আনোয়ার শাহাদাত
প্রয়াত শেখ আব্দুর রহমান এখন ইতিহাস, অর্থাৎ ইতিহাসের অংশ বিশেষ, অবশ্য যদি তা কেহ স্বীকার করে। এবং এই ইতিহাস বর্ণনার শুরু হতে পারে শেখ আব্দুর রহমানের জীবনে ঘটে যাওয়া যে কোন অংশ দিয়ে। এর সবটাই ইতিহাস বর্ণনাকারীর নিজস্ব অনুভূতির কথা। বর্ণনাকারী বা গল্পকার শেখ আব্দুর রহমান বিষয়ক ঘটনাবলীর প্রতি আবেগপ্রবণ ও কাতর। অতএব প্রথমেই গল্পকার গোল হয়ে ঘিরে থাকা শ্রোতাদের বিমোহিত করতে চায় সনাতনী বয়াতির মতন। গল্প শুরুর আগে বিবিধ প্রশ্ন আসে অনেকটা ভূমিকার আদলে। যেমন-আম পাবলিক তা মন্ত্রী-মিনিস্টার, কি উকিল-ডাক্তার, কি চাষা-মজুর, প্যাডে ভাতের বাঙালির কথা বাদ থাউক, এই জাতের কাণ্ডজ্ঞান, হৃদয়, অনুভূতি, প্রাতঃকালীন ত্যাগ পরিত্যাগ অনুরূপ মুখে ঢোকে মলদ্বারে বার হয়। গল্পের উপরোক্ত ভূমিকার কথা শুনে শ্রোতারা হাসে এলাকা ফাটিয়ে, নিয়মিত শ্রোতা এরফান চিল্লায়-ওস্তাদে আইজগো জোমাইবে, খবর আচে। ভূমিকা দীর্ঘায়ত হয় স্বভাবতই প্যাডে, ভাতের, আম-পাবলিকের রুচির মান নির্ণায়ক একটি উদাহরণ দিয়ে এই শহরের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ যথা এডভোকেট, কি ধনাঢ্য ঠিকাদার, ফার্মেসির মালিক কি ঔষধ কারখানার মালিক সরকারি আমলা, সাংবাদিকসহ সবাই সন্ধ্যার পর অফিসার্স ক্লাবে মিলিত হন। এবং মাতিয়ে গপ্প জুড়ে দেন এডভোকেট এক নম্বর, তার ভাগ্নির কথা উঠান, যে ভাগ্নিটির বিয়ে হয়েছে সদর গার্লস স্কুলে দশম শ্রেণীতে পড়বার সময়। অনিন্দ্য সুন্দরী ছিল কিনা ? ভাল সব প্রস্তাব আসে-গল্পকারের মুখ দিয়ে এখানে কেবল বেরিয়ে যাচ্ছিল ভাইসব মাছের বাজারের মতন দরকষা-কষি, প্রস্তাব আসে, চোরাকারবারী, বাটপার, লুইট্যার, এরা সব মিলে রুই কাতলের অনির্ধারিত ডাক যেমন উঠায়।
এডভোকেট এক নম্বর বলেন, তাই সুন্দরী ভাগ্নির আর পড়ালেখা হয় না, তাতে কি খানদানী ঘরে বিয়ে হয়েছে। ময়মনসিংহর খানদানী, জামাই মাস্টার টাস্টার কিছুনা, সাক্ষাৎ মিলিটারি, মিলিটারির ক্যাপ্টেন, পোস্টিং প্রায় আমেরিকায়, মানে পাশের দেশ হাইতিতে, আছে জাতিসংঘ বাহিনীতে। বেতন যা পায় তাতে টাকা পয়সাকে মাল বলাই ভাল। সেই ভাগ্নির মেয়ে ‘ফ্যাটি’। ফ্যাটি বুঝেছেন-তো ভাই সাহেবগণ, গল্পকার উপস্থিতদের ফ্যাটির নামের পেছনের সারমর্ম বলে পয়সা ওয়ালা মানুষের পোলাপান তো বৈডা মায়ের বুকের দুধ আর বিদেশী খাসির দুধ খাইয়া মোটা হইছে, এখন আহ্লাদ কইরা সবাই ডাকে ফ্যাটি, সেই ফ্যাটি স্বপ্ন দেখে আব্বু দেশে ফিরে এসেছে এবং সে বাপ-জানের কোলে বসে তার নতুন ইউনিফরম ডুবিয়ে ধুমসে পেশাব করছে। এডভোকেট এক নম্বরের গল্পের এ পর্যায়ে বরিশাল অফিসার্স ক্লাবের কাচ্চুর টেবিল হো-হো করে হাসে য্যান ওই মুহূর্তে পুরা জাতির হাসন ছাড়া আর কোন কাজ নাই। এডভোকেট টেবিলকে আরও জানান ভাগ্নির এই বিয়ের ঘটকালী করেছিলেন বরিশালের সাবেক ডিসি সাহেব যিনি এখন খুলনার কমিশনার শিগগিরই এডিশনাল সেক্রেটারি হবেন এস্টাবলিশমেন্টের, এ সময় কাচ্চু টেবিলের একজন সদস্য বরিশাল জেলার বর্তমান কমিশনার ‘তাই নাকি’ বলে বিগলিত হয়ে পড়েন যেন এন্টাবলিশমেন্টের হবু এডিশনাল সেক্রেটারি ‘প্রেতাত্মাটি’ কোনও না কোনও ভাবে এ টেবিলে বসে আছেন। এডভোকেট আরও জানান মিলিটারি এই জামাই কি না সাক্ষাৎ মোনেম খানের আত্মীয়, সেইম ফ্যামিলি, অভিন্ন রক্ত, ফর্সা টকটকে। কাচ্চু টেবিলের কেউ-ই জানে না ওই সব রক্ত টকটকে ফর্সা কিনা।
