অংকুর সাহা
১১ ডিসেম্বর ২০০৬
প্রত্যূষে আমার ঘরে অজস্র রাশিতে ঝরে
অঘ্রানের মেঘবৃষ্টিমালা–
কন্যারে ছাড়িয়া স্কুলে পর্জন্য ধারায় দুলে
কর্মস্থলে গমনের পালা।
আপিসে চেয়ারে বসি আন্তর্জালেতে পশি
আচম্বিতে দুঃসংবাদ আসে-
অকালে ডাকিল বান বিনয়ের তিরোধান
শিমুলপুরে নিজস্ব আবাসে।
এ দুঃখ কোথায় রাখি? শোকগাথা গায় পাখি
চরাচরে বিষণ্ণতা ছায়–
কাব্যে ও গণিতশাস্ত্রে দিবসে এবং রাত্রে
ক্রমাগত অশ্রু ঝরে যায়।
ঠাকুরনগর গ্রাম কবিদের তীর্থস্থান
বিনোদিনীধাম ভদ্রাসন–
বিদ্যুৎ ছিল না ঘরে আসবাবে জীর্ণতা ভরে
সরু খাট বেঞ্চির মতন।
সূর্য দেন আলো ঢেলে মেঘ সে তো দুষ্টু ছেলে
বৃষ্টি ঝরে ছন্দের আবেগে–
মস্তিষ্কে পয়ার হাঁটে রহস্যের খেয়াঘাটে
সৌন্দর্যের গায়ে গায়ে লেগে।
আত্মীয়স্বজন বিনে দিন কাটে ঘাসে তৃণে
দেখাশোনা করে বিশ্বেশ্বর–
তার পত্নী রাঁধে বাড়ে খেতে দেয় দ্বিপ্রহরে
প্রতিবেশী সুহৃৎপ্রবর।
কবিযশোপ্রার্থিগণে পদ্য লেখে ক্ষণে ক্ষণে
প্রস্তুত করেন প্রকাশনা–
অলীক কুকাব্য রঙ্গে গঙ্গা ও পদ্মার বঙ্গে
মজে লোকে, বিনয় উন্মনা।
মানুষ রয়েছে গর্তে বৈষয়িক বন্দোবস্তে
কুলঙ্গিতে কবীন্দ্র ঠাকুর–
বিটবংশে সিদ্ধবাক অ্যালেন ও কেরুয়াক
র্যাপ গানে টুপাক শাকুর।
মৃত্যু, জরা এক বৃত্ত পৃথিবীর মানচিত্র
তুমি বাগ্দেবীর অংশভাক–
সাহিত্যতত্ত্বের জ্ঞানে কলম্বিয়া বিদ্যাস্থানে
চক্রবর্তী হলেন স্পিভাক।
মানব জীবন শেষে স্তব্ধ মোহনায় মেশে
আনন্দ বিধুর শান্তিজল–
অন্তহীন স্বর্গবাস অংকুর দাসানুদাস
সঙ্গে করে বিনয়মঙ্গল।
১১ ডিসেম্বর ২০০৭
কবিতার সঙ্গদোষে বৃক্ষের অরালে বসে
স্বেচ্ছানির্বাসিত প্রতিভাকে;
আমরা তাঁর লেখা পড়ি দূর থেকে শ্রদ্ধা করি
অন্যান্য কাজের ফাঁকে ফাঁকে।
ছন্দ ছাড়া তুমি নিঃস্ব জীবনানন্দের শিষ্য
দলবৃত্তে জীবনযাপন;
রহস্য একান্ত সঙ্গী কামনা, ভুরুর ভঙ্গি
শব্দে অমরত্বের স্থাপন।
ধরিত্রীর যত বিত্ত বুদ্ধিজীবীদের চিত্ত
তার চেয়ে যৎকিঞ্চিৎ ভারী;
কবিতা তোমার পাশে একান্তে দাঁড়ায়, হাসে
বিমোহিত, স্বপ্নে দেখা নারী।
তিনশো পঁয়ষট্টি দিন পৃথিবী বিনয়হীন
কোথাও ভ্রূক্ষেপ নেই কারো;
শম্বুক ট্রাফিক ধায় পুলিস উৎকোচ খায়
সরকারি গুণ্ডা বলে, ‘মারো’।
আমরা যে প্রাণ পাব স্নান সেরে ভাত খাবো
ডাল, ঝিঙে পোস্ত সহযোগে;
শিল্পীরা পোর্ট্রেট আঁকে কে কার খবর রাখে?
