মাসুদ খান-এর একগুচ্ছ কবিতা

 

 

ডাকাতি

সাহাদের বাড়িতে ডাকাত পড়েছে। মাথায় মারণকল ঠেকিয়ে বাড়ির
লোকজনদের বেঁধে রেখে ডাকাতি করছে ডাকাতের দল। এরই মধ্যে
কোনো এক ফাঁকে সাহাদের আদর-কাড়া হোঁদলকুতকুতে ছোট্ট ছেলেটি
আতঙ্কিত হয়ে হামাগুড়ি দিয়ে এসে উঠে পড়েছে ভীষণদর্শন এক
ডাকাতের কোলে। আঙুল চুষতে চুষতে ঘুমিয়েও পড়েছে একসময়।

পাড়ায় শোর পড়েছে, ভোর হয়ে আসছে, পুলিশ এসে পড়ছে…
এদিকে ভ্যাবাচ্যাকা-খাওয়া ডাকাতটি ঘুমন্ত শিশুকোলে বসেই
রয়েছে নির্বোধের মতো…সাঙ্গাতরা সব পালিয়ে গেছে সেই কখন…

 

সুশীল ও দুঃশীল

বাইরের জগৎ থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন একদল জংলি মানুষ গহিন জঙ্গল থেকে বেরিয়ে পথ
হারিয়ে হারিয়ে দৈবক্রমে সভ্য মানুষের লোকালয়ে এসে পড়েছে। শিশুর কৌতূহল নিয়ে তারা
দেখছে সবকিছু— কী সুন্দর সাজানো-সাজানো ঘরবাড়ি! গাছপালাগুলিও কেমন সাজানো-সাজানো।
ফল পেকে আছে গাছে গাছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ওই আধানাঙ্গা অসভ্য মানুষগুলি পেঁপেগাছ
থেকে পাকা পেঁপে, টমেটোগাছ থেকে পাকা টমেটো ছিঁড়ে-ছিঁড়ে খেতে শুরু করে দিয়েছে।
এদিকে চেঁচামেচি করতে করতে বেরিয়ে আসছে সভ্য মানুষেরা। তাদের এই চিল্লাচিল্লির
কারণ বুঝতে পারছে না অসভ্যরা। তারা বরং উদ্দাম খুশিতে, উল্লাসে-ইঙ্গিতে সভ্যদেরকেও
ডাকছে সেই আনন্দময় ফলাহরণ ও ফলাহার উৎসবে শরিক হতে। কিন্তু সভ্যরা এসেই বেধড়ক
মারতে শুরু করে দিয়েছে। মার খেতে-খেতে জংলিরা করুণ ও বিস্ময়বিস্ফার চোখে তাকাচ্ছে
বারবার সভ্য-সুশীল মানুষদের মুখের দিকে। বুঝতে চেষ্টা করছে, কী কারণ হতে পারে
তাদের এই অস্বাভাবিক আচরণের। বুঝতে পারছে না।

 

জ্ঞাতি

কোনো কোনো প্রাণীর নামে খেতাব পেলে মানুষ রাগ তো করেই না বরং খুশি হয়, সম্মানিত
বোধ করে…যেমন বাঘ, সিংহ, কিউই…। আবার কোনো কোনো জানোয়ারের নামে ডাকলে অপমানিত
বোধ করে…যেমন গরু, গাধা, ভেড়া, কুকুর, বিড়াল, শিয়াল, শুয়োর…। মানুষকে প্রাণীর
নামে তকমা ও খেতাব দেওয়ার রেওয়াজ চালু আছে বহুকাল ধরেই। মানুষের এসব কাণ্ড দেখে
প্রাণীদের মধ্যে অদ্ভুত, মিশ্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হচ্ছে। কোনো-কোনো প্রাণী বেশ
অবাক হচ্ছে, কেউ-কেউ লজ্জা পাচ্ছে। শোনা যায় ইদানিং কেউ-কেউ বিব্রতও বোধ করতে শুরু
করেছে।

 

