মাসুদ খান
লং শট: বিস্তীর্ণ বালুচর। নদীর খাড়ি। বৈশাখ মাস। দুপুর বেলা। চিনা-কাউনের ক্ষেত। তাতে ছোট-ছোট হালকা-পাতলা গাছ। তাদের ওপর দিয়ে হাওয়া বয়ে যাবে মাঝে মাঝে, দমকে দমকে। কখনো কখনো ধূলির ঘূর্ণি। একটা বড় ধূলিঘূর্ণি আশপাশ অন্ধকার করে মাঠের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তের দিকে ছুটে যেতে থাকবে। একসময় ঘূর্ণিটা একটা জায়গায় দাঁড়িয়ে গিয়ে পাক খেতে খেতে আকাশের দিকে একটা লম্বা ধূলিস্তম্ভ বানিয়ে ফেলবে। ক্যামেরা জুম-ইন করতে করতে এক পর্যায়ে যখন শুধুই ধুলাবালির অন্ধকারে ফ্রেম ভরে যাবে, তখন স্টপ।
ধীরে ধীরে ধূলির অন্ধকার সরে গেলে চিনা-কাউনের ক্ষেতের মধ্যে দেখা যাবে একটা বিশালাকার বই। পাতা খোলা। রূপকথার বই। পাতাগুলো খুব পুরাতন, হলদেটে মোটা মুড়মুড়ে কাগজের। তাতে বড়-বড় রঙিন হরফে লেখা। রঙিন ইলাসট্রেশন। গল্পের শিরোনাম এক রঙের, টেক্সটের হরফগুলো আরেক রঙের। ইলাসট্রেশনের ছবিগুলো বিভিন্ন রঙের। বইটির যে পাতাটা খোলা, সেই পাতার গল্পটির শিরোনাম ‘রাখালের পিঠাগাছ’। ইলাসট্রেশনের ছবিতে দেখা যাবে একটা গাছের নীচে রাখাল ছেলে চিৎ হয়ে শুয়ে আছে। পরনে বড়সড় ঢোলা কেরোলিনের হলদে হাওয়াই শার্ট আর কালো হাফ প্যান্ট। মাথার নিচে গামছা আর তার ওপর দুহাতের আঙুলগুলো পরস্পরের মধ্যে প্রবিষ্ট করে হাতের তালুজোড়া মাথার নিচে রেখে, মাথার দু-ধারের দু-বাহুতে দুটো ত্রিভুজ তৈরি করে শুয়ে আছে। ত্রিভুজ দুটিকে ভেদ করে চলে গেছে তার ছাগল-চরানো লাঠি। চোখ দুটি বুজে আছে আরামে। পাশে লতাগুল্মময় একটি ঝোপ। দু-একটা ছাগল-ভেড়া চরছে।
কিছুক্ষণ পর ছবির ছেলেটা পিটপিট করতে করতে চোখ মেলে চাইবে। আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসবে ধীরে ধীরে। ছাগলগুলো ঘাস থেকে মুখ তুলে তাকাবে। একটা পাখি ঝরাৎ করে গাছ থেকে উড়ে বইয়ের পৃষ্ঠার বাইরে চলে যাবে। উড়তে উড়তে দূরে চলে যাবে। ক্যামেরা পাখিটাকে অনুসরণ করবে। পাখিটা বিন্দুপ্রায় হয়ে গেলে ক্যামেরা ট্র্যাকিং করে সরে এসে বইটার দিকে ফোকাস করবে।
হঠাৎ আবার দমকা হাওয়া বইবে। ফড়ফড় করে অনেকগুলো পৃষ্ঠা উল্টে গিয়ে গল্পের ওই পৃষ্ঠাটি ঢেকে যাবে। অনেক নিচে চাপা পড়ে যাবে পৃষ্ঠাটি। কিছুক্ষণের জন্য সব সুনসান। নিস্তব্ধতা।