গল্পকার এ পর্যস্ত বর্ণনা করে থমকে দাঁড়িয়ে স্তব্ধ হন, ঘুরে নুয়ে আবার দাঁড়িয়ে ঘিরে থাকা শ্রোতাদের দিকে ঝামটা মারেন বুঝুন আমরার অবস্থা, মাইয়ার মুতনের গল্প ইতিহাস বানাই কিন্তু ভুলে যাই আমাদের শেখ আব্দুর রহমানের কথা যিনি এই বিবির পুকুরেরই ওই পারে একটি উল্লেখযোগ্য ইতিহাসের পত্তন করেছিলেন। শেখ আব্দুর রহমানের জীবনের গল্প শুরু হয়নি। কেননা কোথা হতে শুরু করা যায় সে সমস্যা থেকে গেছে। যদিও শুরুর একটি সূত্রপাত হয়েছে। তা হল এই বিবির পুকুরের পশ্চিম পারে খান বাহাদুর হাশেম আলী খাঁর দেড়শ বছরের পুরনো ভবনের সামনে, সদর রোডের পাশে পুকুরের কিনার ঘেঁষে হেরিং বোনের ফুটপাতের উপর লুঙ্গির বাঁধন খুলে দিয়ে নিজের লম্বা দাড়ি বাম হাতের মুঠে চেপে ধরে অস্বাভাবিক ভঙ্গিতে লাফিয়ে বাংলা ও উর্দুর মিশ্রণ বাংলার্দুতে এমন একটা কথা বলেন যার ফলে তার উপর আরোপিত যে বিচারের রায় হয় তা কার্যকর হওয়া স্থগিত হয়। অর্থাৎ শেখ আব্দুর রহমানের মৃত্যুদণ্ড মওকুফ হয়ে যায়। শেখ আব্দুর রহমানের ঘটনা শুরু করার মত আরও কয়েকটি জায়গা আছে যখন কিনা একটি মাইক, দেড়শ গজ লম্বা মাইকের তার, আপত্তিকর বক্তব্য, রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ কিংবা আরও দশ বছর আগের আইয়ুব খাঁর নাম উচ্চারণ ও তার জীবনের পরিণতির নির্ণায়ক হয়ে ওঠে, অথবা মার্কিন থান কাপড়। গল্পকার শ্রোতাদের এ সব কথা বলেন, এভাবেই এবং আরও বলেন যে, শেখ আব্দুর রহমানের ঘটনা শুরু করার আরও অনেক জায়গাই রয়েছে কিন্তু কোথায় যে কার্যত বা মূলত শেষ তার হদিস গল্পকার খুঁজে পায়না উপস্থিত শ্রোতাদের জানা। তবে শ্রোতারা বুঝতে পারে শেখ আব্দুর রহমানের গল্প শুরু হয়ে গেছে, বিবির পুকুরের পারে লুঙ্গি খুলে বাংলার্দুতে এমন কিছু বলার মধ্য দিয়ে যাতে তার জীবন রক্ষা পায়।
গল্পকার আবার শুরু করেন শেখ আব্দুর রহমানের বিবির পুকুর পারের সেই সংলাপ থেকে তুমকো খানকা সেনা তুমকো বাপজি রহমান ক্যাভি নেহি ইয়ে রহমানছে ছাওয়াল হোক, তুমকো বাপ পিচ কমিটি রহমান আভি চৌধুরী আছে, খানতো দূরে রহে তুম সব হামাক ছাওয়ালও হইতে পারেনা, হাম শেখ আব্দুর রহমান নবীজীকা বংশ, তুম গুড়া পুটিকা বাচ্চা এই শেখকা ছামনে, চালাও গুলি মেরা বুকমে, দেখ গুলিভি পিছলা যাতাহে, নবীজীকা চুম্বিসে এ বুকমে, চালাও গুলি পুটিকা বাচ্চা, এই রকম উর্দু বানিয়ে সেদিন শেখ আব্দুর রহমান প্রথমে লুঙ্গির বাঁধন খুলে তারপর গায়ের আকাশী রঙ্গের সুতি কলকিদার পাঞ্জাবী খুলে ছুঁড়ে ফেলে লাফাতে থাকে তার পাক সিপাহীকে রাইফেল ফায়ার করার আহ্বান জানাতে থাকে। সেখানকার সর্বশক্তিমান কর্তা ক্যাপ্টেন হাত তুলে সিপাহীকে গুলি চালাতে নিষেধ করেন এবং সঙ্গে আনা দোভাষীকে জিজ্ঞেস করেন এই বদ বাইনচোৎ হারামিটা উর্দুর মত কি বলার চেষ্টা করছে? বিএ প্লাকড- এর পরীক্ষা দিতে আসা বিএম কলেজের ছাত্র সোহরাবকে তার ফার্স্ট লেনের জিপে তুলে নিয়েছেন ক্যাপ্টেন তার ওইদিনের বা সপ্তাহের দোভাষী হিসেবে। গল্পের বর্ণনাকারী এবার শেখ আব্দুর রহমানের বিষয় রেখে মোহাম্মদ সোহরাবের অংশটুকু ভাঙ্গিয়ে নেন।
যখন কাউনিয়া ফার্স্ট-লেনে আজিজ ডাক্তারের গ্রাজুয়েট মেসের সামনে জিপখানি থামে তখন সোহরাবের পানি-ডাল চুলায়। স্টোভের পাম্প শেষ হয়ে গেলে মেসের মধ্যে সোহরাব লুঙ্গি কাছা দিয়ে ডান হাঁটু মাটিতে ঠোস দিয়ে নুয়ে পাম্পে করতে থাকে।
ভাই সাহেবগণ, সোহরাব বিএ’র এই অবস্থা দেখেন ক্যাপ্টেন জিপের জানালা থেকে এবং তার বুক ছ্যাঁত করে ওঠে কারণ ইতিমধ্যে ওই রকম এমবুশ পজিশনের ট্রেনিং- এর খবর তিনি জানতেন। যদিও পরক্ষণেই তার ভুল ভাঙে ওই রকম গোবেচারা ধরনের সোহরাবকে দেখে। ক্যাপ্টেন হাতের ইশারায় সোহরাবকে জিপের কাছে ডাকেন। সোহরাব জোরে দোয়া ইউনুস পড়তে পড়তে হাত দুটো উপরে তুলে জিপের কাছে আসে। ক্যাপ্টেন জিজ্ঞেস করেন আর ইউ মুক্তি, ডুই হ্যাভ আর্মস?
