ইউ. জী. কৃষ্ণমূর্তির সাথে কথোপকথন: ১ ।। ইউ. জী. কৃষ্ণমূর্তির সাথে কথোপকথন: ২
মন যথা কাল্পনিক
বাংলা অনুবাদ: নান্নু মাহবুব
[হঠাৎ একটা জলাশয়ের ধারে দাঁড়িয়ে মনে হতে থাকে সেটা চিরকালের চেনা। তার ওপর দিয়ে উড়ে যাওয়া একটা শাদা বক, খসে-পড়া একটা শুকনো পাতা তারপর আপনার কাঁধ ছুঁয়ে ছুঁয়ে মাটিতে পড়ে। মুহূর্তেই বহুমাত্রিক স্মৃতির আনাগোনায় আপনি দেখতে পান সমস্তটাই যেন বহুপরিচিত, অবিকল পূর্বদৃষ্ট। অতঃপর দ্রুতই আবার এই অনুভূতিটা জলে-গোলা কালির মতো মিলিয়ে যায়। অথচ এই জলাশয়ের কোনো চিহ্ন আমার তথাকথিত পূর্বস্মৃতিতে থাকার কথা নয়।
জীবন এক অপরূপ রহস্য। বা হয়তো তা কোনো রহস্যই নয়, সেটা এরকমই।
কিছুই আমরা জানি না। কার্যকারণ সম্পর্কের একটা যৌক্তিক পদ্ধতির মাধ্যমে আমরা নিরন্তর তা অনুধাবনের চেষ্টা চালাই। কিন্তু তারই ফলে আমরা গড়ে তুলি বিকৃত, ব্যাধিগ্রস্ত এবং মনোবিকারগ্রস্ত একটা সমাজ, এবং সেখানেই সারাটা জীবন অতিবাহিত করি। অথচ জীবনসমগ্র পড়ে থাকে তার বাইরে।
জীবন, কেউ-ই জানে না সেটা কী। অদ্ভুত এক স্বপ্নের মতো তা আমাদের চতুষ্পার্শ্বে চিরকাল একটা আধো-আলোর বলয়ের মতো ঘিরে থাকে। শাপগ্রস্ত এক জন্তুর মতো আমরা তার ভেতরে এক নিঃসীম হাহাকারের দিকে শুধু এগিয়ে যেতে থাকি।
……………
‘এনলাইটেনমেন্ট’ কী? ‘বোধি’ বলে কি আসলেই কিছু আছে?
এক সন্ধ্যায় আমি সাইবারস্পেসে ইউ.জী. কৃষ্ণমূর্তির দেখা পাই। তাঁকে দেখে বিস্মিত হই। তাঁর কথায়, কথোপকথনে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হই।
রাত গড়াতে থাকে। এক পর্ব পড়া শেষ করে দরজা দিয়ে হঠাৎ বাইরে তাকিয়ে দেখি চারদিকে স্বচ্ছ শাদা আলো। দূরে এক টবে রাখা শাদা বুগেনভিলিয়ার চারায় গুচ্ছ গুচ্ছ ফুলে শীতলশাদা দ্যুতি। এক নিঃশ্বাসে কখন ভোর হয়ে গেছে জানতে পারিনি।
……………….
এটি একটি টেলিভিশন সাক্ষাৎকার। ‘‘Thinking Allowed’’ নামের একটি সাপ্তাহিক টেলিভিশন প্রোগ্রামের জন্যে ড. জেফ্রি মিশ্লাভ (১৯৪৬-) যুক্তরাষ্ট্রে ইউ.জী.’র এই সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেন। ─না. মা.]
…………………………….
মিশ্লাভ: হ্যালো এন্ড ওয়েলকাম। আমি জেফ্রি মিশ্লাভ। আজ আমরা অনুসন্ধান করবো মন─একটি মায়া, একটি মিথ হিসাবে মন, বাস্তবের কোনো বস্তু হিসেবে নয়। আমার সাথে আজ মি. ইউ.জী. কৃষ্ণমূর্তি, একজন দার্শনিক, একজন বিশ্বপরিব্রাজক। তাঁর সংলাপের ওপর রয়েছে কয়েকটি গ্রন্থ─মিস্টিক অভ এনলাইটেনমেন্ট এবং মাইন্ড ইজ আ মিথ। তাঁকে কখনো কখনো মনে করা হয় একজন গুরুবিরোধী, এমন একজন মানুষ যিনি সকল সংজ্ঞার্থ অগ্রাহ্য করেন, অনীহ একজন ঋষি। স্বাগতম, ইউ.জী.।
ইউ.জী.: ধন্যবাদ।
মিশ্লাভ: আপনার ভাবনায়, যদি সেটাকে ভাবনা বলি, আপনি বোধহয় বলতে চান─মন বাস্তব নয়, এই অর্থে যে, দেহ থেকে পৃথক কোনো মন নেই। তাই কি?