বইয়ের পাতার মাঝখানের খানিকটা একটু উঁচু হয়ে উঠবে। একটু একটু করে চিড় ধরবে। ডিমের খোসা ভেঙে যেভাবে বাচ্চা বেরিয়ে আসে, সেইভাবে আস্তে আস্তে রাখাল ছেলেটার প্রথমে লাঠি, পরে দুহাতের আঙুল ও হাত দেখা যাবে। তারপর যেন কোনো এক প্রাচীন গহ্বর থেকে উঠে আসছে, সেইভাবে হ্যাঁচড়-প্যাঁচড় করে উঠে আসবে। উঠেই উপরের দিকে একটা লাফ দেবে। শূন্যের মধ্যেই এক পাক রিভল্ভ করবে। তারপর ঝপ করে পৃষ্ঠার ওপর দাঁড়িয়ে গা ঝাড়া দেবে। রিভল্ভ করা ও গা ঝাড়া দেবার সময় গা থেকে নানা অক্ষর, ছেঁড়া লতাপাতা, কাগজের অংশ ছিটকে পড়ে যাবে। কোনো কোনোটা বইয়ের ওপরে, কোনো কোনোটা বাইরে ক্ষেতের মধ্যে গিয়ে পড়বে। কোনো কোনো হরফ ভাঙা। ‘ঝু’ অক্ষরটা তিন জায়গায় ভেঙে ত্রিভঙ্গ হয়ে বইয়ের কিনারে এসে পড়বে। অক্ষরটার বেশ খানিকটা ভাঙা অংশ বইয়ের বাইরে ঝুলে থাকবে। ছেলেটার শার্টের পেছনের দু-এক জায়গায় ছিঁড়ে গেছে, সেখানে একটা তেলাকুচা-লতার স্পাইরাল আঁকশির কিছু অংশ আংটার মতো আটকে থাকবে। ওই আঁকশির সঙ্গে সবুজ রঙের একটা ‘ল’ অক্ষর এমনভাবে লেগে ঝুলবে যেন মনে হবে তা ওই স্পাইরাল আঁকশিটারই একটা বিস্তার।
নিজের গা থেকে আর বই-এর পাতার ওপর থেকে কয়েকটা এ ঞ ঐ ত্র এসব অক্ষর কুড়িয়ে নিয়ে ঝটপট ‘এ’-এর অতিরিক্ত প্রত্যঙ্গগুলো ভেঙে ছুঁড়ে ফেলে দিতে থাকবে। এভাবে অনেকগুলো ‘এ’ মুঠোয় জড়ো করে তাচ্ছিল্যভরে ছুড়ে দেবে ওপরের দিকে। বি ব ঝ ক ঋ ধ ধু– অক্ষরগুলোর অপ্রয়োজনীয় প্রত্যঙ্গ ছিঁড়ে ফেলে অনেকগুলো ‘ব’, আবার, ত অ আ– এগুলো থেকে অনেকগুলো ‘ত’ এবং ও ত্ত ঔ ত্তু ত্তি– এসব কুড়িয়ে নিয়ে ওগুলো থেকে অনেকগুলো ‘ও’ বানিয়ে ফেলবে। সেগুলোকে বীজ বোনার মতো করে ছিটিয়ে দেবে পৃষ্ঠার জমিনে। অক্ষরের প্রতি তার অবজ্ঞা ও অবহেলা ফুটে উঠবে। কানের সঙ্গে পেছনের দিক থেকে ‘ই’ অক্ষরটা ঝুলে ছিল। হাতড়ে হাতড়ে কান থেকে অক্ষরটা ছাড়িয়ে নিয়ে মরা ইঁদুর ফেলে দেবার মতো করে ‘ই’-কে ধরে নাক সিঁটকে বইয়ের কিনারে এসে নিচের দিকে তাকিয়ে টুপ করে ফেলে দেবে। আবার ফিরে যাবে। ‘ক’ অক্ষরটা একটু আলাদা হয়ে সেঁটে লেগে আছে পৃষ্ঠার ওপরে। ‘ক’ এর কান ধরে ওঠানোর চেষ্টা করবে। ওঠাবে। ছুঁড়েও ফেলে দেবে। খুঁজে খুঁজে একটা বিসর্গ (ঃ) পাবে। বিসর্গের দুটি বৃত্তের মধ্যে দুহাতের দুই তর্জনী ঢুকিয়ে ঘোরাতে থাকবে। পরে আংটির মতো করে পরে নেবে অনামিকায়।