-নো স্যার।
দেন ইউ পুট ডাউন ইউর হ্যান্ডস, মোহাম্মদ সোহরাব ইউনো দোভাষ, ইয়েস বলে সোহরাব ডান পা আস্তে উঠিয়ে আবার মাটিতে নামায়; সামরিক স্যালুট যেভাবে দেয়। কিন্তু হাত উঠিয়ে স্যালুট দিতে আবার তার সাহস হয় না, ক্যাপ্টেনের মুখের সামনে হাত উঠা-নামায় আবার অভদ্রতা হয়ে যেতে পারে ভয়ে। অথচ সোহরাবের ইচ্ছে করে আগাগোড়া এই মিলিটারিকে সন্তুষ্ট রাখতে। কিন্তু তার তেমন আর কিছু জানা নেই।
এটুকুও দেখেছে স্কাউটদের ঠাস করে স্যালুট দিতে পা পিটিয়ে। তার ধারণা এতে তোষণ-কারীরা সন্তুষ্ট থাকে। সোহরাব দোভাষী হিসেবে ওইদিনের জন্য নিযুক্ত হয়। বিনিময়ে জেলার পিস কমিটির প্রধানের বাসায় একসঙ্গে খাওয়া হবে এই প্রতিশ্রুতি মেলে। ক্যাপ্টেন সোহরাবকে প্যান্ট-শার্ট পরে আসতে বললে তার পোটলা থেকে বিয়ের উপযুক্ত পাজামা পরে এবং জীবনে প্রথম কোন গাড়িতে ওঠার অভিজ্ঞতা। সোহরাবের লেখাপড়া করারই যে স্বীকৃতি এই গাড়ীতে ওঠা সে বিশ্বাস তার দৃঢ় হতে থাকে। তবে বিএ কম্পার্টমেন্ট, জিপ গাড়ি, মিলিটারি, কোঁচকানো পাজামা, নাকি পটাস করে বুকের উপর একটি গুলিই নির্ধারিত সে সংশয় থেকে সোহরাব মুক্ত হতে পারে না। সোহরাবকে নেয়ার সময় আরও দু’চারটে ঘটনা ঘটে গল্পকারের মুখে শ্রোতাদের জন্য সে ঘটনাও বর্ণিত হয়। ক্যাপ্টেন জিজ্ঞেস করেন প্লাকড ফ্রম বিএম কলেজ এবং বিএম মানে কি? সোহরাব বিপদে পড়ে যায় কারণ এ অবস্থায় পাক মিলিটারির ক্যাপ্টেনের সামনে বিএম- এর প্রকৃত এ্যাব্রিভিয়েশন ব্রজমোহন উচ্চারণ করা প্রাণে বেঁচে থাকতে চায় এমন কারো পক্ষেই সম্ভব নয়। অতএব, সোহরাব তার মত করে বিএম- এর এ্যাব্রিভিয়েশন খুঁজতে থাকে কিন্তু মাথায় কিছুই আসে না বিপদে মানুষ যেমন হতবুদ্ধি হয়। তারপর সে ক্যাপ্টেনকে জানায় বিএম মানে বিরিয়ানি মোহাম্মদ, হি ওয়াজ এ গ্রেট ডেডিকেটেড মোহামেডান। সে খুব খানে-ওয়ালা ছিল, বিশেষ করে বিরিয়ানি ছিল তার অতি প্রিয় তাই তার নাম হয় বিরিয়ানি মোহাম্মদ, তার আর একটি আসল নাম আছে যা আড়াল হয়ে গেছে।
গল্পকার ক্যাপ্টেন ও সোহরাবের সাক্ষাতের সময় আরও একটি ঘটনার উল্লেখ না করে পারে না, সেটি হলও সোহরাবকে যখন প্যান্ট-শার্ট পরে প্রস্তুত হয়ে আসতে বলেন ক্যাপ্টেন তখন সোহরাব একটু টাটটি ঘরে যাওয়ার কথা বলে পেশাব ও টাটটির ডাক পরেছে এই মর্মে, তখন ক্যাপ্টেন খুব আন্তরিক অনুমতি দেন এ কারণে যে, তিনি ইতোমধ্যে জানেন যখনই কোন বাঙ্গাল শিকার করেছেন তখনই তারা বাথরুমে যেতে চেয়েছে এমনকি কোন কোন ক্ষেত্রে রাজাকারও ভীত হয়ে ওই কাজ করতে চেয়েছে। কখনো কেউ কেউ ছড়-ছড় করে ভিজিয়ে ফেলেছে পরনের কাপড়। দ’একটি শিকার পায়খানা থেকে পালিয়েও গেছে। ক্যাপ্টেন সোহরাবকে বাথরুমে যাওয়ার অনুমতি দেন এবং সিপাহিদের আদেশ করেন চার খুঁটির উপর দাঁড়িয়ে থাকা চাড়ি পাতা পায়খানার দিকে রাইফেল তাক করে পজিশন নিয়ে থাকতে। এরপর গল্পকার আরও রসিয়ে বর্ণনা করেন, কিভাবে চাড়িতে ঝর-ঝর করে ভীত গু-মুতের পতন হচ্ছে এবং কিভাবে ক্যাপ্টেন ও সিপাহিরা পলকহীন সেদিকে তাকিয়ে থাকেন।
সোহরাবের পানি-ডালের স্টোভ জ্বলতে থাকে। যদি কেরোসিন সেদিন সাদা না হয়ে লাল হয় তাহলে আরও সময় জ্বলবার কথা। ডাল শুকায়, ভাজা হয়, তারপর পুড়ে যায়। ভাজা-পোড়ার কিছুটা গন্ধ ছড়ায়। অথবা যদি তেল শেষ না হয়, স্টোভ আরও জ্বলে, তাহলে হয়তো আগুন আরও একটু যায় ডাল ভাজা-পোড়া ছাপিয়ে গ্র্যাজুয়েট মেসের গোলপাতা পোড়া। তখন আগুন যত দাউ-দাউ হোক তেমন দোষের কি সেতো আর দশটির মত লাগানো নয়।