জ্যামিতি

প্রবাদ আছে— বিল গেটসের হাত থেকে একশো ডলারের নোট পড়ে গেলে তিনি কি তা ওঠাবেন?
প্রবাদে প্রশ্নই শুধু নয়, উত্তরও বের করা হয়েছে হিসাব কষে। —না, ওঠাবেন না, কারণ
টাকাটা ওঠাতে যতক্ষণ লাগবে, ততক্ষণে তিনি আয় করতে পারবেন তার চেয়েও বেশি।

কারো কাছে পড়ে-যাওয়া টাকা ওঠানো মানে সময় নষ্ট। অন্যদিকে, এই একুশ শতকে, একই সময়ে,
এমনও রয়েছে— পুরো এক সপ্তাহ হাড়ভাঙা খাটুনি খেটে কেউ পাচ্ছে মাত্র এক ডলার। অর্থাৎ
একজনের সময় ও শ্রমের মূল্য আরেকজনের চেয়ে প্রায় ৬০ লক্ষ গুণ বেশি। তথ্যটি কেমন
অলৌকিক আর আধিভৌতিকের মতো শোনায়। বিঁধে যায় সরাসরি মর্ম বরাবর।

গায়ে-হিম-ধরানো এই তথ্যের ভেতরকার যে-আধিভৌতিকতা, তার চৌহদ্দির চারধারে নিশান
আকারে দাঁড়ানো অন্তত কয়েকটি কুহকী প্রপঞ্চ— সময়, সমাজ, ব্যক্তি, অর্থ, রাজনীতি…
আর এইসব প্রপঞ্চের উদ্ভব, বিকাশ ও বিলয় নিয়ে ভাবতে ভাবতে একেবারে পুড়ে-পুড়ে গেছেন
যাঁরা যুগে যুগে, সেইসব ভাবুকেরাও বিস্ময়ে হা হয়ে আছেন। তথ্যটির ভেতরে বিরাজমান যে
লোমহর্ষকতা, ভয়ের যে আবহ, আপাতত সেসবের মাত্রা ও গভীরতা নিয়ে ভাবছেন তাঁরা।

 

গোলাকার ও নিচ্ছিদ্র

মলমূত্র-ত্যাগ-করেন-না ব’লে খ্যাত কয়েকজন অসাধারণ মানুষের মধ্যে দেখা হয়ে গেল পরস্পর।
দেখা হলো তো হলো সেই মলমূত্র ত্যাগ করতে গিয়েই। দেখা হওয়ামাত্র তাদের সে কী লজ্জা!
লজ্জায় একেবারে কুঁকড়ে যেতে লাগলেন তারা, যেতে-যেতে অনেকটা গোলাকার হয়ে গেলেন।
তারপর থেকে তারা কেমন-যেন গড়িয়ে গড়িয়েই চলেন, গোলাকার ও নিচ্ছিদ্র।

ওদিকে ছিদ্রান্বেষীরা অন্বেষণ করেই চলেছে পরম নিষ্ঠায়…

 

ঊনীশ্বর

ধনকুবেরদের খুব একটা দেখা যায় না প্রকাশ্যে। আর যারা অবিশ্বাস্যরকম ধনাঢ্য, তাদের
তো দেখা যায় না বললেই চলে। তাদের কেবল ছায়া-ছায়া উপস্থিতি আর তাপ ও প্রতাপ টের
পাওয়া যায় বিশ্বজুড়ে। সাকার-শরীরী মূর্তি নয়, নিরাকার ভাবমূর্তি ঝলকায় তাদের। অথচ
দ্যাখেন, রাজনীতিবিদদের দেখা যায় হামেশাই, বুদ্ধিজীবীদেরও— সাধারণদের তো বটেই,
এমনকি পৃথিবীর পরাক্রমশালী, বাঘা-বাঘা রাজনীতিবিদ ও বুদ্ধিজীবীদেরও…তাদের বরং
দেখা যায় আরো বেশি-বেশি। তারা সবসময়ই মুখর ও মুখরিত, প্রকাশ্য ও প্রকাশিত থাকতে
ভালবাসেন।