এক হাতের তর্জনীতে একটা প্রশ্নবোধক চিহ্ন (?) ঘোরাতে ঘোরাতে এবং অন্য হাতে একটা বিস্ময়চিহ্ন (!) ধরে বইয়ের কিনারার দিকে এগিয়ে আসবে। প্রথমে বিস্ময়চিহ্নটাকে মাটিতে ছুঁড়ে দেবে ছোরার মতো করে। চিহ্নের নিচের দিককার বিন্দুটা মাটিতে লেগে ছুটে যাবে মার্বেলের মতো আর ছোরার ফলার মতো অংশটা গেঁথে যাবে মাটিতে। এরপর প্রশ্নবোধক চিহ্নটাকে এমনভাবে ছুঁড়ে দেবে প্রান্তরের দিকে যেন জীবন, জগৎ ও প্রকৃতির দিকে ছুঁড়ে দিচ্ছে এক অমোঘ অব্যর্থ প্রশ্ন। খুঁজতে খুঁজতে পেয়ে যাবে একটি বড়সড় ‘বৃ’। ঋ-কার ( ৃ )-টাকে ছিঁড়ে নিয়ে ছুঁড়ে দেবে বুমেরাং-এর মতো। শনশন করতে করতে চলে যাবে ফ্রেমের বাইরে, কিছুক্ষণ পর আবার ফিরে এসে ছেলেটার পাশ দিয়ে চলে যাবার সময় হাত বাড়িয়ে খপ করে ধরে ফেলবে সে।
এভাবে অক্ষর আর যতিচিহ্ন নিয়ে যথেচ্ছ খেলাশেষে একসময় রূপকাহিনীর বই থেকে ছেলেটা লাফ দিয়ে নামবে মাটিতে। নামার সময় প্যারাট্রুপারের মতো নামতে থাকবে। পরনের ঢোলা শার্টটা প্যারাশুটের মতো কাজ করবে। মাটিতে পা পড়ার সঙ্গে সঙ্গে ঊর্ধমুখী বাতাসের সঙ্গে ঝাঁৎ করে ধুলো উড়ে উঠবে প্রচুর। সেইসঙ্গে উড়বে অনেক পাতা, কিছু পাখি, খড়কুটা ও অক্ষর এবং ফড়ফড় করে কিছু পৃষ্ঠা। ইতস্তত উড়ন্ত অবস্থাতেই হঠাৎ সবকিছু ফ্রিজ হয়ে যাবে। ছেলেটি প্যান্টের ধুলা ঝেড়ে, লাঠিটা বগলে চেপে ফ্রিজ হয়ে যাওয়া সবকিছুর ভেতর দিয়ে ধীরে ধীরে হেঁটে হেঁটে চলে যাবে। পিঠে তখনও ‘হাবা’ শব্দাংশটি কাত হয়ে ঝুলে থাকবে। একটা দাড়িঅলা ছাগল মুখ তুলে হা করে ছেলেটার দিকে তাকিয়ে থাকবে। পা শুঁকতে শুঁকতে ছেলেটার সঙ্গে সঙ্গে এগিয়ে যাবে। ‘প’-অক্ষর লেগে থাকা একটা পাতা সেঁটে আছে ছেলেটার পায়ের পেছনের দিকটায়। ছাগলটা পাতাটাকে মুখে পুরে নিয়ে ‘প’ অক্ষরটা ফেলে দিয়ে মচমচ করে খেতে থাকবে। একটা খয়েরি-সাদা-মেশানো বাছুর লেজ উচিয়ে তিড়িংবিড়িং করতে করতে সাইড থেকে দৌঁড়ে এসে ফ্রেমের মধ্যে ঢুকে পড়বে। পাশ দিয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে যাবার সময় ছেলেটা খপ্ করে বাছুরের লেজ ধরে ফেলবে, তারপর ছুটন্ত সেই বাছুরের লেজ ধরে উঁচিয়ে ধরা লাঠি নাড়তে নাড়তে দু-একবার পেছনের দিকে তাকিয়ে নিয়ে খুব দ্রুত দৌড়ে দিগন্ত রেখার দিকে চলে যাবে। যেন দিগন্তপারের দিকে ছুটে-যাওয়া শেষ মেইল ট্রেনটা ধরে ফেলেছে ছেলেটি। ওই লেজ-ধরে-থাকা ধাবমান অবস্থাতেই বিন্দুপ্রায় হতে হতে একসময় অদৃশ্য হয়ে যাবে। নেপথ্যে দ্রুত লয়ে উচ্চনিনাদী মিউজিক বাজতে বাজতে থেমে যাবে। ক্যামেরা প্যান করে পুনরায় ফ্রিজ হয়ে থাকা রূপকথার খোলা বইটির ওপর এসে থামবে। জুম ইন………….