ইউ.জী.: হ্যাঁ। যা আছে তা হলো শুধু দেহ। তাহলে মনটা কোথায়? মন বলে যদি কিছু থেকেই থাকে সেটা কি মস্তিষ্কের কর্মকাণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন অথবা আলাদা? কাজেই মনের প্রশ্নটার বিহিত করা খুবই কঠিন। আমরা দেখুন শুধু সংজ্ঞার্থে অভ্যস্ত। এখানে আলোচ্য বিষয়টা হলো: ‘‘মাইন্ড অ্যাজ আ মিথ’’, অথচ আপনার সিরিজটার নামই হলো ‘‘থিংকিং এ্যালাউড’’। চিন্তা নীরবেই করুন আর সরবেই করুন, খুব মৌলিক একটা প্রশ্ন সেটা সামনে নিয়ে আসে─চিন্তা আসলে কী, এবং কেন আমরা চিন্তা করি? চিন্তা স্বয়ম্ভু এবং স্বতঃস্ফূর্ত, এই অনুমান থেকেই এই প্রশ্নগুলির উৎপত্তি। কিন্তু মস্তিষ্ক আসলে শুধুই একটি বিক্রিয়ক, কোনো স্রষ্টা নয়। এটা মেনে নেওয়াটা খুবই কঠিন, যেহেতু শত শত বছর ধরে আমাদের বিশ্বাস করানো হয়েছে বা মগজ ধোলাই করা হয়েছে─তাই আমার এই বক্তব্য মেনে নেওয়া খুবই কঠিন যে, আদৌ চিন্তা বলেই কিছু নেই।
মিশ্লাভ: দেহাত্মবাদী বা অধিযন্ত্রবাদী বলি যাকে, আপনি বোধহয় সেরকম একটা অবস্থান নিচ্ছেন, যে, মস্তিষ্ক একটি যন্ত্র বা কম্পিউটার ছাড়া আর কিছুই নয়।
ইউ.জী.: এটা আসলেই একটা কম্পিউটার, কিন্তু আমরা সেটা মেনে নিতে প্রস্তুত নই। শত শত বছর ধরে আমাদের বিশ্বাস করানো হয়েছে যে একটা সত্তা আছে, একটা অহম্ আছে, একটা আমি আছে, একটা সাইকি আছে, একটা মন আছে, ইত্যাদি।
মিশ্লাভ: আত্মা, বা বলা যায় স্পিরিট।
ইউ.জী.: আত্মা। যদি আপনি সত্যি ব্যাপারটা মানেন─আপনার কাছে সেটা হয়তো সত্যি নয়, আপনি সেটা নাও মানতে পারেন, সম্ভবত আপনি সেটা বাতিলই করে দেবেন এবং অধিকাংশ লোক সেটা বাতিল করতে দ্বিধা করবে না যে─আত্মা বলে কিছু নেই এবং আত্মা মানুষের চিন্তারই সৃষ্টি। শত শত বছর ধরে আমাদেরকে এইজাতীয় ছাইপাঁশ গেলানো হয়েছে এবং এই পথ্য পাল্টানো হলে আমরা সবাই অনাহারেই মারা যাবো।
মিশ্লাভ: অধরা জিনিস বুঝাতে নানারকম শব্দ আছে। আমরা এমনভাবে প্রেম, সততা, ন্যায়পরতার কথা বলি যেন সেগুলো কোনো বাস্তব জিনিস, যদিও সেগুলি যতখানি গুণবাচক বা প্রক্রিয়াবাচক ততখানি বস্তুবাচক নয়।
ইউ.জী.: আমরা বোধহয় মূল প্রশ্নটা থেকে দূরে সরে যাচ্ছি। যদি আপনি চিন্তা করতে না চান, চিন্তা থাকে? চাওয়া এবং চিন্তা চলে একসাথে, এবং চিন্তা হলো বস্তু, এইজন্যেই বস্তুগত বা আধ্যাত্মিক লক্ষ্যার্জনে আপনি চিন্তাকে ব্যবহার করেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে আধ্যাত্মিক লক্ষ্যগুলোকে আমরা একটা শ্রেষ্ঠতর মাত্রায় স্থাপন করি আর যারা বস্তুগত লক্ষ্যার্জনে চিন্তাকে ব্যবহার করে তাদের তুলনায় নিজেদেরকে খুব শ্রেয় গণ্য করি। কিন্তু আধ্যাত্মিক বা বস্তুগত যে নামই দিন, আসলে তথাকথিত আধ্যাত্মিক মূল্যবোধও বস্তুগত। কাজেই এটা হলো বস্তু; চিন্তা হলো বস্তু। এবং একদম শুরুতেই আমি যা বলছিলাম, চিন্তা চিন্তার স্রষ্টা নয়, এটা কেবল উদ্দীপকের প্রতি একটি সাড়া। আছেই শুধু উদ্দীপক এবং সাড়া। এমনকি উদ্দীপকের যে একটা সাড়া আছে এই সত্যিটাও এমন একটা কিছু, চিন্তার সাহায্য ছাড়া আমরা যা অনুভব করতে পারবো না, যা উদ্দীপক ও সাড়ার ভেতর তৈরি করবে একটা বিভক্তি। আসলে উদ্দীপক আর সাড়া একটা ঐকিক মুহূর্ত। এমনকি সংবেদন বলেও কিছু আছে আপনি বলতে পারবেন না; সর্বক্ষণ আমরা যে-তথাকথিত সংবেদন অনুভব করছি বলে মনে করছি, সংবেদন থেকে পাওয়া জ্ঞান ছাড়া আপনার সেটাও অনুভব করার কোনো উপায় নেই।