এক মহাকুবের। তার ধনসম্পদের পরিমাণ কত, নিজে জানেন না। দুনিয়া জুড়ে ছড়িয়ে আছে তার
কলকারখানা। একবার সেই টাইকুন পরিদর্শনে এলেন তার এক ইন্ডাস্ট্রিতে। ইচ্ছা—
দেখাসাক্ষাৎ করবেন, কথা বলবেন শ্রমিকদের সঙ্গে। কারখানায় সাজসাজ রব, নানামুখী
গুঞ্জন। শ্রমিকেরা কাজ করার ফাঁকে ফাঁকে উদগ্রীব ও চঞ্চল হয়ে তাকাচ্ছে। একসময় শোনা
গেল- মালিক এসেছিলেন, আবার চলেও গেছেন। কেউই টের পায়নি। তবে আবছা একঝলক দেখেছে
নাকি তাকে কেউ-কেউ। কেউ বলছে বডি-সপ্রের ঘ্রাণ পাওয়া গেছে তার এক পশলা। কেউ-কেউ
নাকি শুনতেও পেয়েছে প্রভুর হাসির রেশ, এক ঝিলিক। হাতের উষ্ণ ছোঁয়া লেগে আছে তার,
কারো কারো হাতের তালুতে।

এইসব রংবেরঙের ডেজা-ভ্যু আর হ্যালুসিনেশনে ছেয়ে যাচ্ছে শ্রমিকদের কায়মনোবাক্য,
জিহ্বা ও জঘন, মূর্ধা ও শ্রবণ…

 

গুরু

গুরুর অন্তিম ইচ্ছা— মরণের পর কবর না দিয়ে যেন গার্বেজ করা হয় তাকে। তন্নিষ্ঠ
ভক্তরা তা-ই করছে। তবে এমনি-এক জায়গায় গার্বেজ না করে গুরুর মরদেহটি নিয়ে বিসর্জন
দিচ্ছে রিসাইক্লিং বিন-এ, ‘জলে-স্থলে-অগ্নিকুণ্ডে, মরণ নাই তার কোনো কালে’ গাইতে
গাইতে। বিশ্বাস- দোলনা থেকে কবরের দিকে না গিয়ে পুনশ্চক্রপথে গুরু তাদের গিয়ে
উঠবেন নতুন কোনো দোলনায়। দোল খাবেন ননী-লাগা কচিমুখে মিটিমিটি হাসি ফুটিয়ে…

 

পিঁপড়া

বলের ওপর একা-একা ঘুরে বেড়াচ্ছে একটি পিঁপড়া। তার কাছে আর যাই হোক বলটিকে গোলক মনে
হচ্ছে না। কারণ পিঁপড়ারা তো দ্বিমাত্রাদৃষ্টি, আর গোলক হলো ত্রিমাত্রিক। অতএব
যেদিকেই তাকাবে পিঁপড়া, দেখতে পাবে চামড়ার নিখিল বিস্তার। সমগ্র বলটি সে ঘুরেও
আসবে একসময়, তবু তার বোধে অসীমই থেকে যাবে বলের আকার।

পিঁপড়ার বোধের দৌড় দুই মাত্রা অবধি, মানুষের বড়জোর তিন বা চার মাত্রা…

অতঃপর, বহুকাল পরে, মানুষ হয়তো একদিন প্রদক্ষিণ করে আসবে সমগ্র ব্রহ্মাণ্ড। কিন্তু
তারপরও তার বোধে মহাবিশ্ব থেকে যাবে অধরা, অসীম। খিলহীন, খটকাবিহীন।

সেদিন সশব্দে হেসে উঠবে পিঁপড়া। দেখাদেখি হেসে উঠবে
মানুষও…ভোলা-ভুতো-হাবা-ড্যাবা-আহা-খেলিছে-তো-বেশ-বেশ-বালকের হাসি…

 

মায়া

মরুভূমিতে গাছপালা নাই, অক্সিজেনের কারখানাও নাই। কী হবে তাহলে, সেখানকার আগুনরঙা
মানুষ ও প্রাণীদের? ওরা তো মারা যাবে নির্ঘাৎ দমবন্ধ হয়ে- এই শ্বাসরুদ্ধকর ভাবনায়
শিউরে শিউরে উঠছে স্নেহে-ভেজা আমাজন বন, দূরের দ্রাঘিমায়। আর অবিরাম রান্না করে
চলেছে অক্সিজেন…সেই কবে থেকে…মায়ের মমতায়…