দেশ যদি চলে যায় ভোগে।
শহরে দূষিত হাওয়া ভিখিরি, অনাথে ছাওয়া
রাইটার্স বিল্ডিঙে শাক্যমুনি;
মন্ত্রীরা বিলাসে থাকে গাড়ি চড়ে, টাক ঢাকে
পথে পথে ড্রাগ-ডিলার, খুনি।
চাষীদের অভিযোগ জমি ছাড়ো, শিল্পোদ্যোগ
ধান নয়, গাছে ফলবে গাড়ি;
রতন টাটার পুণ্যে সুখ ঝরবে মহাশূন্যে
দুধে-ভাতে থৈ থৈ ঘরবাড়ি।
বন্ধুরা সকলে সুখী লক্ষ্মীবাণী মুখোমুখি
অভ্রংলিহ ফ্ল্যাটে থাকে তারা;
সরকারী দানছত্রে কিষান বিকাশ পত্রে
বিষয় অমৃতে আত্মহারা।
হেন জন্মভূমি ছাড়ি স্বর্গলোকে দিলা পাড়ি
হে বিনয়, মিতবাক কবি!
রাখি গেলা অভাজন পাঠক, সুহৃদগণ
আঁকি গেলা সভ্যতার ছবি।
ছন্দ গেঁথে, বীজ বুনে নিবিড় সঙ্গীত শুনে
শান্ত রবে, কাব্যের নির্মাণে;
আসিল পৌষের মাস নীরবে অংকুর দাস
নতমুখে পূর্ণচ্ছেদ টানে।
১১ ডিসেম্বর ২০০৮
একটি কবিতা আসে দ্রুতগতি, রুদ্ধশ্বাসে
মাঠে বসে নির্জনে হাঁপায়;
হিন্দু বেদ পড়ে যর্জু মুসলমানে করে ওজু
খ্রীষ্টানেরা যিশু গান গায়।
হেন ধর্মভীরু দেশে ব্রাহ্মণ, যবনে ঠেসে
কবিতা লিখেছে রাশি রাশি–
কিছু তার বৃথা লাস্য জঞ্জালের পদবাচ্য
বাকি মধ্যমেধায় বিলাসী।
চর্যাগান থেকে শুরু কবির বাঁকানো ভুরু
রহস্যে খচিত বর্ণমালা;
মেশে তাতে কাব্যরস অলংকার, পিত্ত-কষ
অন্য যত বিবর্ণ নিরালা।
ব্রহ্মদেশে জন্ম হয়ে পলায়েছ প্রাণ লয়ে
দীর্ঘযাত্রা, মৃত্যুর মিছিল;
বহু ক্লেশে বঙ্গে এসে ফরিদপুর ভালবেসে
গ্রাম বৌলতলী, খাল-বিল।
কারিগরি পাঠ্যক্রমে উজ্জ্বল মেধায়, শ্রমে
শিবপুরে বহু বিদ্যা লভি–
বুদ্ধিদীপ্ত অনুষঙ্গে ছন্দের তরঙ্গভঙ্গে
সাহিত্যে যজ্ঞের পুণ্য হবি।
পঞ্চাশের কবিদলে গন্ডুষে, সদলবলে
খালাসিটোলার দ্রাক্ষারস–
পান করে সন্ধ্যাকালে দূরে, দিকচক্রবালে
উড়ে যায় প্রকৃত সারস।
তার পিছে পক্ষীদলে বিপন্ন মরাল চলে
ঈশ্বরী, গায়ত্রী, তন্বী-শ্যামা;
উড়ে চলে নির্নিমেষে সেথা নির্বাচন শেষে
রাষ্ট্রপতি বরাক ওবামা।
মন্ত্রী যান গাড়ি চেপে শব্দের দূষণ ব্যেপে