মিশ্লাভ: এইসমস্ত থেকে আমরা এরকম সিদ্ধান্তেই আসি যে, একটা সত্তা রয়েছে, একটা মন রয়েছে, উদ্দীপক ও সাড়ার ভেতর যেটা মধ্যবর্তন করে চলেছে।
ইউ.জী.: যা আছে তা হলো শুধু সত্তা সম্পর্কীয় আমাদের জ্ঞান, যে জ্ঞান আমরা সঞ্চয় করেছি, বা বংশপরম্পরায় আমাদের কাছে সঞ্চারিত হয়ে এসেছে। আমরা যাকে অহম্ বলি সেটা আমরা এই জ্ঞানের মাধ্যমেই সৃষ্টি করি, আর তারপর দেহের কর্মকাণ্ড থেকে পৃথক হিসেবে এই অহম্ আমরা অনুভব করি। তাহলে অহম্ বলে কি কিছু আছে? আমি বলে কি কিছু আছে? আমার কাছে একমাত্র আমি হলো সর্বনামে উত্তম পুরুষ। আমি ‘‘আমি’’ ব্যবহার করি শুধু সহজে কথাবার্তা চালানোর জন্য, আপনাকে বলি ‘‘আপনি’’, আমাকে বলি ‘‘আমি’’, কিন্তু যেটাকে আমি ‘‘আমি’’ বলছি সেটা শুধুই একটা সর্বনামে উত্তম পুরুষ।
মিশ্লাভ: একটি পদ।
ইউ.জী.: এছাড়া ‘‘আমি’’ বলে কি কিছু আছে? ‘‘অহং’’ বলে কি কিছু আছে? এই প্রাণীটির কর্মকাণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন কোনো অহম্ আছে কি? বিবর্তনের কোনো একখানে …বিবর্তন বলে যে কিছু আছে সেটাও আমি সুনির্দিষ্ট করে বলতে পারি না কিন্তু আমরা ধরে নিই এবং বিশ্বাস করি যে বিবর্তন বলে কিছু একটা আছে… সেই বিবর্তনের কোনো একখানে মানবজাতি এই আত্মচৈতন্য অনুভব করে, এই গ্রহের অন্যকোনো প্রজাতির ভেতরে যার কোনো অস্তিত্ব নেই।
মিশ্লাভ: আপনি বোধহয় বলতে চাচ্ছেন এটা আমাদের ভাষারই একটা উৎপাদন।
ইউ.জী.: এটা যে কেবল ভাষারই উৎপাদন তা নয়। জগৎসমগ্র থেকে যা আমাদের পৃথক করেছে বলছি সেই অনুভূতিটাই হলো বিষয়। সমস্যাটা হলো─এবং আমি যাতে জোর দিতে চাই সেটা হলো─সমগ্র প্রকৃতি একটিই অখণ্ড একক। যাকে আমরা প্রকৃতি বলি এর অখণ্ডতা থেকে মানুষ নিজেকে পৃথক করতে পারে না। দুর্ভাগ্যক্রমে, কোনো এককালে ঘটিত এই আত্মচৈতন্যের মাধ্যমে মানুষ নিজেকে মিলিয়ে নিয়েছে শ্রেষ্ঠত্বের অবস্থানে, নিজেকে একটা উচ্চতর স্তরে স্থাপন করেছে এবং এই গ্রহের অন্যান্য প্রজাতির থেকে নিজেকে শ্রেয়তর বিবেচনা করেছে এবং এখনও আমরা নিজেদেরকে সেইভাবেই বিবেচনা করে চলেছি। সেই কারণেই আমরা এইসমস্ত বিরোধ সৃষ্টি করেছি; সেই কারণেই আমরা এইসমস্ত সাংঘাতিক সমস্যা, প্রতিবেশগত সমস্যা আর অন্যান্য সব সমস্যা সৃষ্টি করেছি। আসলে, মানুষ, বা যা-ই বলুন, প্রকৃতিসমগ্রতা থেকে পৃথক হতে পারে না। সেইখানেই আমরা ভয়ঙ্করতম ভুলটা করে বসে আছি এবং দুর্ভাগ্যক্রমে সেটাই মানুষের ট্রাজেডি।
মিশ্লাভ: আপনি নিজেও মাঝে মাঝে বলেন না যে, আসলে কোনো সমস্যাই নেই─যেহেতু আমরা প্রকৃতিসমগ্রের অংশ, কোনো কিছুই আসলে সমস্যা নয়, যদিও আমাদের ধ্বংস অনিবার্য?