 

ট্যাবু

মানুষেরা, প্রাণীরা আহার করে খাদ্য। ত্যাগ করে পুরীষ। সেই অর্থে ত্যাগী (!) সবাই।
যা হোক, প্রচুর পুষ্টি-উপাদান নাকি থেকে যায় তাদের সে-বর্জ্যে। মানুষ তা ফেলেই-বা
দেবে কেন? বিজ্ঞানীরা তাই মলমূত্র থেকে খাদ্যনিষ্কাশনের পদ্ধতি আবিষ্কার করেছে। আর
সে-খাদ্যকে করা হয়েছে সুস্বাদু ও সুবাসিত। এবং সুভাষিতও।

পুরীষজাত প্রথম যে-খাদ্য, তা পরিবেশন করা হলো সেই বিজ্ঞানীকে যিনি এর আবিষ্কর্তা।
বিজ্ঞানীর ট্যাবু নাই, টোটেম নাই, নাই তার হালাল-হারাম। তবু হঠাৎ কেমন-যেন
অপ্রস্তুত হলেন তিনি। তামাম দুনিয়া উৎসুক তাকিয়ে আছে তার দিকে। অগত্যা কিছুটা
সংকোচ কিছুটা অসহায়ত্ব মেশানো ভঙ্গিতে বিসমিল্লা করলেন সেই অভিনব খাদ্যবস্তুর।

 

গোলযোগ

সৌরমণ্ডলের খুব কাছ দিয়ে ছুটে যাচ্ছে এক খণ্ডনক্ষত্র। তার গতিপথ এমন যে, পৃথিবীর
এক পিঠে যখন সূর্যের আলো অন্য পিঠে তখন সেই খণ্ডনক্ষত্রের জ্যোতি। দিনের বেলায়
দিনমণি, রাতের বেলায় অতিথি সূর্য। চব্বিশ ঘন্টাই আলো। প্রথম-প্রথম সবাই খুশি।
কয়েকদিন যেতে না যেতে ত্যক্তবিরক্ত সবাই। সালোকসংশ্লেষণ করতে করতে ক্লান্ত উদ্ভিদ
ও তরুলতা। পাতায়-পল্লবে বেড়ে উঠছে তারা অস্বাভাবিক গতিতে। ফুল-ফল ফুটতে শুরু করে
দিয়েছে উচিত সময়ের অনেক আগেই। বিরক্ত পশুপাখিরাও। বিড়াল বিরক্ত, বিরক্ত উদ্বিড়ালও…বাঘ
বিরক্ত, বাঘের মাসি বিরক্ত, পাঁঠা বিরক্ত খাসি বিরক্ত, জলহস্তী স্থলহস্তী সব
বিরক্ত। দুই পাতা যাতে এক করতে না পারে সেজন্য চোখের পাতার অগ্রভাগের চুল ছেঁটে
দেওয়া হতো কয়েদিদের; গ্রহের প্রাণীদের অবশ্য তা করা হয়নি, তবু তারা ঘুমাতে পারছে
না। খালি ছোটাছুটি, ব্যস্ততা। নাই-কাজে ব্যস্তসমস্ত। আর খেতে-খেতে হয়ে যাচ্ছে সব
খোদার খাসি একেকজন। বেড়েই চলেছে গ্রহের জৈবত্ব। আর আবহাওয়া! সৃষ্টিছাড়া ঝড়বৃষ্টি,
জলোচ্ছ্বাস, উল্টাপাল্টা বাতাস। আবহাওয়া দপ্তরের চূড়ায় চরকির মতো ঘুরেই চলেছে কানা
হাওয়ামোরগ— এই বামাবর্তে তো পরক্ষণেই দক্ষিণাবর্তে। পূর্বাভাস দেওয়া বন্ধ করে দিয়ে
পালিয়ে গেছে আবহাওয়া-কর্মীরা। সম্ভব কি, পাগলা আবহাওয়ার পূর্বাভাস?

