কেউ একজন বললো চা। ব্যাস সবাই মিলে বাড়ি মাথায় তুলে দিলাম চা চা বলে, সেই প্রথম চা খাওয়া। তবে জীবনের প্রথম কফি খাওয়ার অভিজ্ঞতাটা বড় অদ্ভুত। আমার ছোট খালার তখন সদ্য বিয়ে হয়েছে। খালু সাহেব আমাদের নিয়ে গেলেন সিনেমা দেখাতে। বেশ একটা অভিজাত সিনেমাহল। আমরা সবাই ‘বক্সে বসেছি। তখনকার সময় সিনেমা হলের বক্সে বসা চাট্টি খানি কথা না। ছবি তখনও শুরু হয়নি। উর্দি পরা বেয়ারা এসে সকলকে জিজ্ঞেস করছে, চা না কফি? আমি খুব স্মার্টলি বললাম কফি। জীবনের প্রথম কফির মগ মুখে তুলেই বিড়ির গন্ধ পেলাম, মনে হলো আমাকে দেয়ার আগে বিড়ি খাওয়া মুখে কফিটার স্বাদ নিয়েছিল কেউ।
– বিয়ারভাই কি এখনও স্মোক করে?
না নাহ্। বুকে পেসমেকার লাগানো। এখন ওসব বাদ। দু’একসলা মাঝে মধ্যে খেতে পারে, আগের মতো না। তবে তোদের বিয়ারভাইকে কিন্তু স্মোক করা অবস্থায় খুব স্মার্ট দেখাতো। ওর মতো স্মার্ট বাঙালিপুরুষ আমি খুব কমই দেখেছি। যখন দূর থেকে ওকে হেঁটে যেতে দেখতাম, মুগ্ধ হয়ে যেতাম। ওর হাঁটার ভঙ্গিও ছিল দারুণ। মানুষের হাঁটা-ও যে কত আকর্ষণীয় হতে পারে, তা তোদের বিয়ারভাইয়ের হাঁটা না দেখলে কেউ বুঝবে না।
এখন কি হাঁটেন?
হাঁটেন, তবে ভোর চারটা থেকে ঘরের মধ্যে, ঘুম ভেঙে যায় বলে। বল তো কি অবস্থা, ঘরের মধ্যে কেউ হাঁটাহাঁটি করলে অন্য কারো ঘুম হয়? আমি সব কাজকর্ম সেরে ঘুমাতে যাই রাত দুইটায়, আর উনি চারটায় উঠে বসে থাকেন? আমার হয়েছে জ্বালা।
বিয়ারভাই ফেরদৌসী প্রিভাষিণীর সোহাগীজ্বালা, আমরা জানি। তাই খানিকটা কৌতুক করতে কেউই ছাড় দেই না। “তোর শালের রঙ-টা তো খুব সুন্দর রে! কোথ্থেকে কিনেছিস? “আড্ডার আসরের কল্পনাকে উদ্দেশ্য করে।
– নেপাল থেকে
– নেপাল দেশটা ক্যামন রে?
– খুব সুন্দর
– আপনি যান নি কখনও
না রে। এই দেশটা ছেড়ে আমার কোথাও যেতে ইচ্ছা করে না। এমন কি বেড়াতে যেতেও না। একবার হলো কি, আমাদের এখন কার প্রধানমন্ত্রী তখন বিরোধী দলীয় নেতা, আমাকে লোক মারফত ডেকে পাঠিয়ে আমেরিকা বেড়িয়ে আসার প্রস্তাব দিলেন, নিখরচায়, এমনকি ওখানেও আমাকে কোনো খরচ করতে হবে না। এতো বড় একজন নেতা, আমি তো মুখের ওপর না বলতে পারিনা, তাই ক’দিন সময় চাইলাম ভেবে দেখবো বলে। নেত্রী আবার ডেকে পাঠালেন, আবারো দিলেন প্রস্তাব। এবারে আমাকে বিনয়ের সাথে নানা অজুহাত দিয়ে যেতে হলো – এ সমস্যা, ও সমস্যা ইত্যাদি। নেত্রী আমার মনের কথাটি বুঝলেন এবং হাসতে হাসতে বললেন, ঠিক আছে আপনাকে যেতে হবেনা।
ডিসেম্বর মাস ২০১১। আমরা নানারঙে মাসটা সাজিয়েছি। এবারের ডিসেম্বর অন্যান্য বারের চেয়ে আলাদা, স্বাধীনতার চল্লিশ বছর পালিত হচ্ছে। এই ডিসেম্বরের বড়দিনে ফেরদৌসী-ই আমার সান্তাক্লজ – উপহার দিলেন কত না জীবন সিঞ্চিত অভিজ্ঞতার সহজিয়া ফল্গুধারা। চল্লিশ বছর আগেও তিনি, তাঁরাই আমাদের পুরো জাতিকে উপহার দিয়েছিলেন এই দেশটি। যেই দেশ ছেড়ে প্রিয়ভাষিণী, এমন কি অন্য দেশে বেড়াতে যেতেও চান না, সেই দেশের একজন অতি নগন্য নাগরিক হিসেবে তাঁকে বলতে চাই, “আমার মাথা নত করে দাও হে তোমার চরণ ধুলার তলে”।