বইটার পৃষ্ঠার ছেঁড়াখোঁড়া জমিন। কিছুক্ষণ সম্পূর্ণ নীরবতা। তারপর উল্টাদিক থেকে দমকা হাওয়া এসে ফড়ফড় করে বইয়ের পাতা উল্টাতে থাকবে। ”রাখালের পিঠাগাছ” গল্পটি যে-পাতায় সেই পাতাটা খুলে যাবে। হাওয়ায় হাওয়ায় ওই পৃষ্ঠার সমস্ত অক্ষর ফুরফুর করে উড়ে উড়ে মাঠের মধ্যে ছড়িয়ে পড়বে। বইটির পৃষ্ঠাটি একদম শাদা ও ফাঁকা হয়ে যাবে।
পরবর্তী দৃশ্য
রাখাল ছেলেটি একটি হালটের ঢালে নিচে বসে ধীর গতিতে বাঁশের খালুই বুনিয়ে চলবে। হালটের পানির স্রোতের সমানত্দরালে এবং স্রোতের অভিমুখ যেদিকে, সেইদিকে মুখ করে বসে থাকবে। মৃদুমন্দ বাতাসে পাশের একটি ঝোপের পাতাগুলো নড়তে থাকবে। নেপথ্যের মিউজিকে একটি আলস্যমধুর রাখালি সুর।
ক্লোজ শটে দেখা যাবে– ছেলেটির পেছনে একটি সদ্য-বোনা নতুন খালুই। চিড়-ধরা একটি ছোট মাটির ঢেলায় ঠেস দিয়ে কোনোমতে স্থিতিশীল অবস্থায় থাকবে খালুইটা।
ছেলেটির পিঠের ওপর গাছের পাতার আলোছায়া। হালটের পানিতে দু-একটা সোনালি বাঁশপাতা ধীরে ধীরে ভেসে যাবে। একটি জলপোকা তার চার পা পানির ওপর ভাসিয়ে দিয়ে স্থির হয়ে থাকবে। স্রোত তাকে আস্তে আস্তে বয়ে নিয়ে যেতে থাকবে। থেকে থেকে সে চার পায়ে ওয়াটার স্কেটিং করতে থাকবে।
পানির স্রোত নিস্তরঙ্গ ও মন্থর। ঘুঘুর ডাকে মন্থরতা। বায়ুপ্রবাহও মৃদু ও মন্থর। খালুই বয়নকর্মও মন্থর। নেপথ্য মিউজিকের সুর সবকিছুর সঙ্গে সঙ্গতি রক্ষা করবে।
ছোট মাটির ঢেলাটির চিড় ধীরে ধীরে আরো বড় হতে থাকবে। একপর্যায়ে ঢেলাটি ভেঙে যাবে। খালুইটিকে আর ধরে রাখতে পারবে না। সেটি মিউজিকের সুরের তালে তালে গড়িয়ে হালটের পানিতে গিয়ে পড়বে। পড়ে ভেসে যেতে থাকবে। এমন সময় নেপথ্য থেকে কিশোরের সর্দিজড়িত গলা-বসা কন্ঠস্বর ভেসে আসবে (নেপথ্য মিউজিকের ভল্যুম খুব নিচু হয়ে আসবে) ঃ-
” আইলস্যা…
আইলস্যা, তোর খালোই গেল ভাইস্যা”…