ছেঁড়া এক নক্ষত্র এই নয়-পাড়া ইউনিয়নের পাশ দিয়ে হুস করে ছুটে যাচ্ছে, তাতেই এত
তারছিঁড়া কাণ্ডকারখানা!

 

বিড়াল

একশো একটি ইঁদুর মারার পর পুরাপুরি অহিংস হয়ে যাবে মর্মে নিয়ত করেছে বিড়াল। গলায়
পরেছে খড়ের তৈরি রুদ্রাক্ষের মালা…’অহিংসা পরম ধর্ম মন্ত্র জপতে-জপতে যাত্রা
করেছে সে বুদ্ধগয়ার দিকে। পথে-পথে কত চিকা ও চড়ুই কত অঙ্গভঙ্গি করে, রংঢং করে।
দেখে মেজাজ বিগড়ে যায়, তবু মাথা ঠাণ্ডা রেখে পথ চলে বিড়াল-ব্রহ্মচারী।

 

অমৃতের সন্তান

সকালের রোদে ছোটাছুটি করছে শিশুরা। তাদের চাঞ্চল্যে, কিচিরমিচির আওয়াজে আমোদিত
চারপাশ। ননী ও মাখনে গড়া শিশুরা জগতে এক অনির্বচনীয় আনন্দের উৎস। কিন্তু বেলা
বাড়ার সঙ্গে-সঙ্গে, বিশেষ করে পড়ন্ত বেলায়, গলতে থাকবে ওই ননী ও মাখন, একটু একটু
ক’রে। জরা এসে দখল নিয়ে নেবে শরীর ও মনের। ভেসে উঠবে শতশত ভাঁজ ও কুঞ্চন। হায়,
ফুটফুটে শিশুরাও বুড়িয়ে যাবে একদিন!

কী ক’রে ঠেকানো যাবে জরা, তা নিয়ে যুগ-যুগান্তর সাধনা করতে করতে কেমন পোড়া-পোড়া
হয়ে গেছে মানুষ, এক কালের স্বঘোষিত অমৃতের সন্তান। কিন্তু কিছুতেই থামাতে পারেনি
ভঙ্গুরতা…ঝুরঝুর করে ভেঙে-ভেঙে গেছে সে। আর তার সন্ধ্যাশিথানের পাশে উড়েছে
আয়ুর্বেদের রাশি-রাশি এলোমেলো ছেঁড়া পাতা।

অবশেষে সেই বহুপ্রতীক্ষিত, বহু সাধ ও সাধনার মাহেন্দ্রমুহূর্ত আজ সমাগতপ্রায়। এই
শতকেরই কোনো এক সময়ে মানুষেরই হাতে উদ্ভাবিত হবে সেই আশ্চর্য ধন্বন্তরী যা তাকে পথ
চিনিয়ে নিয়ে যাবে অমরতার দেশে। ইতিহাস বিভাজিত হয়ে যাবে পরিষ্কার দুটি কালখণ্ডে—
প্রাক-অমরতা আর উত্তর-অমরতা খণ্ডে। সেদিনের সেই বোধন-উৎসবে, সেই মহা-মাইফেলে হাজির
থাকবেন যুগের যুগের দুনিয়াদোলানো যত ভিষকের দল- চরক, সুশ্রত, ধন্বন্তরী, হিপোক্রেটিস…।
থাকবেন যযাতি, গিলগামেশ,…এঁরাও।

সেইদিন সেই অমরতা-রাজ্যগামী নুহের নব্য উড়নজাহাজে ওঠার জন্যে তোমাদের প্রায় সবাইকে
আমি পথ করে দেব, পারঘাটায় দাঁড়িয়ে থেকে, সবার পেছনে। নিজেও ওঠার চেষ্টা করব…তবে
আরোহণ হয়তো হবে না আমার, যদিও ‘আরোহ আরোহ’ ব’লে এক অচেনা উন্মাদনা সংরক্ষণে থেকে
যাবে। মিস করব অল্পের জন্য। পড়ে রইব এই হাস্যকর, খণ্ডায়ু কালপর্বে… এই
হাসাহাসি-ঠাসা ভুঁড়িটি ভাসিয়ে…

