পাপড়ি রহমান
মেঘ থইথই আকাশ, পাশে হাওয়া
মেঘের ভেতর মেঘ হয়ে তার যাওয়া
থমকে যেত, চমকে যেত মৃদু
তনুর ভেতর ছাই হওয়া মন ধু ধু
কিছুই সে আর পায় না যেন খুঁজে
তৃণের পানে হাত বাড়ালেই বোঝে
সবুজ সবুজ ঘাসের ডগা যত
পলক ফেলেই দুঃখ ভারানত
এমনি করেই বইত রাত্রিদিন
একলা আঁধার ঘরে সে সঙ্গিন
ভাসিয়ে ভেলা বেহুলা তার পেয়েছিল ঘাট
জলে ভাসা পদ্ম সে যে বয়স কুড়ি আট,
‘পদ্ম তোমার স্বামীর নামটি কী?’
‘কলাপাতায় লিখেছিলাম মনেও রাখিনি’
মনে মনে ভাবি সে যে কুঞ্জবনের অলি
বাসর ফেলে চিনেছিল আঁধার যত গলি
বাঁশির মতো নাকের নিচে চতুর প্রজাপতি
মন গভীরে জেগেছিল কামনা দুর্মতি
পান থেকে চুন খসলে ঝরে খুন
চোখের ভেতর জ্বলে ওঠে নিশপিশে আগুন’
পদ্ম ভয়ে পাখির মতই কাঁপে
দূরে থেকে হুঙ্কার তার মাপে
কুঞ্চবনের মৌ-লভি সেই অলি
সংগোপনে তার কথাটি বলি
পাখির কাঁপন দেখে সে খুব হাসে
ঠাহর করে দুলছে হৃদয় ত্রাসে
এই পাখিটির নাম দিতে চাই আমি
নাম বললেই জল আসবে নামি
জলের তোড়ে ডুববে কথার ঝাঁপি
জলকথাতেই জল উঠবে কাঁপি
নামটিও তার ছিল ফুল্লফুল
ক্ষণজন্মা সুগন্ধী বকুল
বর্ষাজলেই জন্মেছিল বুঝি?
তেমন করেই দিন তারিখটা খুঁজি
বকুল সে যে সত্যি রূপে গুণে
সুরভি তার ভাসত সবার মনে
আটাশ হয়েও বকুল ছিল একা
গহিন রাতেও অলির নেইকো দেখা
গন্ধে পরে জুটেছিল অলি
পেরিয়েছিল শতেক কানাগলি
সুখে ঘুমায় পাশের ঘরের খাটে
ফুলের দিনটা দুঃখভরেই কাটে
আঁধার হলেই ছড়িয়ে নিঃশ্বাস
স্বামী ঘুমায় সুখেই বারোমাস?
ভোর না হতেই বকুল চুলার ধারে
নিষ্ঠ নারী হালুয়া সুজি নাড়ে
স্বামী যে তার যাবে অফিসমুখে
পরোটা সুজি ডিম হালুয়া চেখে
স্বামীর সাজে ঘণ্টা দুয়েক লাগে
ইটারনালের সুবাস ছোটে আগে
ম্লান তাকিয়ে থাকে বকুলফুল
ডেকে কাছে ছুঁইত যদি চুল
কিন্তু বালি পড়ে আশার গুড়ে
বাসায় থেকেও স্বামীর মনটা দূরে
ধোপদুরস্ত শার্ট পাতলুন পরে
ছোটেন তিনি বাংলা মোটর মোড়ে
ভালোবেসে বকুল দাঁড়ায় গেটে
‘ফেলে কিছু যাচ্ছ কি না ছুটে’
তাকায় স্বামী রাগী নয়ন তার
‘ধুত্তরি ছাই ভাল্লাগে না আর’
ম্লান হয়ে যায় হঠাৎ করেই বকুল ফুলের মুখ
পালিয়ে গিয়ে কষ্ট লুকায় সিক্ত লাগে চোখ
বিজি স্বামী ইজি হয়েই অফিস পানে ধায়
বকুল ভাবে, ‘স্বামী যদি একটু ফিরে চায়’
আতর-চন্দন মেখে স্বামী অফিসে যায় রোজ
বকুল কেন শুকিয়ে মরে কে রাখে সে খোঁজ?