কিছুক্ষণ নীরবতা। আবার, ” আইলস্যা, তোর খালোই গেল ভাইস্যা”। অলস রাখাল ছেলেটি একটু সচকিত হয়ে খালুই বয়ন থামিয়ে দিয়ে উবু হওয়া অবস্থা থেকে সটান হয়ে বসবে। বিস্ময়ের সঙ্গে ঘাড় ধীরে ঘুরিয়ে এদিক ওদিক তাকাবে। পেছনের দিকেও তাকাবার চেষ্টা করবে, তবে শরীর খুব একটা নড়বে না। একটু ভালো করে পেছনে তাকানোর ব্যাপারেও যেন তার খুব আলস্য। আশেপাশে কোথাও কাউকে দেখবে না। আবার বয়নকাজে মনোযোগ দেবে চুপচাপ, ভ্রূক্ষেপহীনভাবে। তাকিয়ে দেখবে সত্যিই খালুইটা ভেসে যাচ্ছে। যখন ওটা তার সমান্তরাল বরাবর এসে পড়বে, তখন সে বসে থেকেই তাকে ধরবার বেশ চেষ্টা করবে। অল্পের জন্য নাগাল পাবে না। বিরক্ত হয়ে হাত সরিয়ে আনবে। খালুইটা ধীর গতিতে ভেসে যেতে থাকবে। চারদিকে সুনসান নীরবতা। আবার নেপথ্য থেকে ওই একই কন্ঠস্বর ভেসে আসবে–
”আইলস্যা, তোর খালোই গেল ভাইস্যা….”
অলস ছেলেটি একটু বাঁদিকে ঘাড় ঘোরাবে। ঘুরিয়েই, ‘হুম’ জাতীয় মৃদু বিরক্তিসূচক অনুনাসিক শব্দ করে মৃদু ঝাঁকি দিয়ে ঘাড় ফিরিয়ে আনবে। একমনে খালুই বুনিয়েই চলবে। কিছুক্ষণ পর আবার– “আইলস্যা, তোর খালোই গেল ভাইস্যা।”
এবার ছেলেটি জবাবে ধীরলয়ে গুনগুন করে বলতে থাকবে–
“না যায়, না যায়, আরেকটা বানামু বইস্যা…”
না যায়, না যায়, আরেকটা বানামু বইস্যা…
না যায়, না যায় ….
আর খালুই বুনিয়েই চলবে। একসময় ঝিমানি ধরবে। ঝিমাতে ঝিমাতেই গুনগুন করতে থাকবে–
”না যায়, না যায়, আরেকটা বানামু বইস্যা…
না যায়, না যায় ….”
খালুইটি চলে যাবে ভাসতে ভাসতে। তারপর ধীরে ধীরে ডিজল্ভ হয়ে যাবে দৃশ্যটি।
ছেলেটা খালুই বুনিয়েই চলেছে। রোদ তার পিঠের ওপর তেরছাভাবে পড়ায় মুখ তুলে এক চোখ বন্ধ করে অন্য চোখ দিয়ে সূর্যের দিকে তাকাবার চেষ্টা করবে। বসে বসেই কিছুটা সরে গিয়ে গাছের ছায়ার নীচে বসার চেষ্টা করবে। পুরোপুরি ছায়া তো হবেই না। আবার নেপথ্য থেকে সেই সর্দি-লাগা গলা-বসা কিশোরকন্ঠ: ”ওই আইলস্যা, তোর খালোই তো গেছে-গা ভাইস্যা। কী করবি অহন? যা, বাড়িত গেলে-গা বাপে আর মায়ে মিল্যা তোরে দিবো ধোলাই।”
কিছুক্ষণ নীরবতা। তারপর আবার–