 

লৌহ

আয়রনের চূড়ান্ত আয়রনি হচ্ছে জং-য়ের কবলে পড়া। লৌহ- এই যে কট্টর-কঠিন, অটল-অনমনীয়
এক ধাতব অহংকার, কী পরিহাস, তাকেও যেতে হয় অপ্রীতিকর অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে। বস্তুত
লোহার স্বৈর রাজনীতিই তাকে জড়িয়ে ফেলে পরিপার্শ্ব্ব আর আবহাওয়ার সঙ্গে তীব্র
ক্রিয়াবিক্রিয়ায়। পরিণামে যা হবার তা-ই… লৌহ ঘিরে জমে ওঠে বিচিত্র ব্যাসকূট। জং
ধরে। লোহা হয়ে পড়ে মরিচাজর্জর।

এভাবেই, দেশে দেশে, যুগে যুগে জং ধরে যত লৌহমানবে। ঝুরঝুর ঝরে যায় তারা…

 

প্রপঞ্চ

জীব তার এককোষী দশা থেকে যাত্রা শুরু করে যে দীর্ঘ ও জটিল প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে
বিবর্তিত হতে হতে আজকের এই মানবপ্রজাতি অব্দি এসে পৌঁছেছে, একের পর এক যেসব স্তর
ও পরম্পরা পার হয়ে আসতে হয়েছে তাকে, জানা যায়, তার পুরোটাই নাকি অভিনীত হতে থাকে
মাতৃগর্ভে। এককোষী থেকে মানবপর্যায়- পুরো প্রক্রিয়াটাই পুনরাবৃত্ত
হয় মায়ের পেটে, দশ মাসে…। অনটোলজি রিপিট্স ফাইলোলজি…
কেবল গর্ভধারিণীই টের পায় অগ্ন্যুৎপাত…
কোষে-কোষে রক্তমাংসে ওলটপালট… বিবর্তনের আগ্নেয় ঝাপটা…

 

জাতক ও জীব

জাতকের জন্য যেমন মাতৃগর্ভ, জীবের জন্য তেমনি আবহমণ্ডলে ঢাকা এই ধরিত্রী। জাতক
যেমন থাকে গর্ভের তরলে আর প্রাণরস পায় মায়ের দেহ থেকে, জীবও তেমনি ডুবে থাকে
আবহমণ্ডলের বায়বে, আর প্রাণ পায় ধরিত্রী থেকে…

 

শৈশব

ব্যক্তিমানুষের শৈশব আর সমগ্র মানবজাতির শৈশব একই রকম। শিশু যেভাবে হামাগুড়ি
পর্যায় থেকে ধীরে ধীরে দু-পায়ের ওপর ভর করে হাঁটি-হাঁটি পা-পা করে এগিয়ে যায়, পুরো
মানবপ্রজাতিও এগিয়েছে সেভাবেই। দুপায়ে ভর দিয়ে হাঁটতে শেখার পর শিশুর হাত যেমন
চলাফেরার কাজে লাগা থেকে মুক্তি পায়, হাতের যা-যা কাজ তা করতে শেখে এবং করতে করতে
বেড়ে ওঠে, পুরো মানবজাতিও বেড়ে উঠেছে সেভাবেই।

 

ভাষা, চিন্তা, স্বপ্ন, সৃজন…

শিশু যেভাবে ভাষা শেখে, তারপর ভাষার সুবাদে শেখে চিন্তা করতে, আবার যেভাবে চিন্তার
বদৌলতে শেখে স্বপ্ন দেখতে ও সৃজন করতে, আর চিন্তা ও সৃজন করতে করতে আর স্বপ্ন
দেখতে দেখতে যেভাবে সে মানুষ হয়ে উঠে, শিশু মনুষ্যপ্রজাতিও তেমন করেই ধীরে ধীরে
মানুষ হয়ে উঠেছিল।

কিমাশ্চর্য এই প্রপঞ্চ, এইসব রহস্যরূপক!

 

Facebook Comments

3 Comments

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top