‘তাহাদের’ চোখে আব্দুর রহমানের অপরাধ ছিল অগণিত। দুপুরের আগ বেলায় সেদিন তার কাঠের দোকানে গেলে দেখা যায় সে দোকানের পেছনে আলোহীন চৌকিতে পাশ বালিশ কোলে চেপে ঘুমায়। এমনকি পাক মিলিটারিসহ ক’জন মানুষ তার ঘুমের ঘরে পৌঁছালেও সে ঘুমাতে থাকে। ‘তাহারা’ না হয়ে অন্য কেউ হলে প্রথমেই বলত বেটা মরে গেল কিনা। কিন্তু ‘তাহাদের’ ক্যাপ্টেন বলেন বালিশ তার ‘লারকি’ কিনা? তখন উপস্থিত রিকশাওয়ালা ক্যাপ্টেনকে তার মত করে বোঝাবার চেষ্টা করে না সাব এটা লারকি নয় কোল বালিশ। ওই রিকশাওয়ালা মূলত লাকরি জ্বালানী কাঠকেই বলতে চায়। এবং রিকশাওয়ালা মনে করে ক্যাপ্টেন ভুল করে হয়তো লাকরিকে লারকি বলে ফেলেছে। অতএব সে নৈতিক দায়িত্ব বোধ করে ক্যাপ্টেনের ভুল দেখা কোন বালিশকে লাকরি দেখা। সোহরাব এবারে রিকশাওয়ালা লারকার ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত হয় কেননা সে মহামানব ক্যাপ্টেনকে জ্ঞান দিতে গিয়েছে। ক্যাপ্টেনের হাতের ছড়ি স্বভাবসিদ্ধ একটি গুঁতা বসায় তখন ওই রিকশাওয়ালার পাঁজরের পাঁচ ও ছয় নম্বর হাড্ডির মাঝখানে। সোহরাব যখন লারকি-ক্যাপ্টেন-রিকশাওয়ালা ও লাকরি বিষয়ক জটিলতার তর্জমার উদ্যোগ নেয় তখন শেখ আব্দুর রহমান ঘুমের ঘোরেই পাশ ফিরে শোয় এবং মাথার বালিশের পাশে রাখা এক ব্যান্ডের ফিলিপস রেডিওতে হাত বুলায়। যে রেডিও থেকে একটি গুনার তার ঘরের বেড়া ভেদ করে বাইরের সম্ভবত কাপড় শুকানোর মোটা তারে জড়িয়ে বাঁধা। ক্যাপ্টেন ওই গুনার তারটি অনুসরণ করতে করতে তার উৎপত্তি বা পরিণতি সম্পর্কে অবহিত হয়ে ফিরে আসেন। এবং এমনভাবে মাথা নাড়েন যাতে মনে হয় ওই রেডিওটিই নিশ্চিত করে যে শেখ আব্দুর রহমান অপরাধীই।
অর্থাৎ পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হয়। সোহরাব এরপর শেখ আব্দুর রহমান সম্পর্কে যে সব অভিযোগগুলো রয়েছে সেগুলো জানতে পারে।
এক—
সাতই মার্চে বরিশাল কাউনিয়া থেকে যারা ঢাকা রেসকোর্স ময়দানের মহা-সমাবেশে গিয়েছে শেখ আব্দুর রহমান তাদের একজন।
দুই—
সে প্রায়শই নাজিরের পোলের উপর আকাশের দিকে মুখ করে বাতাসের মধ্যে কতগুলো কথা ছুঁড়ে দেয়। যেগুলো এ রকম এইভাবে দিন যাবে না।
তিন—
যে দু’একজনকে বলেছে মুই কিছুরে করি না, কেউরে করি না, উল্লেখ্য যা সে করে না বলে দাবি করে তা প্রাণী জীবনের অতীব প্রয়োজনীয় একটি জৈবিক ক্রিয়া অথচ যা ভাষায় উচ্চারিত হলে অশালীন আখ্যা পায়। এ প্রসঙ্গে একটি বিশ্লেষণ শেখ আব্দুর রহমানকে অপরাধী করে ফেলে। পাক প্রিয় উদারপন্থীদের মতে আধ পাগলের কথা, তাছাড়াও তো দু’দলের কাউকেই করে না বলে থাকে। কিন্তু কট্টর পাক-পন্থীদের ব্যাখ্যা ভিন্ন ও আসলে কথাটা বেরাদারেনদের সম্পর্কেই বলে থাকে, দুষ্কৃতকারীদের নাম নেয় দোষ কাটাবার জন্য।
চার—
অনুরূপ আরও একটি অপরাধ এরকম শেখ আব্দুর রহমান কোথাও কোথাও বলেছে সে খায় শেখের নামে এবং ত্যাগ কর্ম করে থাকে খানের নামে। পাক দোসর ভাইয়েদের কাছে এ তথ্য গেলে তাদের দু’একজন আব্দুর রহমানকে জিজ্ঞেস করেন আসলে ব্যাপারটা কি ? তাদের সে ব্যাখ্যা করে এভাবে যে সে নিজের নামেই খায় কারণ সে নিজেই শেখ এবং সে যে খানের নামে ত্যাগ কর্ম করে সে খান আর কেউ নয় তার পূর্ব পুরুষের বংশীয় শত্রু লিয়াকত আলী খাঁ।
শেখ আব্দুর রহমান তাদের জানায়, তার পূর্ব পুরুষরা যখন এ অঞ্চলে আসে তখন পশ্চিম ভারত থেকে তাদের পেছনে পেছনে একটি উদ্বাস্তু, পরিবার যোগ দেয় একই নাজিরপুরে বসবাস শুরু করে এবং তারা খান উপাধি নেয়। এক পুরুষ পরে নব্য খান পরিবারের পক্ষ থেকে, শেখ পরিবারের কন্যাকে বিয়ের প্রস্তাব দেয়া হয়। স্বভাবতই শেখ পরিবার তা প্রত্যাখ্যান করলে বিরোধ শুরু হয় যার পরিণতিতে খান পরিবারের নেতৃত্বে শেখ পরিবারের প্রতাপশালী শেখ খুন হয়। অতএব যে খানের নামে আজ শেখ আব্দুর রহমান ত্যাগ কর্ম করে সে তার বংশ পরম্পরা শত্রু খান। বরিশালের পাক দোসররা এই কথা বিশ্বাস করে না। তারা মিলিটারির ক্যাপ্টেনকে জানায়, আসলে যে শেখের নামে আব্দুর রহমান খায় সে ওই পাকিস্তানের গাদ্দার শেখ আর যে খানের নামে সে ত্যাগ করে সে হতে পারে আইয়ুব খান, ইয়াহিয়া খান, কি টিক্কা খান এমনকি খান সেনাদের নামে।