দিনের পিঠে রাত নেমে তার দিন-রাত্তির কাটে
সাঁঝের আগেই স্বামীপ্রবর নিত্য ফেরে বাটে।
বকুল বলে, ‘গরম বেজায়, ঘেমে গেছ দেখি
ঠান্ডা জলে লেবু-চিনি গুলে দেবো নাকি?
খেঁকিয়ে ওঠে বকুলফুলের সদাকর্মী স্বামী
‘এত কেন কানের কাছে ঘ্যানঘ্যানাচ্ছ তুমি?’
জল জমে যায় চোখের ছোট্ট কোণে
অবহেলার রূঢ় বেদন বকুল ফুলটা জানে
রাত ঘনালেই ঝিঁঝিঁ বিশ্রী ডাকে
বকুল ভাবে, এরোসলে থামিয়ে দেবে তাকে
রাত্রি মানে আদর-সোহাগ-প্রেম
রাতের ভেতর লুকিয়ে থাকে নিকষিত হেম
রাতে পাখি মেলে আঁখি প্রেমের মদিনা
বকুল জানে স্বামীর কাছে যাওয়া তার মানা
নিশি রাতে না ঘুমালে জীবনটা অচল
সকার সকাল কাজে গেলে চলবে জীবন কল
বকুল ভাবে, ‘এমন আঁধার রাত কেন যে আসে?
বিষ্টি জলে হাওয়া খেলে, কামিনী ঘ্রাণ ভাসে
মাঝরাত্রে ব্যালকনিতে বিড়ালছানা কাঁদে
দরজা হাট করে বকুল উঠে পড়ে ছাদে
বিশাল আকাশ মাথার ওপর তারায় মাখামাখি
জোছনাধোয়া হাওয়া ভাসে বাঁধতে হাতে রাখি
রাত্রি বুঝি গেছে নিভে হাজার বছর আগে!
এই শহরের মানুষ বুঝি ঘুমিয়ে থেকেও জাগে!
জোছনা ভেঙে উল্কা ছুটে ধায় বুঝি-বা পুবে
ধোয়া ধোয়া আকাশ বলে ভোর এক্ষুনি হবে।
ফের হালুয়া ভাজির সাথে পরোটা-রুটি ডিম
ভোরের দ্বারে ডেকে ওঠে একটি পাখি ‘নিম’!
সূর্য মেখে, জলের চোখে বকুল নেমে আসে
শাশুড়ি কয়, ‘দেরি কেন, সময় কি আর আছে?
অফিস যাবে ছেলে আমার দ্রুত
গরজ তোমার দেখছি না যে অত!’
‘ভাববেন না চায়ের পানি চড়িয়ে দিলাম বলে
আটার সাথে লবণ মেখে খামির করাও চলে’
এমন সময় স্বামী ডাকেন রেগে
‘কোথায় থাকো? জামা-কাপড় দিচ্ছ না কেন্ আগে?’
‘এই দিচ্ছি এক্ষুনি নাও ভুল হবে না আর’
বকুল হাঁটে অকূল পথে বড্ড তাড়া তার।
ফের সে দাঁড়ায় ঘরের কোণটি ঘেঁষে
যাবার সময় স্বামী যদি ডাকে ভালোবেসে।
কিংবা ঈষৎ আলিঙ্গনে বাঁধেন যদি তাকে
চুমকুড়িতে ভিজিয়ে দিয়ে বুকের মাঝেই রাখে
কোথায় কী? বাংলা মোটর হয়ত দূরে ভারি
রুজির টানে না বেরোলে চড়বে নাকি হাঁড়ি!
নিত্য কেন বকুল ফুলের রাতটি ঘুরে আসে
হাওয়া এবং জলের ভেতর কামিনী ঘ্রাণ ভাসে।
জোনাক পোকা উড়ে এসে মিটমিটিয়ে দেখে
রাতের ভেতর বকুল ফুলটি আলোক হতে শেখে
জবাকুসুম তেলের শিশি উপুড় করে ঢেলে
বেণি বেঁধে, কাজল চোখে দুষ্টুমি তার খেলে
আজকে এলে জানতে চাবো কেমনে করে অন্যঘর
সবকিছুতেই নিয়ম চলে আমিই কেবল পর?