ইউ.জী.: কিন্তু ‘‘কোনো সমস্যাই নেই’’ এই সত্যিটা আমরা মেনে নিতে প্রস্তুত নই। আসলেই কোনো সমস্যা নেই, কিন্তু আমাদের আছে শুধু প্রস্তাবিত সমাধান, এবং সত্যে, প্রজ্ঞায় যাদের অধিষ্ঠান আছে বলে আমরা ধরে নিয়েছি, তাদের প্রস্তাবিত সমাধান আমরা গ্রহণ করে নিয়েছি। এইসব সমাধান দেখুন, আদৌ আমাদের সমস্যার সমাধান করে নাই। তাই আমরা একটা সমাধানের জায়গায় আরেকটা সমাধান প্রতিস্থাপন করতে থাকি। সমাধানটাই হলো সমস্যা এবং অস্তিত্বহীন সমস্যার সমাধানে সমাধান আমাদের কোনো কাজে আসে নাই। তো আসলে, সমাধানই সৃষ্টি করেছে সমস্যা এবং সমাধানগুলো জানালা দিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিতে আমরা প্রস্তুত নই, যেহেতু সমাধানসৃষ্ট সমস্যা থেকে মুক্ত হবার উপায় হিসেবে যারা এইসমস্ত সমাধান প্রস্তাব করেছেন তাঁদের প্রতি আমাদের রয়েছে সাংঘাতিক আস্থা।
মিশ্লাভ: এই যে আমরা মনে করছি জগতের সমস্যার সমাধান হিসেবে আমরা আমাদের মন ব্যবহার করতে পারি, যুক্তিসঙ্গতভাবে কাজ করতে পারি, নিজেদের বিকশিত করতে পারি, বোধিপ্রাপ্ত হতে পারি, সামাজিক কর্মকাণ্ডে নিয়োজিত হতে পারি, এবং এইভাবেই জগতের সমস্যা সমাধান করতে পারি─, আপনি বোধহয় বলতে চাচ্ছেন সেটাই আসলে একমাত্র সমস্যা─যেহেতু আমরা ধরেই নিচ্ছি সেসবের সমাধান আমাদের আছে।
ইউ.জী.: আমি যা বলতে চাচ্ছি তা হলো, আপনার মন বা আমার মন বলে কিছু নেই। সুবিধার জন্যে এবং আরো ভালো এবং যথার্থ একটা শব্দ চাইলে ‘‘বিশ্বজনীন মন’’─শব্দটা ব্যবহার করতে পারি। মানুষের চিন্তা, অনুভূতি আর অভিজ্ঞতার সমষ্টি─যা আমাদের কাছে সঞ্চারিত হয়ে এসেছে সেটাই হলো বিশ্বজনীন মন।
মিশ্লাভ: বিশ্বজনীন মন।
ইউ.জী.: বিশ্বজনীন মন। নিজের স্থিতাবস্থা, ধারাবাহিকতা রক্ষার একমাত্র উদ্দেশ্যেই মূলত এটা আমাকে এবং আপনাকে সৃষ্টি করেছে। বিশ্বজনীন মন, এই শব্দটা যদি ব্যবহার করি, সেটা হলো একটা আত্ম-চিরস্থায়ীকরণ প্রক্রিয়া এবং শুধু নিজের ধারাবাহিকতা বজায় রাখাতেই এর আগ্রহ। যাকে বলে স্বতন্ত্র মন─আপনার মন বা আমার মন, শুধু সেইটা সৃষ্টির মাধ্যমেই এটা তার ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে পারে। কাজেই ওই জ্ঞানের সাহায্য ছাড়া আপনার নিজেকে একটি অস্তিত্ব হিসেবে অনুভব করার কোনো উপায় নেই। এই তথাকথিত অস্তিত্ব─আমি, অহং, আত্মা, সাইকি, বা যে শব্দই আপনি ব্যবহার করুন─এসব সেটারই সৃষ্টি, এবং সেটার সাহায্যেই আপনি এইসমস্ত অনুভব করতে পারেন, এবং এইভাবেই আমরা এই দুষ্টচক্রে আটকে যাচ্ছি যে, জ্ঞান আপনাকে দিচ্ছে অভিজ্ঞতা, এবং অভিজ্ঞতাই আবার শক্তিশালী এবং দুর্ভেদ্য করছে সেই জ্ঞান।
মিশ্লাভ: আপনি বলতে চাচ্ছেন, আপনার কথা যদি সঠিকভাবে বুঝে থাকি, তা হলো, আমি একটি দেহ, একটি মস্তিষ্ক, এবং আমার মস্তিষ্ক কাজ করছে একটা অ্যান্টেনার মতো। বিশ্বজনীন মন থেকে আসা এইসব চিন্তার প্রতি আমি রিসেপটিভ এবং তাতে করে এই মায়া সৃষ্টি হচ্ছে যে আমি একটা স্বতন্ত্র অহং, এমনকি একটা মনও আমার রয়েছে।
ইউ.জী.: হ্যাঁ, কিন্তু মন-অহং-আমি-আত্মা, বা যা-ই বলুন─সেসব-তো দূরের কথা─ওই জ্ঞানের সাহায্য ছাড়া কি আপনার পক্ষে নিজের শরীরকেও একটি শরীর হিসেবে অনুভব করা সম্ভব? যেমন, আপনি আপনার হাতের দিকে তাকাচ্ছেন, এই হাত কি আপনার? প্রথমত, হাতটা হাত-সম্পর্কীয় আপনার জ্ঞান দ্বারা সৃষ্ট কিনা?