সঙ্গে নিত্য পুলিস-সাইরেন;
পথচারী ভীতত্রস্ত জনান্তিকে শাপভ্রষ্ট
অটো রিকশা সমুদ্র সফেন।
মানসিক হাসপাতাল চিকিৎসক টালমাটাল
কবি সঞ্জীবিত, অন্যমনা;
পার্থিব সীমায় ভেসে প্রকৃতিস্থতায় হেসে
অনুভবে স্বর্গীয় দ্যোতনা।
তবু মৃত্যু নিরখিয়া কান্দে চক্ষু, কান্দে হিয়া
বিষণ্ণ সংলাপ ভাগ্যে ছিল;
সজ্ঞানে অংকুরানন্দ শোকছন্দে মৃদুমন্দ
বিনয়মঙ্গল প্রচারিল।
১১ ডিসেম্বর ২০০৯
আমাদের কবিধর্মে সৎ ও অসৎ কর্মে
ধরেছি অধরা মাধুরীকে;
সওদাগরি কারবারে মাইনে পাই শুক্রবারে
যাচ্ঞা করি প্রেমিকা ও স্ত্রীকে।
পশ্চিমের দেশজুড়ে ধনতন্ত্র হাঁটুমুড়ে
দীর্ঘস্থায়ী বিলাপে আকুল;
আইসল্যান্ডের বনে দীর্ঘস্থায়ী উদ্গীরনে
এইয়া – ফিয়াল্লা – য়োহ্কুল।
গেট্স্, জব্স্, এলিসন আমাদের গুরু হন
পুঁজিবাদে আরাধ্য দেবতা;
দিবসে প্রোগ্রাম লিখে সায়াহ্নে বিয়ার চেখে
বোকা-বাক্সে জীবন-বারতা।
বুদ্ধিজীবী মনোভাবে প্রগতিশীল স্বভাবে
পয়ার ভঙ্গীতে কথা বলে;
রোজ ভোরে পার্কে হাঁটে সন্ধেয় সাঁতার কাটে
প্রকৃত প্রস্তাবে স্বচ্ছ জলে।
চিরদুঃখী বিষণ্ণতা কিয়ের্কেগার্দের কথা
দার্শনিক বৈভবে, বিভ্রমে;
সাহিত্যের গোচারণে আত্মপক্ষ বিধুননে
দম্ভ যদি কিছুমাত্র কমে।
তিনটি বছর আগে ধরিত্রীর পুরোভাগে
ছিলে কবি, অলৌকিক আলো;
অক্ষরবৃত্তের শ্বাসে বাতাসে শুদ্ধতা ভাসে
সন্ধ্যাদীপে হৃদয় জুড়ালো।
শিহরসিঞ্চিত নারী দীপ্তদীপ, পুষ্পসারি
জ্যোৎস্নায় সহাস্য সূর্যমুখী;
ক্ষেতে গরু, শীর্ণ চাষা বাবুই – ওলটানো বাসা
ঝিনুকে রহস্যময় সুখী।
দেহ নেই, স্বপ্ন আসে নিশীথে, অঘ্রাণ মাসে
কল্পনার সমাবেশে স্থিত;
মাটির প্রদীপ জ্বলে নিভৃতে, নীলকমলে
শাশ্বত ফুলের মত স্মিত।
ধন্য বিনোদিনী কুঠি স্বভাব শিল্পিত মুঠি
স্নিগ্ধ অনুতাপে ঝিকিমিকি;
নির্বান্ধব অসন্তোষে বৃক্ষের ছায়ায় বসে
লিখে যান একাকী বাল্মীকি।
তৃণাদপি সুনীচেন কবিতার বই কেনো
বিনোদন সীমিত খরচে;
দীর্ঘ নীরবতা ভাঙ্গি কবি স্ত্রী অংকুর গাঞ্চি
বিনয় চরিতামৃত রচে।