উপরোক্ত সুনির্দিষ্ট ও অনির্দিষ্ট বহুবিধ অভিযোগের ভিত্তিতে শেখ আব্দুর রহমান গ্রেপ্তার হয় বরিশাল শহরের কাউনিয়ার কাঠের পোলের নিকট তার নিজস্ব লাকরি বিক্রির দোকান হতে। জিপই আদালত হয়, বিচার কার্য শুরু হয় বায়েজীদ খানের এজলাসে। রায় হয় শেখ আব্দুর রহমানের মৃত্যুদণ্ড। অভিযোগ রাষ্ট্রদ্রোহিতা। এবং মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার জন্য স্থান নির্ধারিত হয়। এই বিবির পুকুরের পশ্চিম পাড় খান বাহাদুর হাশেম আলী খাঁর বাড়ির সামনে ঘাটলার পাশে।
গল্পকার পেছনে ফিরে ঘাটলার দিকে উপস্থিত শ্রোতাদের সেদিকে দৃষ্টিপাত করায়। ক্যাপ্টেন উৎফুল্ল হন, ভাই সাহেবগণ মিলিটারিদের ট্রেনিং ওই রকম পাবলিক মারনের সময় চিত্তে আনন্দ ধরিয়া রাখিতে হয়। ভাইসব পাক সেনাদের এই সব সময় আরও অনেক খেলার রেওয়াজ ছিল, যার মধ্যে প্রধান হচ্ছে বিলাই ইন্দুর খেইল।
ক্যাপ্টেন সোহরাবকে দিয়ে শেখ আব্দুর রহমানকে বলান যে সে যদি প্রাণে বাঁচতে চায় তাহলে যেন জোরে পাকিস্তান জিন্দাবাদ শ্লোগান দেয়। জিপের পেছনে রহমান পরিষ্কার সোহরাবকে বলে বাজান আমার যে পুত্র নাজিরের খালের ঘাটলায় ৫০ সালে পানিতে ডুবে মরেছে সে থাকলে এখন তোমার মত হইত, এই মুহূর্তে কেন জানিনা তোমারে মোর তার মত মনে হইল, তবে বাজান ওই শ্লোগান দেওয়া আমার পক্ষে সোম্ভব না। সোহরাব আবারও অনুরোধ করে বাজান আপনে আমার ধর্মের বাপ, আমারে পাপের ভাগী করবেননা শ্লোগানডা দেন। আব্দুর রহমান কঠোর আরও, সোহরাবের দিকে না তাকিয়ে বলে সোম্ভব না । ক্যাপ্টেন সিপাহীদের ইঙ্গিত করেন পুকুর পাড়ে দাঁড় করাতে । পুকুরের দিকে মুখ করে দাঁড় করাতে গেলে শেখ আব্দুর রহমান ফিরে যায় এবং বলে পিঠমে নেহি বুকমে গুলি চালাও এবং তারপর তার ওই উর্দু- বাংলা মিশ্রণে বলে সে নবীজীর বংশ তার বুকে নবীজীর চুম্বন রয়েছে, তোমাদের গুলি পিছলে যাবে । এই ঘটনা শ্রোতারা এমনভাবে শুনতে থাকে যেন তারা ’৭১ সালের আব্দুর রহমানের ওই ঘটনার ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। গল্পকারের সহকারী তার ওস্তাদকে ইশারা করতে থাকে ওস্তাদ যেন তার আসল কাজ শুরু করে। সহকারী গল্পের মাঝে আরও দু’একবার ইশারা করেছিল, ওস্তাদ থামেনি। এবারেও তার ওস্তাদ গল্পকার থামেনি, বরং সহকারীর উদ্দেশ্যে গল্পকার শ্রোতাদের বলে দেয় যে ছোড়াটা চির-কৃমির বড়ি বিক্রি শুরু করে দিতে বলে এবং বড়ি বিক্রির পরে নাকি লাগলে আবার শুরু করা যাবে। কোন গল্পের মাঝ পথে তা থামিয়ে ক্যানভেসারের বড়ি বিক্রির রীতি সম্পর্কে যাদের অভিজ্ঞতা রয়েছে তারা হতাশ হয় কেনোনা গল্পটি চির-কৃমির বড়ি বেচার মধ্যে হারিয়ে যাবে। কিন্তু ওস্তাদ তার সহকারী ও শ্রোতাদের সাফ কথা জানিয়ে দেয় সে কৃমির বড়ি আজ বিক্রি করবে না। শ্রোতারা ফিরে যেতে চায় তাদের গল্পে। গল্পকার চমক দেয় তার গল্প বলায় একথা বলে তাহলে বড়ি বিক্রি নাই যখন কিসসাটাও ক্ষান্ত দেই। শ্রোতারা এর প্রতিবাদে গরম মিছিল-শ্লোগানের মত প্রতিবাদ করেন। সত্য কিন্তু তাদের মুখ-ভঙ্গিতে হতাশার দৃশ্যটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। গল্পকার গোলাকৃতি সীমানাটুকুর মধ্যে তার চক্র হাঁটা অব্যাহত রাখে, যেন ভাবে একটু এই ফাঁকে। কিছুটা মায়া জাগে যেন এই চির-কৃমির বড়ি বিক্রির ক্যানভেসারের হৃদয়ে শ্রোতাদের জন্য। তাহলে শ্রোতারা এই ইতিহাস-ভিত্তিক গল্প শুনতে চায়। গল্পকার আবারো শুরু করে, তার আগে তার শ্রোতাদের স্মরণ করায় পকেট সাবধান।