মিশ্লাভ: আপনার কথা শুনে আমার জন্মান্ধ লোকেদের নিয়ে একটা গবেষণার কথা মনে পড়ছে, অস্ত্রোপচারের পর প্রথমবারের মতো তারা দেখতে পেল এবং দেখা গেল তারা কিছুই জানে না। দৃষ্টবস্তু শনাক্ত করতে তাদেরকে শিক্ষিত করে তুলতে হচ্ছে। তাহলে মনের মাধ্যম ছাড়া, কোনো-না-কোনোভাবে মন যদি এটা শনাক্তকরণে অভ্যস্ত না হয়ে ওঠে, আপনার কথাই ঠিক, সব কিছুই হবে অর্থহীন।
ইউ.জী.: আমাদের আছেই শুধু এইসব ইন্দ্রিয়। সংবেদজ প্রত্যক্ষণ বলে না যে, এটা একটা হাত। আমাদের জ্ঞানই বলে যে, এটা একটা হাত, এবং সেটা আপনার হাত, আমার হাত নয়।
মিশ্লাভ: তা নাহলে এসব শুধুই রঙ আর রূপের তাপ্পি।
ইউ.জী.: না, এই হাতটা আপনি দেখতেও পাবেন না। এই হাত সম্পর্কে আপনার যে জ্ঞান রয়েছে তার মাধ্যমে ছাড়া এটা আপনার দেখারও কোনো উপায় নেই। সারাজীবন ধরে এই জ্ঞান আমাদের ভেতর ঢুকে চলেছে। একটা শিশুর সাথে খেলা করার সময় আপনি তাকে বলছেন, ‘‘তোমার হাত কই, তোমার নাক কই, তোমার দাঁত কই, তোমার মুখ কই? তোমার নাম কী?’’ এইভাবেই দেখুন আমরা ব্যক্তির সাথে তার নাক-মুখ-চোখ এবং চারপাশের জগতের পরিচয়ের সম্পর্ক গড়ে দিচ্ছি। কাজেই আমরা কি কিছু দেখি? আপনার এই তথাকথিত দেখাটা হলো একটা অস্পষ্ট অভিজ্ঞতা, কারণ জ্ঞান ছাড়া আপনার কোনো কিছুই দেখার উপায় নেই। তাই ওই জ্ঞান থাকাটা আমাদের জন্য আবশ্যক, নচেৎ সুস্থভাবে বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে কাজকর্ম করাই সম্ভব নয়। জ্ঞানটা সুস্থভাবে বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে চালিত হতে সাহায্য করছে, এবং জগৎ যেভাবে আমাদের ওপর আরোপিত হচ্ছে সেটা আমাদের মেনে নিতে হবে। এছাড়া সুস্থভাবে বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে চলার কোনো উপায় নেই; আমাদের পরিণতি হবে পাগলাগারদ, উল্লাসীসুরে উন্মাদগীতি গাওয়া। তাই সংস্কৃতি বা সমাজ বা যা-ই বলুন, তার দ্বারা জগতের বাস্তবতা যেভাবে আমাদের ওপর আরোপিত হয়, ─খুবই আবশ্যক সেভাবেই সেটা মেনে নেওয়া এবং বাদ দেওয়া এবং, মূল্যমানের দিক দিয়ে সেটাকে প্রায়োগিক হিসেবে গণ্য করা, এবং কোনো কিছুর বাস্তবতা বুঝতে সেটা আমাদের সহায়ক হবে না।
মিশ্লাভ: কিন্তু সংস্কৃতি-নিরপেক্ষ একটা মনও তো থাকতে পারে। হতে পারে সেই মনটা আমাদের যেকোনো জ্ঞান থেকে মুক্ত, যেটা সংস্কৃতিকে গ্রহণ করছে…
ইউ.জী.: আমাদের দিক থেকে সেটা একটা অনুমান যে একটা মন আছে। আগে যা বলছিলাম, আপনার অভিজ্ঞতা, অনুভূতি আর চিন্তার সমগ্রতা─আসলেই কি অভিজ্ঞতা, অনুভূতি আর চিন্তার সমগ্রতা বলে কিছু আছে? আমরা ধরেই নিচ্ছি যে অভিজ্ঞতা, অনুভূতি আর চিন্তার সমগ্রতা বলে কিছু একটা আছে। চিন্তা বলেই কি কিছু আছে? সেই প্রশ্নও আমি করি। চিন্তা বলেই কিছু নেই, যা আছে তা হলো শুধু চিন্তা নিয়ে সক্রিয়তা। যাকে আমরা চিন্তা বলি সেটা হলো স্বয়ং চিন্তা নিয়ে একটা দ্বান্দ্বিক চিন্তা মাত্র। চিন্তা, অস্তিত্বহীন এই চিন্তা আমরা ব্যবহার করি কোনো লক্ষ্যে পৌঁছোনার জন্যে, কোনো লক্ষ্য অর্জনের জন্যে; সেই লক্ষ্য জাগতিক না আধ্যাত্মিক, সেটা আসলেই কোনো ব্যাপার নয়। আমাদের লক্ষ্য অর্জনে এটা প্রয়োজন। তাই, যদি আপনি কিছুই না চান, আদৌ কোনো চিন্তা নেই। আপনি জাগতিক জিনিস চান না আধ্যাত্মিক জিনিস চান, বোধিপ্রাপ্ত হতে চান না অবতার হতে চান, নাকি পাশের ফ্ল্যাটের সুন্দরী মেয়েটার সাথে পালিয়ে যেতে চান─সমাজ এইজাতীয় কাজ নিন্দা করতে পারে, কিন্তু