করুক শতেক ধুনফুন আর যতেক বাহানা
আজকে চাঁদের গ্রহণ নেবই হোক যত সেয়ানা
জবাকুসুম রাতের ডানায় কাজল টানা আঁখি
আজকে দেখি কেমনে পারে আমায় দিতে ফাঁকি’
এলোখোঁপায় সাজায় বকুল বেলিফুলের কুঁড়ি
রিনিঝিনি বাজে মৃদু করকমলের চূড়ি
মেঘ সরিয়ে চাঁদনি হাসে আঁধারটা হয় ফিকে
স্বামী হঠাৎ আড়নজরে বকুল ফুলকে দেখে
‘রংতামাশায় বেশ তো আছো আনছি আমি কড়ি
ভাত গিলছো দিনরাত্তির হস্তী হতে দেরি।’
আঁধারটুকু পিছলে পড়ে নিভিয়ে দিয়ে আলো,
বকুল তবু হাল ছাড়ে না, মিষ্টি করে বলো,
‘চুপ কর হে, মিষ্টি কীসের?’ খেঁকিয়ে ওঠে স্বামী
‘তোমার কথায় মজতে হবে কী পেয়েছ তুমি?
যাও তো এখন ঘুমাতে দাও বিরক্ত না করে
জানই তো কাল অফিসমুখী ছুটতে হবে ভোরে।
রাত্রি বুঝি নিভেই গেছে হাজার বছর আগে
এই শহরের মানুষরা সব ঘুমিয়ে থেকেও জাগে।
জোছনা ভেঙে উল্কা ছুটে ধায় বুঝি-বা পুবে
ধোয়া ধোয়া আকাশ বলে এক্ষুনি ভোর হবে
চাঁদের গায়ে চাঁদ লাগে না কেমনতর প্রাণ
শীতল মাটির তলায় বুঝি অন্য কোনো স্থান?
সাপের বিষে দেহভাণ্ড পুড়ে যে হয় ছাই
অবাক হয়ে ভাবছে বকুল, ‘কোথাও দেখি নাই!’
আজব কথা! থেকেও স্বামী নাই যেন তার ঘরে
বিধবা রূপ ভাগ্যহারা গুমরে কেঁদে মরে।
ফুঁসে উঠল বকুল যেন হঠাৎ নাগিনী
চক্ষু জ্বলে চিতার মতো হিংস্র বাঘিনী
নিদ্রা ভেঙে তুললে ঠেলে চমকে ওঠে স্বামী
বোবাদাসী এতদিনে সবাক হলে তুমি!
‘কী হয়েছে রাত দুপুরে এমন নাটক কেন?’
‘বউয়ের থেকে দূরে থাকো বিয়ে-প্রথা মানো?’
‘তোমায় কেন বলতে হবে কী মানি না মানি?’
ভাত পাচ্ছো, কাপড় পাচ্ছো্- এরপরও দাবড়ানি?
রাত দুপুরে ঘুম ভাঙিয়ে যা যা বলতে চাও
আমি সেটা ভালোই জানি ঘুমাতে এখন দাও’
বকুল এবার অভিমানে টলমলিয়ে ওঠে
চাঁদের গাঁয়ে চাঁদের পরশ কেমন করে লুটে?
পরের ভোরে সেজেগুঁজে অফিস যাবার কালে
সুগন্ধিটা হাতে নিয়ে খালি করে ঢালে
হঠাৎ স্বামী বকুলফুলকে ছুঁচোর মতো দেখে
বোবাপাখির বোল ফুটেছে কথাও গেছে বেঁকে!
‘শোনো বকুল, কী হয়েছে? বলো দেখি আমায়?
নিজেই নিজের বীর্য ঢালি বলি না তো তোমায়।’
কথা শুনে গোলকধাঁধায় হারিয়ে ফেলে ভাষা,
‘কী করে হয় এমন কাণ্ড, কেন এ তামাশা!
আমি থাকতে মাস্টারবেট করছে কেন স্বামী?
তবে কি আমি মরানদী? জানেন অন্তর্যামী!
ধাঁধার পাকেচক্রে পড়েও রান্নাবাড়া করে
যত্ন করে গেলাশেতে জলও রাখে ভরে।
কী শুনছি? অক্ষম নয় বকুলফুলের স্বামী!