”ওই আইলস্যা, হোন্, হোন্, একে তো তুই হইলি রাখাল তার উপর ফের হইছস আইলস্যা রাখাল। ওই যে খ্যাত দেখতাছস-না, তুই তো হইছস ওইটার মাটি ফাইট্যা। ওই যে গরু চরাইন্যা খ্যাত (ক্যামেরা প্যান করে গোচারণমাঠের দিকে ফোকাস করবে), তুই তো জন্মাইছস ওইটার মাটি ফাইট্যা। ওই যে দ্যাখোস্ তোর বাপ, (ইনসেটে দেখা যাবে, গামছা কাঁধে একজন কৃষাণ, খুব রাগী বদ্খত চেহারা ও মেজাজের, ক্ষেতে কোদাল চালাচ্ছে) ওইটা ক’লাম তোর বাপ না। ওই যে দ্যাখোস তোর মাও (ইনসেটে দেখা যাবে, একজন মহিলা, উঠানোর মধ্যে মাটির চুলায় পিঠা তৈরি করছে) ওইটা ক’লাম তোর মাও না। তুই আসলেই জন্মাইছস মাটি ফাইট্যা।
আইলস্যা, আরে হোন্ হোন্, দুনিয়ার বড়-বড় মানুষগুলা তো সব চ্যাংড়া বয়সে রাখালই থাহে। অগো বাপ থাহে না, মাও থাহে না, ভাই থাহে না, বোন থাহে না, কাঁহা কুচ্ছু থাহে না। খালি গাঙ থাহে, খালি বালু আর বালু থাহে, গাঙপাড়ের গরু-চরাইন্যা ক্ষ্যাত থাহে, লাঠি আর গামছা থাহে, অনেক লাফাইন্যা-ঝাঁপাইন্যা বাছুর আর ভেড়া থাহে। আবার ক্ষেতের পাড়ে, ছাইতান গাছ, না হয় পাইকুড়, না হয় পিঠাহরার গাছ থাহে।”
পরবর্তী দৃশ্য
একটি বাড়ি। পড়ো-পড়ো দুটি ঘর মুখোমুখি দাঁড়ানো, মাঝখানে ছোট্ট উঠান, ঘরে ছনের ছাউনি আর পাঠখড়ির বেড়া। উঠানের এককোণে একটি মাটির উনুন। সেখানে একজন গৃহিনী হাঁড়িতে দলুই পিঠা তৈরি করছে। ঢাকনা দিয়ে বদ্ধ মাটির হাড়ি থেকে মাঝে মাঝে বাষ্প বেরুচ্ছে। পাশে একটা কুলা। কুলার উপর কয়েকটি দলুই পিঠা। রাখাল ছেলেটা অর্ধসমাপ্ত খালুই নিয়ে মাথা দোলাতে দোলাতে ফুল্লমুখে গুনগুন করতে করতে ভিটার একপাশ দিয়ে বাড়িতে উঠে আসবে। হাসি-হাসি মুখে কিছুটা আহ্লাদ-মাখা কণ্ঠে বলে উঠবে, ”মা, মা, খিদা লাগছে” বলতে বলতে উঠানে ঢুকবে। মহিলাটা ওকে দেখে একবার তেলেবেগুনে জ্বলে উঠবে। হাহাকার করতে করতে তেড়ে আসবে ওর দিকে।” ওই…ওই হারামজাদা, বাছুরগুলা কই? ছাগলগুলা? বেবাকটি তো খোঁয়াড়ে গ্যাছে গা। আর এই তোর খালোই বোনা! সারাদিনে এইটুক্কা? খাড়া, তোরে আমি এক্কেরে শ্যাষ কইরা ফালাইমু” বলতে বলতে মহিলাটা ইতস্তত লাঠি বা ঝাঁটা বা ওই ধরনের কোনো কিছু একটা খুঁজতে থাকবে। ছেলেটা ঘটনার আকস্মিকতায় রীতিমত থতমত খেয়ে দঁড়িয়ে পড়বে। তার মনে পড়বে সেই গায়েবি কিশোরকণ্ঠ–
”ওই যে, দ্যাখোস তোর মাও, ওইটা ক’লাম তোর মাও না….”
ছেলেটি হঠাৎ যেন সম্বিৎ ফিরে পাবে। সে একটু দূর দিয়ে দৌড়ে গিয়ে কুলার ওপরে রাখা দলুই পিঠা থেকে দুটো পিঠা প্যান্টের দু-পকেটে পুরে নিয়ে যেদিক থেকে এসেছিল, সেই দিকে দৌড় লাগাবে। মহিলাটি ততক্ষণে ঘরের দাওয়া থেকে একটি ঝাঁটা নিয়ে তাকে তাড়া করবে। ছেলেটা অসহায়ের মত হাহাকার করে কাঁদতে কাঁদতে বাড়ির ভিটা থেকে খাঁজকাটা ঢাল বেয়ে দ্রুত নিচে নামতে থাকবে। পেছন থেকে তবু ঝাঁটার এক ঘা পড়বেই। সঙ্গে সঙ্গে মা ছেলে দুজনেই পিছলে পড়ে ঢাল বেয়ে পিছলেই নামতে থাকবে। ধুলা উড়বে প্রচুর। ধুলায় ঢেকে যাবে মা-ছেলে। ঢালের নীচে এসে তারা পড়লে, ছেলেটা উঠে দুহাতে দুই পিঠা নিয়ে দে ছুট…। গাছপালা ও অন্যান্য ভিটাবাড়ির মধ্য দিয়ে দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে গিয়ে সেই নদীর ধারে গোচারণমাঠের মধ্যে এসে থামবে।
নদীর ধার। খাড়ি। বালুতে দুই পা মেলে ছেলেটা বিষণ্নমুখে বসে আছে। আশেপাশে দুচারটা গরু ছাগল চরছে। একটা দুধেল ছাগী পরম স্নেহে তার ঘাড়ের কাছটায় চেটে দিতে থাকবে। ছেলেটা পিঠা দুটোর দিকে তাকাবে। খুব ক্ষুধা ও পিপাসা লেগেছে তার। একটা পিঠা সে কামড়ে কামড়ে খাবে। অল্প একটুকরো ভেঙে ছাগীটাকেও খেতে দেবে। একপর্যায়ে বালুতে শুয়ে পড়ে ছাগীটার ওলানের নিচে মাথা নিয়ে হা করে থাকবে আর বাট দুটি ধরে দোহন করতে থাকবে। ফোঁটা-ফোঁটা দুধ মুখের ভেতর ঝরে পড়বে। ছেলেটা চুকচুক করে তাই খেয়ে গলা ভেজাবে। তারপর উঠে আবার দুই পা মেলে বসবে। ক্যামেরা প্যান করে ছেলেটার ওপর এসে থামবে।
ডান হাতে ধরা আধপোড়া সেই অবশিষ্ট একমাত্র পিঠাটা। ওটার দিকে ছেলেটা তাকিয়ে থাকবে একদৃষ্টিতে। চোখ দুটোর পাতা বুজে আসতে চাইবে।
ছেলেটা পিঠাহাতে ঝিমোতে থাকবে। এমন সময় সেই সর্দি-লাগা গলা-বসা গায়েবি কিশোরকণ্ঠ– ছেলেটা উৎকর্ণ হয়ে শুনবে …
”আইলস্যা, তর খালোই গ্যাছে ভাইস্যা
আইলস্যা, তর বাছুর গ্যাছে খ’ড়ে
তর ধলু পইড়ছে জ্বরে
গাঙের পাড়ে মরিচগাছ
টোক্কা দিলে সব্বোনাশ!!”
কিছুক্ষণ নীরবতা। আবার সেই গায়েবি কন্ঠ:
”তর মায়ে দিবো ধোলাই
তর বাপে করবো মলাই
যাইসনা ক’লাম বাড়ি।
শুকনা গাঙের খাড়ি
এইডাই অহন বাড়ি।
গাঙের পাড়ে মরিচগাছ
টোক্কা দিলে সব্বোনাশ!!”