মূলত লক্ষ্যার্জনে যে অস্ত্র আপনি ব্যবহার করছেন এবং লক্ষ্যার্জনে যে কাজ আপনি করছেন তা শুধু চিন্তার সহায়তায়। পক্ষান্তরে যে চিন্তাই সেখান থেকে জন্ম নিক সেটাই আপনার জন্য সৃষ্টি করবে যন্ত্রণা, যেহেতু চিন্তা থেকে জন্ম নেওয়া যেকোনো চিন্তা স্বভাবতই ধ্বংসাত্মক, কারণ এটা নিজেকে রক্ষায় আগ্রহী। চিন্তা হলো রক্ষণাত্মক একটা প্রক্রিয়া। এটা প্রকৃতির সমগ্রতা থেকে আপনাকে বিচ্ছিন্ন করে, যে সমগ্রতা থেকে আপনাকে বিচ্ছিন্ন করা যায় না। সমস্যাটা হলো, এটা মেনে নেওয়া আপনার পক্ষে অসম্ভব যে, জগতের সমগ্রতা থেকে আপনি আলাদা নন, যাকে আপনি বলেন প্রকৃতি─এবং প্রাণের অন্য সমস্ত রূপও এই প্রকৃতিরই অংশ। যখন আমি প্রকৃতি শব্দটা ব্যবহার করি, সেটা আমি সাধারণ অর্থে ব্যবহার করি; এমন না যে, প্রকৃতিতে আমার কোনো স্বভাবতঃ অন্তর্দৃষ্টি আছে যা অন্যদের নেই। আপনি প্রকৃতি থেকে পৃথক নন; প্রকৃতি অর্থ আপনার চারপাশের জগৎ। আমরা যাকে প্রকৃতি বলি, এই গ্রহের সমস্ত প্রজাতিই তার অখণ্ড অংশ; সেইটা থেকে একে বিচ্ছিন্ন করা যায় না। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে, আমাদের চিন্তার মাধ্যমে আমরা নিজেদেরকে পৃথক করতে সক্ষম হয়েছি, এবং এই জ্ঞানের সাহায্যেই আমরা জ্ঞানের ধারাবাহিকতা বজায় রাখি, এবং সেজন্যেই আমরা উদ্ভাবন করেছি যাবতীয় ন্যায়পরায়ণতা─প্রকৃতির সাথে একাত্ম হওয়া, এইসমস্ত─এবং সামনে কোনো সফলতা নেই, কারণ আমরা বুঝি না এবং অনুধাবন করি না যে, জগৎসমগ্র থেকে যা আপনাকে পৃথক করেছে সেটা হলো চিন্তা। এবং একটা অখণ্ড ঐক্য ঘটাতে চিন্তাকে ব্যবহার করা যায় না। মূলত আমরা সবাই অখণ্ডরূপে যুক্ত এবং দুর্ভাগ্যক্রমে, আমাদের চিন্তার মাধ্যমেই আমরা নিজেদের পৃথক করেছি, এবং এই পৃথকতার জায়গা থেকেই আমরা ক্রিয়া করে যাচ্ছি, এবং আপনার ব্যক্তিগত জীবনের গোলমাল আর আপনার চারপাশের দুনিয়ার গোলমালের জন্য দায়ী এইটাই। আমি বলেই যাচ্ছি, কিন্তু…
মিশ্লাভ: হুঁ, বহু ধারণার কথা আপনি বলেছেন এবং বহু চিন্তা জাগিয়ে তুলেছেন। সেটা হয়তো আমার ভেতরে সঞ্চারিত হয়ে গেছে। যদি একটু পিছিয়ে যাই─আপনি বোধহয় বলছিলেন─যা-কিছু আমরা জানি তা চিন্তার দ্বারাই, এবং তারপরও চিন্তা স্বয়ং কী, তা আমরা জানতে পারি না, যেহেতু যখনই আমরা চিন্তার দিকে দৃষ্টি দিই, চিন্তা দেখতে পাই না, দেখি শুধু চিন্তাবিষয়ক চিন্তা।
ইউ.জী.: এখন আমরা যে চিন্তা নিয়ে কথা বলছি সেটাও ওই প্রাপ্ত-জ্ঞান দ্বারা সৃষ্ট। তো চিন্তা একটা আত্ম-চিরস্থায়ীকরণ প্রক্রিয়া। এবং যখন আমি ‘আত্ম’ শব্দটি ব্যবহার করছি, দার্শনিক বা আধিবিদ্যকরা যে অর্থে সেটা ব্যবহার করেন সেই অর্থে নয়─একটা সেল্ফ-স্টার্টার।
মিশ্লাভ: কিংবা আত্ম-নিত্যকরণ।
ইউ.জী.: হ্যাঁ, নিত্যকরণ। দেহের তাতে আদৌ কোনো আগ্রহ নেই। দেহের ক্রিয়া হলো উদ্দীপকের প্রতি সাড়া এবং এর নিজস্ব কোনো পৃথক, স্বাধীন অস্তিত্ব নেই। দুর্ভাগ্যক্রমে, কালই জন্ম দিয়েছে শুরু এবং শেষ, এবং কালের আগ্রহ হলো স্থায়িত্বে, যেখানে শরীরের কর্মকাণ্ড তার নিজস্ব ধরনেই নিত্য, কারণ এর কোনো শুরু নেই, এর জন্মই হয়নি, তাই এর কোনো মৃত্যুও নেই। চিন্তার একটা মৃত্যু আছে কিন্তু দেহের কোনো মৃত্যু নেই। জানি না আমার কথা পরিষ্কার করতে পেরেছি কিনা।
মিশ্লাভ: বেশ, আপনার কথাটাই আরেকভাবে বলার চেষ্টা করি। আপনি বোধহয় এখানে একরকম বিশেষ বিজড়িত ধারণার কথা বলতে চাচ্ছেন এবং তার মধ্যে একটা হলো─চিন্তা স্বভাবতই নিজেকে নিত্যতা দেয়।