যুদ্ধের কাল তখন। শেখ আব্দুর রহমানের প্রাণদণ্ড হবে এই বিবির পুকুরের পশ্চিম পাড়ে। পিঠ ফিরিয়ে দাড় করানো হয়েছিল রহমানকে। রহমান ঘুরে দাঁড়িয়েছে। বুকমে চালাও গুলি’ বলে। কোন পথিকও নেই সদর রোড রাজপথে, যদিবা থাকে কার দাঁড়াবার সাহস সেই যুগে। কোন এক রিকশাওয়ালার ঢিলা-ঢালা বেল বেচে যেতে থাকে অনিচ্ছায়। পুকুরের ঘন শ্যাওলা সংকুচিত হয় আরও একটি লাশের জায়গা করতে। সিপাহীদের রাইফেল তাক করা তক্ষণই গর্জাবে বলে, বধিবে শেখ আব্দুর রহমানের প্রাণ। খান বাহাদুরের নাতি কিশোর ভয়ে প্যান্ট ভিজিয়ে ফেলে, কাজের মেয়ে সুফিয়া নিজেই নিজের মুখে পুরে দেয় আঁচলের কাপড় যাতে কান্নার শব্দ পাক সেনাদের কানে না যায়। পিস কমিটির চেয়ারম্যানের হর্স মুন স্লেইভ রোডে পাক হচ্ছে কোর্মা পোলাও, রুটি ও পাঠার গোশ, ক্যাপ্টেন বায়েজীদ খাবেন দুপুরে সে বাসায় অন্তত একটি বাঙালি গাদ্দার খতম করে। বয়ান দীর্ঘ হতে থাকে, সোম্ভব পৌঁষের শ্যাষ কি মাঘের পোরতম তখন। চাষার শ্যাষ ধানের পাল্লায় মই ভেঙ্গেছে। উঠানের শেষ গোবর লেপার গন্ধ কমে গেছে। সময় এসেছে শীত শেষে দিন বড় হবার। নাড়ায় ঘর ছাওয়া জোরসে হরদম। তখন মেলবার কথা যাত্রা বেদের মেয়ে জোছনা কি এজিদ বদ জয়নাল উদ্ধার। কিন্তু কিসের কি, সবই তো স্থির। গাঙ্গের পানিতে মিশেছে রক্তের রং। মাছেরা এমন কি কচ্ছপ বুঝে গেছে মানুষের লাশ আর তাদের খাবার নয়। উপরের কথাগুলো বলবার সময় চির-কৃমি বড়ি বিক্রির ক্যানভেসার গল্পকার, হাঁটাহাঁটি করছিল। সেটাই ক্যানভেসারদের রীতি। চারদিকে ঘিরে থাকা শ্রোতাদের মধ্যের জায়গাটুকু তার কাছে ময়দানের মতন। ওইটুকু ময়দান তার স্টেজ। কথা বলবার সময় প্রান্তর-পর প্রদক্ষিণ করতে হয়। গল্প বলবার সেই অস্থির ভঙ্গী হাঁটাহাঁটি এপার ওপার চুলের ঝাঁকি, অঙ্গভঙ্গি, গলার স্বর ওঠানো নামানো সবই থামিয়ে দিয়েছে গল্পকার। এরপর দাঁড়িয়ে এমনভাবে তাকিয়ে শ্বাস নিতে থাকে যেন শ্বাস কাশের কষ্ট গল্পকারের। আব্দুর রহমানের জীবনের এ পর্যায়ে গল্পকার থাকলেন যেখানে শ্রোতাদের উত্তেজনা চূড়ান্তে। তারা প্রায় ফেটে পড়েন, ও ক্যানভেসার ছাব কুত্তার বাচ্চারা কি গুলিডা চালাইল? ক্যানভেসার যেন শ্বাস কষ্টে বসে পরে। শ্রোতাদের কোনও একজন পাশের শ্রোতাকে বলেন হের গপ্পতো আর বানাইন্না গপ্প না, সয়ত্য কাহিনী মোনে হয় কষ্ট পাইচে কইতে যাইয়া। বসা থেকে গল্পকার দাঁড়ায়, চারদিকে তাকিয়ে নেয়, শ্রোতারা আনন্দিত হয়, ভেতরে তারা এখুনি জেনে যাবে আব্দুর রহমানের পরিণতি। গল্পকার শুরু করেন- না, না, না, কহিব না সে কথা/ পাষণ্ডের হৃদয় বলে ছিল কিছু/ যদি তাতে পশুরও ছিল মন বোঝা যায়, হইলে হইতেও পারে আব্দুর রহমান।
ওই রাইফেল সর্দার ক্যাপ্টেনের পিতারও সমান আচোইককা ও পাকিস্তানি ক্যাপ্টেন তাক করা সিপাহীর দিকে গর্জেন রোক, রোক যা, সিপাহী চুম্বিছে গলা তার নবীজী। গল্পকার ওটুকু ছন্দ মিলিয়ে বলেন, শ্রোতারা স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়ে, উত্তেজনা ও অনিশ্চয়তায় এতক্ষণে যে হাত মুঠো ভরা ছিল তা ছেড়ে দেয়। যথারীতি ক্যানভেসার একটু থেমে আবার কাহিনীতে ফিরে যায়। ক্যাপ্টেন বায়েজীদ বরিশাল শহরের অনেক মুক্তিকে হত্যা করেছে। কেউই বলেনি আজতক চালাও গুলি, তাও পিঠে নয় বুকে। কেউ বুক খুলে দেয়নি তাড়াতাড়ি গুলি চালবার জন্যে। রহমানই প্রথম ক্যাপ্টেনের অভিজ্ঞতায়। তাছাড়া ওই কথা, তার বুকে চুম্বিছে নবীজী। হয়তো ক্যাপ্টেন ভয় পেয়ে গিয়েছিল। সিপাহী যখন আঙ্গুল টানবে ট্রিগারে তখনই তাকে ক্যাপ্টেন থামিয়ে দেন। গল্পের এ পর্যায়ে শ্রোতাদের একজন বলে ফেলে-আমাগো রহমানের বুকে গুললি মারে এই রকম জাউরা পয়দা হয় নাই এই দুইন্নায়। গল্পকার সরাসরি শ্রোতাদের কথার উত্তর দেয় না কখনো কিন্তু এবার দেয়— কথাখান ঠিক আবার ঠিকও নয়। শ্রোতার মনে প্রশ্ন জাগে তবে কি গুলি করেছিলেন। তো পরে কোন এক সময়। ক্যানভেসার ওই শ্রোতাকে উদ্দেশ্য করে বলে, এর জবাব পাইবেন সঠিক সময়।