কিছুক্ষণ পর আবার–
”নাইক্যা কিছুই, খালি একখান গাছ আছে
পরান অহন উইড়্যা বইবো পিঠ্ঠাহরার গাছে।”
কিছুক্ষণ নীরবতা।
তারপর ছেলেটা ওই একমাত্র পিঠাটা পকেটে পুরে নিয়ে উঠে দাঁড়াবে, কিছুদূর হেঁটে গিয়ে ক্ষেতের আলের ধারে হাত দিয়ে বেলে মাটি খুঁড়ে খুঁড়ে গর্ত করবে। কিছুক্ষণ ভাববে। তারপর পকেট থেকে ওই আধপোড়া পিঠাখানা বের করে গর্তে পুঁতে মাটি চাপা দেবে। উঠে গিয়ে নদী থেকে দুহাতের আঁজলা ভরে পানি নিয়ে আসবে। আনতে আনতে দুহাতের ফাঁক দিয়ে সব পানি প্রায় পড়েই যাবে। যেটুকু থাকবে সেটুকুই ফোঁটা-ফোঁটা করে ঢালতে থাকবে ওই পিঠা-পুঁতে-রাখা জায়গাটায়। আবার পানি আনতে যাবে।
বিস্তীর্ণ প্রান্তর। জোৎস্নারাত। চিনা-কাউনের ক্ষেত। মাটি, নদী এসব প্যান করে ক্যামেরা একপর্যায়ে থামবে। দূরে দেখা যাবে জনশূন্য, বৃক্ষশূন্য মাঠে ছেলেটা বসে আছে। জুম ইন। ছেলেটা অনেকটা পদ্মাসনের ভঙ্গিতে বসে আছে। পিঠা পুঁতে রাখা জায়গাটার মাটি পানিতে ভেজা। ছেলেটার মাথা ঘুমে ঢুলে-ঢুলে বারবার নুয়ে পড়ছে।
কিছুক্ষণ পর ছেলেটা চোখ মেলে চাইবে। দেখবে– ভেজা মাটির আস্তরে একটু একটু চিড় ধরেছে, ঠিক যেমন প্রথম দৃশ্যে রূপকথার বইটির পৃষ্ঠায় চিড় ধরেছিল। ব্যাকগ্রাউন্ডে একটি আশ্চর্যবোধক মিউজিক ধীর লয়ে বাজতে থাকবে। তারপর দেখা যাবে, একটা বড়সড় বীজের, পিঠাবীজের, অঙ্কুরোদগম হচ্ছে। দ্রুত পাতা মেলছে চারাটা। ছেলেটা বিস্ফারিত চোখে পিঠাগাছ গজানো দেখবে। এদিক-ওদিক তাকাবে। কোথাও কেউ নেই। ক্যামেরা টিল্ট-আপ হবে। প্যান করতে থাকবে। আকাশে গোল চাঁদের ওপর দিয়ে ছেঁড়াখোড়া শাদা-শাদা মেঘ ভেসে যেতে থাকবে। চাঁদ ও মেঘের লুকোচুরি খেলা।
ঝাঁকড়া একটা গাছ। পিঠাসরার গাছ। তবে একটু কেমন রুপালি-রুপালি পাতা। তাতে ঝুলতে থাকবে অনেকগুলো দলুই পিঠা। কোনো কোনোটা আধপোড়া। মিড লং শটে ঠিক স্পষ্ট হবে না। ক্যামেরা যখন জুম-ইন হতে থাকবে তখন স্পষ্ট হবে যে, পিঠাসরার গাছে সব পিঠা ধরে আছে।
পরিপার্শ্বসহ গাছটার চতুর্দিকে ক্যামেরা কিঞ্চিৎ টিল্ট-আপ অবস্থায় ট্র্যাকিং করতে থাকবে। গাছের নিচে দাঁড়িয়ে ছেলেটা পূর্ববৎ অবাক হয়ে ঊর্ধ্বমুখে তাকিয়ে থাকবে। ধীরে ধীরে ডিজল্ভ হয়ে যাবে।
রূপকথার সেই ঢাউস বইটা মাঠের মধ্যে খোলা অবস্থায় থাকবে। হঠাৎ দমকা হাওয়া এসে ফড়ফড় শব্দ করে পাতাগুলো একে একে উল্টে গিয়ে বইটা সম্পূর্ণ ঝাট করে বন্ধ হয়ে যাবে। বাঁধানো মলাটসহ। মলাটের ওপর বড় বড় হরফে বইটার নাম লেখা ”রূপকাহিনীর দেশে”। রঙিন প্রচ্ছদ। কিছুক্ষণ নীরবতা। আবার উল্টাদিক থেকে দমকা হাওয়া বইবে। বইটার মলাট ঝাট করে খুলে পাতাগুলো ফড়ফড় করে উড়ে উড়ে ফ্রিজ হয়ে যাবে।
Pingback: চিত্রনাট্যের খসড়া: ইচ্ছাপূরণের দেশে – ২ » সাহিত্য ক্যাফে