ইউ.জী.: এটা শেষ হতে চায় না।
মিশ্লাভ: মনের কোনো অস্তিত্বই নেই, কিন্তু তারপরও এটা বিশ্বাস করতে চাইছে এটা নিত্য।
ইউ.জী.: সত্তা, আত্মা, অহং, বা যে নামই দিন─সেটার একটা কৃত্রিম অমরত্ব সৃষ্টিতে এর আগ্রহ। কিন্তু সে এটাও জানে যে কোনো একসময় সে শেষ হতে যাচ্ছে, এবং এর টিকে থাকা, এর ধারাবাহিকতা, এর স্থিতাবস্থা নির্ভর করছে দেহের ধারাবাহিকতার ওপর। কিন্তু দেহ কোনভাবেই চিন্তায় লিপ্ত নয়, যেহেতু এর কোনো শুরু নেই, শেষ নেই। এই হলো জন্ম আর ওই হলো মৃত্যু─ এই দু’টি বিন্দু দেখুন চিন্তারই সৃষ্টি।
মিশ্লাভ: তাহলে আমাদের যে একটা মন আছে এই মায়ার জন্মই হয়েছে ভয় থেকে।
ইউ.জী.: ভয় থেকে। তাই আমরা চাই না ভয়ের সমাপ্তি হোক, যেহেতু ভয়ের সমাপ্তি হলো চিন্তারও সমাপ্তি। চিন্তা যদি শেষ হয়ে যায়, সেখানেই দেহের মৃত্যু হয়। তারপর যা থাকে সেটা এমন কিছু দেহ যা জানে না। আপনার কাছে আমি জীবিত, মৃত নই, যেহেতু আপনি শুনতে পাচ্ছেন আমি আপনার প্রশ্নে সাড়া দিয়ে যাচ্ছি। কিন্তু যে বলছে সে কেউ না।
মিশ্লাভ: সেখানে কোনো আপনি নেই।
ইউ.জী.: যে কথা বলছে সে কেউ না, আছে শুধুই কথা। এটা যেন একটা টেপরেকর্ডার, এবং আপনার নিজস্ব কারণে আপনি সেটা বাজাচ্ছেন, এবং সেখান থেকে যা-ই বেরিয়ে আসুক, সেটা হলো এই টেপরেকর্ডারটা থেকে আপনি যা শুনতে চাইছেন।
মিশ্লাভ: আপনি বোধহয় অনেকটা সেইসব পদার্থবিদদের মতো অবস্থান নিচ্ছেন, যারা বস্তুকে দেখেন অণু এবং পরমাণু, তারপর দেখেন কণিকা, কণিকার ভেতরে দেখেন কার্ক, এবং শেষমেশ তারা বলেন যে সেখানে আসলে কিছুই নেই।
ইউ.জী.: খুব শিগগিরই বিজ্ঞানীদের মেনে নিতে হবে যে যাকে তাঁরা মৌলকণা বলেন সেটার অন্বেষণে তাঁদের চেষ্টাটা নিষ্ফল। মৌলকণার যে কোনো অস্তিত্বই নেই সেটা তাঁরা উপলব্ধি করেন না এবং সেটা তাঁরা মেনে নিতে প্রস্তুত নন। এরপর একসময় তাঁরা সেটা মেনে নেবেন, এবং স্বীকার করবেন যে মৌলকণা বলে আসলে কিছু নেই, এবং মহাবিষ্ফোরণ, বা যা-ই তাঁরা এটার নাম দিন─সেরকম কিছুই নেই─এ-সবই নিষ্ফল প্রচেষ্টা। তাঁরা এইসমস্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়ে যাবেন, উত্তর খুঁজে বার করতে চাইবেন─ শুধু তাঁদের নোবেল পুরস্কারের জন্য।
মিশ্লাভ: আপনি বোধহয় বলতে চাইছেন আছে শুধু দেহ, আছে শুধু মস্তিষ্ক, আর আছে শুধু প্রকৃতি।
ইউ.জী.: কিন্তু এর কোনো শুরু নেই, কোনো শেষ নেই; আমি জোর দিচ্ছি এখানেই। সুতরাং দেহের যেহেতু জন্মই হয় নাই, এর মৃত্যুও নেই।
মিশ্লাভ: বেশ, আপনি বলছেন দেহের জন্মই হয় নাই, সেটা বোধহয়─
ইউ.জী.: চিন্তাই সৃষ্টি করেছে দেহ এবং একটা বিন্দু প্রতিষ্ঠা করে বলেছে এইখানে এর সৃষ্টি হলো আর ওইখানে এটা শেষ হতে যাচ্ছে। তো চিন্তাই কাল বিষয়টার জন্ম দিয়েছে।
মিশ্লাভ: আপনি বলতে চাইছেন প্রত্যেকটি কোষ, এমনকি ডিমটাও সৃষ্টি হয়েছে তার পূর্ববর্তী কোষ থেকে।
ইউ.জী.: এর শুরুটা আমরা জানি না। সুতরাং স্রষ্টার সকল ধারণা অনাবশ্যক। যৌক্তিক চিন্তার ক্ষেত্রটাতে আমরা আটকে গেছি, এবং এই যে কোনো শুরু নেই, শেষ নেই─এটা এমন একটা কিছু, যা আমাদের যৌক্তিক চিন্তার সমগ্র কাঠামোটা, সমগ্র ভিত্তিটাই বিধ্বস্ত করে দিচ্ছে।
মিশ্লাভ: হ্যাঁ, সেটাই।
ইউ.জী.: সেইজন্যেই আমরা মোটেও সেটা মানতে রাজী নই।
মিশ্লাভ: কিন্তু শুরু নেই শেষ নেই ধারণাটা স্থান-কালে কীভাবে প্রযুক্ত হতে পারে বুঝা যায়, তবে সেটা দেহের ক্ষেত্রে নয়।