ক্যাপ্টেন সিপাহীকে থামিয়ে জিপে ফিরে যেতে বলে, দোভাষীকে বলে রহমান যেন চোখ খুলে ফেলে। রহমান চোখ খুলে দেখে ক্যাপ্টেন আর দোভাষী সামনে দাঁড়িয়ে। তুম নবীজী-কা ছাওয়াল? ক্যাপ্টেন এ প্রশ্ন করে। রহমান কিছু বলে না, ভাবে কি হল। এরই মধ্যে ক্যাপ্টেন খালাস শব্দটি উচ্চারণ করে দোভাষী নিয়ে জিপে চড়ে দক্ষিণের দিকে চলে যায়। যারা দেখেছে এর আগে, পাক মিলিটারিদের নর হত্যা, যারা শুনেছে, তারা অবাক হয় একটি প্রাণ পাক মিলিটারির হাত থেকে বেঁচে যেতে দেখে। জিপটি চলে যাওয়ার সঙ্গে যেন পাখি ডেকে ওঠে চারদিকে, খান বাহাদুরের বাড়ীর কাজের মেয়ের চোখে জল নিয়েই হাসি ফোটে, ভীত মুখে পুড়ে দেয়া কাপড় যেন সুস্বাদু খাবার। বিবির পুকুরের ক’টি হাঁস প্যাক প্যাক ডেকে ওঠে। এই কৃষ্ণ চূড়ার ডালে একটি বাড়তি পাতার হয়তো ভ্রুন ƒণ হয়। শ্রোতাদের মধ্যে কূল-কুলানী পড়ে যায় স্বস্তির। তারা আলগা হয়ে ওঠে সবাই। বুঝতে কারোই বাকি থাকে না এ গল্পের পরিণতি। কিন্তু ক্যানভেসার গল্পকার আলগা হতে থাকা শ্রোতাদের থামিয়ে দেয়। ভাই সাহেবগণ আব্দুর রহমানকে নিয়া এই যদি শ্যাষ হইত তাহলে আর ইনাইয়া-বিনাইয়া এতদূর আপনাদের সময় লইলাম কেন। গল্পকার আবার তার বলার ভঙ্গী পরিবর্তন করে, শ্রোতারাও নতুন চমকের আশায় নড়ে-চড়ে বসে।
ভাই সাহেবগণ,
আব্দুর রহমানের সেই এক জীবন
দ্যাশই যার প্রাণ
বধের কারণ
পাগল মতন মানুষ, যে নিজেরই খায় ও পরে
স্বাধীনভাবে বাঁচিতে চায় আপনও ঘরে
যদিবা একবার
নবীজীর নামে জান
হয় নিস্তার।
জানি পাক জানোয়ারও নয় যেরম অহরহ
এই মাটিতে আছে, আছে জানোয়ার আরও ভয়াবহ
ভাইছাব, পরে কী মনে সেই নাম আইয়ুব খান
যে কিনা পারেনাই বধীতে রহমানের প্রাণ
বধিছে শ্যাষে য্যায়।
ভাইয়েরই পরিচয়, তার ভাইয়েরই পরিচয়।
সালটা বলবো না । মিলায়ে নেবেন। দ্যাশে শুরু হয় আর এক গোলমাল খুনোখুনি হয়ে যায় সব কিছু। তারও কিছু দিন পরের কথা। সময়টা আইয়ুব খানের মত। যুবকের বাবরী কাটা, চির-কৃমির বড়ি বিক্রি পর্যন্ত নিষিদ্ধ। বাইরে এক শান্ত জীবন মানুষের, ভেতরে দহন। রহমান নাতির খৎনার কথা বলে ভাড়া করে এক মাইক। রিকশায় মাইক কাউনিয়া না নিয়া, নিয়া যায় ওই কির্ত্তোন খোলার পাড়। হেমায়েত উদ্দিনের মাঠ। সেই রকম পাখিরাও ঠোটে তালা লাগানো দিনে, রহমান মাইক বসায় ওই মাঠে।
ভাই সাহেব গণ, কি কারণ জানি না, রাজনীতি ছিল নিষিদ্ধ। আব্দুর রহমান কি জানত? না জেনে সে কি কাজ করেছে তার জীবনে। ইয়াহিয়ার বিরুদ্ধে যেমন বলতেন শ্যাখ সাহেব তেমন বলেন, রহমান সাহেব। এটুকু মিলাইলাম ভাই শ্যাখ সাইবের লগে। সেতো মানুষই এরকম, কার নামে খায় কার নামে মোতে, করে না কাউরে কিছু। রহমান ওই লঞ্চঘাটের হেমায়েত উদ্দিন মাঠে মাইকে যা কিছু বলে তা আর কারো বিরুদ্ধে নয়, শুধু আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে, আইয়ুব খান বাংলার মানুষ দাবায়া রাখতে পারবা না আইয়ুব খান। এ যুগের রাজাকারদের কাছে এই খবর চলে যায়। খবর চলে যায় সার্কিট হাউসে, সার্কিট হাউস থেকে ঢাকায়। ঢাকা থেকে নির্দেশ আসে, আইয়ুব খান খারাপ আছিলো কিসে এমন, ধরো শালাকে ব্লাডি সিভিলিয়ান। জিপ আসে বরিশাল সার্কিট হাউস থেকে, হেমায়েত উদ্দিন মাঠের পাশে জিপ থেমে যায় সামরিক মহড়ার মত, সশস্ত্র সৈন্যরা লাফিয়ে লাফিয়ে নেমে পজিশন নেয়, করে এমবুশ, নিরস্ত্র রহমানের বিরুদ্ধে। আব্দুর রহমান দ্যাখে, দেখতে থাকে, পাক নয় দেশী মিলিটারি, ক্রসিং দিয়ে তার দিকে অর্থাৎ মাঠের মধ্যে আসতে থাকে। কি জানি অগোচরেই আব্দুর রহমানের হয়তো পাক মিলিটারিদের মত মনে হয় এবং তার ক্ষমতায় যা কুলোয় সে রকম উর্দুতে বলে ক্রসিং দরকার নেহি হাটসে আ যাতাহো, আইয়ুব খানের দল, ফিরে যাও ফিরে যাও আইয়ুব খান, আর নয় আইয়ুব খান। ক্যাপ্টেনের নেতৃত্বে ক্রসিং সৈন্য হেমায়েত উদ্দিন মাঠে ব্যায়নেট লাগানো রাইফেল ঠেকিয়ে রহমানকে গ্রেফতার করে, দুচারটে গুঁতাও তাকে দেয় সৈন্যরা।
গল্পকার শ্রোতাদের মনে করায় গল্পের আগ মাথা মনে আছেনী ভাই সাহেবগণ? শ্রোতারা মাথা নেড়ে জানায় তাদের মনে আছে। পাক জানোয়াররা কিন্তু রহমানকে ব্যায়নেট দিয়ে গুতায় নাই গ্রেফতারের সময়। থাক সেই সব কথা।
ঢাকা থেকে হেলিকপ্টার আসে। ভয়াবহ অপরাধী, রাষ্ট্রদ্রোহী হিসেবে, রহমানকে যশোর ক্যান্টনমেন্টে পাঠানো হয়। আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে গালাগাল দেয়ার অপরাধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে অভিযুক্ত হয়। মনে রাখুন সাল ১৯৭৬ সামরিক আদালতে তার বিচার হয়। বিচারে ফাঁসির রায় হয়। যশোর জেলা কারাগারে ১৯৭৭ ইংরেজি সালের শেষের দিকে আব্দুর রহমানের ফাঁসি কার্যকর হয়। শ্রোতারা মুষড়ে পড়ে। পাক জানোয়ারদের বিরুদ্ধে একটা ক্ষোভ সে সময় ছিলও, গল্পের প্রথম ভাগে, গল্পের দ্বিতীয় ভাগে শ্রোতাদের প্রতিক্রিয়ার দিকে আর গল্পকারের আগ্রহ নেই। শুধু নেই শ্রোতাকে খুঁজে বের করে যে কিনা বলেছিল, রহমানের বুকে গুললি মারে এমন জাউরা পয়দা অয়নায় দুইন্নায়, বলে, জবাব পাইছেন নী ভাইসাব। ভেঙ্গে পড়া শ্রোতাদের ওঠবার পালা, নিজেরাই এগিয়ে ক্যানভেসারকে বলে বড়ি লাগবে না তাও আইজ কিনমু। ক্যানভেসার বাইর করেন আপনার চির কৃমির বড়ি। ক্যানভেসার মিটি হেসে বলেন, আজ আর কোন বড়ি বেচবো না। তারপরও ক্যানভেসার শ্রোতাদের বলেন, আরও কয়েকটা কথা বলা দরকার। শ্রোতারা আবার শোনে যশোর কারাগারে আব্দুর রহমানের লাশ কে নেয় জানেন? তার লাশ দেয়া হয় সেই দোভাষীর কাছে, অর্থাৎ সোহরাব হোসেনের কাছে। আব্দুর রহমান নাকি নিজেই জেল কর্তৃপক্ষের কাছে সোহরাবের নাম বলেছে তার লাশ হস্তান্তরের জন্য। সোহরাব সেই লাশ কি করে প্যাটে ভাতের মানুষ, কেবল নতুন শুরু করেছে লঞ্চে চির কৃমির বড়ি বিক্রি।
শ্রোতারা আবিষ্কার করে সেই দোভাষী সোহরাব হোসেন আর কেউ নয় এ গল্পকার ক্যানভেসার চির কৃমির বড়ি বিক্রেতা। গল্পকার অনেকটা অনুনয়ের সুরে বলেন, দুটো কথা বাকি, এক, পাক মিলিটারিদের সঙ্গে সেই দিন হর্সমুন শ্লেইভ রোডের পিচ কমিটির চেয়ারম্যানের বাসায় আমি পোলাও কোর্মা ভয়ে খেয়েছি, কিন্তু ঘরে ফিরে গু খাওয়ার কথা মনে করে বমি করে ফেলে দিয়েছি। দুই, আব্দুর রহমানের কবর একদিন জাতীয় সৌধে পরিণত হবে এমন আশা সারা জীবন করে যাবে এই ক্যানভেসার, তাতে আপনাদের কোন আপত্তি আছে নাকি?
শ্রোতারা সবাই বলে ওঠে- না।
sundor , shokti shali ebong ektu jotil(amar jonne) lekha! ei lekhati abar porbo , tarpor abar ebong abar. apnar onno rochonoa gulo porbar agroho ter pacchi . ei agrohota amar jonno shulokkhon hishebe elo. ei agroho thekei hoyto amar moddhe pather ei sundor ovveshti fire pabo!
Pingback: সাহিত্যের দেয়াল-দেয়ালের সাহিত্য: ফ্রম হুমায়ূন আহমেদ টু আনোয়ার শাহাদাত « Kulada Roy