ভিনশয্যায় ঘুমায় কেন লুকিয়ে মর্দামি?
হয়ত হবে কুম্ভকর্ণ ঘুমায় পড়ে পড়ে
যখন তখন বাঁদী ভেবে নির্যাতনও করে।
দাঁত খেঁচিয়ে মুখ বাঁকিয়ে ঝাড়ে শত গালি
ফুল ফোটে না যেই বাগানে বকুল তারই মালি!
হঠাৎ বকুল সজাগ হয়ে চক্ষু খুলে রাখে
হাঁটুর নিচে স্পষ্ট একটা দাগ ফুটেছে দেখে।
গলার নিচে ফুঠে আছে কার কামড়ের চিন?
হাতের পিঠে লালচে আঁচড়! ভেসে গেছে মীন?
কুঞ্জবনে মগ্ন আছে মধুর লোভে অলি
উরুর ভাঁজে যখন তখন খুঁজছে কানাগলি
যোনির ক্ষেতে একা একা ঠেলছে লাঙল ফলা
হরহামেশাই শিখছে বুঝি চাষাবাদের কলা?
ধরে ফেলে বকুল তাকে কৌতূহলের চোটে
ধরা খেয়ে স্বামীপ্রবর জোরসে হেঁকে ওঠে
‘খানকিমাগী, চুতমারানি, বেশ্যামাগির ঝি
আমার হাউস আমি মেটাই সমস্যা তোর কী?
থাকবি থাক না ইচ্ছে হলে অন্য ঘরে পড়ে
নইলে জানিস যেকোনোদিন দাঁত ভাঙবো চড়ে।’
গোখরা হঠাৎ তেতে ওঠে তোলে ভীষণ ফণা
বিষভাণ্ড কোথায় সেটা খুবই আছে জানা
চেপে ধরে হঠাৎ করে অণ্ডকোষের বিচি
বিড়ালছানা ঘরের ভিতর মারল একটা হাঁচি
পায়ের নিচে এক লহমায় ঠেসে ধরা মাথা
না বলি আর দুঃখ নিয়ে বকুল ফুলের কথা।
কষ্টে তাহার চোখের ভেতর নামে অন্ধকার
দিনের সুরুয, রাতের চন্দ্র সব যে একাকার।
পিঁপড়ে যেন পিষতে থাকে স্বামী পায়ের নিচে
ধর্মমতে ওখানে কি বেহেশত তার আছে?
কোথায় বেহেশত? চারিদিকে শুধু অন্ধকার
মনে মনে বকুল মাপে বেহেশতের আকার।
‘বেশ্যামাগি, খানকিমাগি, এত সাহস তোর!
অণ্ডকোষটা গলে গেলে কোথায় পাবো জোর?
সর্ষে ফুলের গন্ধ বুঝি ঢুকে পড়ল নাকে!
ছেলেবেলার ধলেশ্বরী ডাকছে বুঝি তাকে
জলের ভেতর ঘাঁই মারছে ডানকিনা আর চেলা
মাছের খেলা দেখতে দেখতে কেটে যেত বেলা
সজনে ডালে ফুল হেসেছে সাদারঙের থোকা
টাপটুপানি লোহার কাঠি কে দিচ্ছে রে টোকা?
সবুজ ঘাসে সজনে ফুলে সাদারঙের ঘোর
সর্ষে ক্ষেতের হলুদ শোভা মনে পড়ছে তোর?
চোখ না মেলেই বকুল কেন এসব দৃশ্য দেখে?
স্রোতের টানেই যায় সে ভেসে ধলেশ্বরীর বাঁকে
কোথায় যাচ্ছে কেন যাচ্ছে জানে না সে আর
পাতার পরে পাতা জমে ফুটছে রংবাহার?
বকুল ফুলের কাহিনিটা আর এখন না বলি
ঝাঁপির ভেতর সকল কথা আজকে বরং তুলি
কোনো পাঠক তবু যদি শুনতে কিছু চান
যখন তখন বকুল ফুলের গন্ধ করুন পান
সন্ধ্যাফুলে গল্প বুনে বলব কথা অতি
পাতাবাহার অন্ধকারের এইখানে আজ যতি…
সম্পূর্ণ কাল্পনিক কাহিনি
রচনাকাল : ২২.৭.২০১১