ইউ.জী.: আপনি এমনভাবে বলছেন যেন এই দেহ, জগতের সমগ্রতা বা প্রকৃতির সমগ্রতা, বা যে নামই তাকে দিন─তা থেকে আলাদা। চিন্তাই সৃষ্টি করেছে দেহ, একটি পৃথক অস্তিত্ব, আর বলছে যে, এর একটা শুরু আছে, এর একটা শেষ আছে। শেষটাই দেখুন শুরু। এটাই সৃষ্টি করেছে স্থান। চিন্তার সৃষ্টি স্থান, চিন্তার সৃষ্টি কাল। তাই স্থান-কালের বাইরে সে কোনো কিছুর সম্ভাবনা কল্পনা করতে পারে না। চিন্তাই আসলে স্থান সৃষ্টি করে সেটাকে অনুভব করে, কিন্তু সত্যিকার অর্থে স্থান বলে কিছু নেই। যা আছে তা হলো স্থান-কাল সন্ততি, সেটা একটা সন্ততি মাত্র, কিন্তু এর কোনো শেষ নেই। শুরু নেই এবং কোনো এককালে গিয়ে পৌঁছুবে সেরকম কোনো বিন্দু নেই, এরকম কোনো গতিময়তার সম্ভাবনা চিন্তা কল্পনা করতে পারে না। তো এই হলো চিন্তার সমস্যা; এর ক্রিয়া সীমিত এর নিত্যকরণে, এর ধারাবাহিকতায়, এর স্থায়িত্বে। কিন্তু এটা যা নিয়ে যা-ই বলুক─এটা দেহের কথাই বলতে চায়, দেহের সাথেই কারবার করতে চায়, দেহেরই অভিজ্ঞতা নিতে চায়─, এটা তা পারে না, যেহেতু জীবন্ত চিন্তা হলো মৃত একটা কিছু।
মিশ্লাভ: আপনি বোধহয় বলতে চান─যদি আপনার ভাবনার সারসংক্ষেপ করি─, আমরা আমাদেরই চিন্তা-কারাগারের ফাঁদে আটকে গেছি এবং এই কারাগার এই মায়া তৈরি করেছে যে আমরা আলাদা, আমরা প্রকৃতির অংশ নই, অথচ স্বয়ং কারাগারটাও একটি মায়া।
ইউ.জী.: কারাগারটাও চিন্তার সৃষ্টি, আর সেইজন্যেই নিজেরই বানানো এই ফাঁদ থেকে সে বেরিয়ে আসতে চাইছে। ভারতীয় এক শাস্ত্রের সেই রূপকটির মতো। কুকুরটা একটা হাড় তুললো মুখে, শুকনো হাড়, কিছুই নেই সেই হাড়ে। তারপর সে কামড়াতে লাগলো হাড়টা, হাড়ে তার মাড়ি ক্ষত হয়ে রক্ত বেরিয়ে এলো। এবং কুকুরটা মনে করলো (বা, কল্পনা বা অনুভব করলো, যা-ই বলুন) রক্তটা বেরুচ্ছে ওই হাড়টা থেকেই, অথচ সেটা বেরুচ্ছে তার নিজেরই মাড়ি থেকে। তো এইরকম ফাঁদেই চিন্তার সমগ্র কাঠামোটা আটকে গেছে, আর সারাক্ষণই সে সেটা থেকে, স্বয়ংসৃষ্ট ওই ফাঁদটা থেকে, বেরিয়ে আসতে চাইছে।
মিশ্লাভ: সেটাই মানুষের দুর্দশা।
ইউ.জী.: সেটাই মানুষের দুর্দশা।
মিশ্লাভ: অনেক ধন্যবাদ ইউ.জী. আমার সাথে থাকার জন্যে। আমাদের সময় শেষ।
ইউ.জী.: অনেক ধন্যবাদ।
মিশ্লাভ: ইটস বিন আ প্লেজার।
ইউ.জী.: ধন্যবাদ।
…………
১. অধিযন্ত্রবাদ: mechanistic; (বিশ্বের এবং সকল জীবের সকল পরিবর্তন ভৌত ও রাসায়নিক বল দ্বারাই সংঘটিত হয় এই মতবাদ।)
২. পদ: A part of speech.
৩. আত্ম-চিরস্থায়ীকরণ প্রক্রিয়া: self-perpetuating mechanism.
৪. রিসেপটিভ: receptive; গ্রহণক্ষম।
৫. মহাবিস্ফোরণ প্রসঙ্গে ইউ.জী.’র বক্তব্যের ক্ষেত্রে পাঠক ‘Black Holes and Baby Universes and Other Esseys’ গ্রন্থে কোয়ান্টাম ম্যাকানিক্স বিষয়ক আলোচনায় স্টিফেন ডব্লু. হকিং’এর মন্তব্যটা স্মরণ করতে পারেন, ‘…হয়তো কোয়ান্টাম নীতির অর্থ হতে পারে কালে ইতিহাসের একটি প্রারম্ভ থাকা, মহাবিস্ফোরণে একটি সৃষ্টির মুহূর্ত থাকা, এ-জাতীয় তথ্য এড়িয়ে যাওয়া।’
৬. স্থান-কাল সন্ততি: space-time continumm; স্থান ও কালের ধারণার একীভবন। [স্থানের তিন মাত্রা (দৈর্ঘ্য, প্রস্থ ও বেধ) এবং কালের এক মাত্রার সমন্বয়ে গঠিত চারমাত্রিক মহাবিশ্বের ধারণা।] continumm অর্থ সন্ততি─‘অবিচ্ছিন্ন একটি গঠনে রয়েছে’─এই হিসেবে যেকোনো কিছুকে দেখা।
……………
[অনুবাদের স্বত্ব সংরক্ষিত।]
Pingback: ইউ.জী. কৃষ্ণমূর্তির সাথে কথোপকথন: ৭ » সাহিত্য ক্যাফে