নান্নু মাহবুব
২০ জুলাই দুপুরে দূরের হাইওয়েতে বেরিয়েছি। চারদিকে হুমায়ূনহীন একটা পৃথিবী। ঘন, গভীর, ভেজা, উজ্জ্বল, সবুজ। মাঝে মাঝেই আকাশ ভরে যাচ্ছে মেঘে। পান্নাসবুজ পৃথিবীর ওপরে নেমে আসছে ঝরঝরিয়ে বর্ষা। ধানের চারার সবুজ সমুদ্রে একটা হলুদ প্রজাপতি নাচতে নাচতে আড়ালে চলে গেলো। পরমুহূর্তেই দেখা দিলো আরেকটা ফুটি ফুটি ধূসর প্রজাপতি। আমাদের গাড়ির বনেটের ওপর পড়ে আছে বৃষ্টিলাঞ্ছিত একটা হলুদ বাবলার ফুল। মাঝে মাঝেই শ্লেটের মতো ঘন মেঘ সরে গিয়ে আকাশজুড়ে ভরে যাচ্ছে নরম তুলোর মতো রেশমশাদা ধবধবে মেঘ। তার ফাঁকে ফাঁকে সীমাহীন নীল নীল আকাশ। নরম ধারালো রুপালি ইস্পাতের মতো রোদে আবার ভরে উঠছে পৃথিবী। এই পৃথিবীতে হুমায়ূন নেই। না-দেখা একটা ছায়া জল-স্থল-সবুজের ওপর বিরাট একটা ছায়া ফেলে আছে। অন্য কোনও দিন এরকম নয়।
সকালে পৌলোমী বলেছে, ‘বাবা, হুমায়ূন আহমেদ কাল মারা গেছেন।’ পৌলোমী আমার মেয়ে। ও বড় হয়েছে হুমায়ূন পড়ে পড়ে। ইদানীং সে-ও তাঁকে নিয়ে আর কিছু বলতো না। কালচার কেমন শেকড় হয়ে তাকেও আচ্ছন্ন করে নিয়েছে!
৯০/৯১ সাল। যশোর ইন্সটিটিউটের বইমেলা শুরু হয়েছে। হুমায়ূন অতিথি হয়ে এসেছেন। তখনও তিনি জনগণের সম্পত্তিতে পরিণত হননি। দুপুরে লিটন বললো, ‘চলেন, হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে আসি।’ আমরা দু’জন রিকসা করে সার্কিট হাউসে গেলাম। সার্কিট হাউসের একতলার একটা রুমে জানালা দিয়ে ভেতরে তাকিয়ে দেখি হুমায়ূন ঘুমুচ্ছেন একটা খাটে। অবিকল গর্ভের ভেতর শুয়ে-থাকা ভ্রূণের মতো। টেবিলের ওপর প্লেট দিয়ে ঢাকা একটা পানিভর্তি কাচের জগ। একটা গ্লাস। একটা সোনালি বেনসনের প্যাকেট। দরোজায় নক করতেই তিনি উঠে দরোজা খুলে দিয়ে বাথরুমে ঢুকে গেলেন। একটু পরেই আবার বেরিয়ে এলেন। নিঃশব্দে রেডি হয়ে টেবিল থেকে সিগারেটের প্যাকেট আর ম্যাচটা উঠিয়ে নিয়ে আমাদের সাথে বেরিয়ে এলেন।
মেঘের মতো হালকা, ভরহীন এই মানুষটাই শঙ্খনীল কারাগারের সেই হুমায়ূন। সেই নন্দিত নরকের লেখক। দস্যু বনহুর, দস্যু বাহরাম, কুয়াশা, মাসুদ রানা, টেনিদা, ঘনাদা, পরশুরাম, শিব্রাম, রবীন্দ্রনাথ, মানিক, তারাশঙ্কর, বিমল মিত্র, শংকর, সুনীল, শ্যামল, ইকথিয়ান্ডর, চেখভ, টলস্টয়, ইস্পাত, গোর্কি, মোপাসাকে অদৃশ্য করে তিনি আমাদের একটা নতুন, অতিজীবিত, অতিচেনা অথচ চিরঅচেনা স্বপ্নের দুনিয়ায় নিয়ে এসেছেন। যেখানে স্বপ্নগুলি হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখা যায়। যার গহিন জ্যোৎস্নায় অবগাহনের কাল কিছুতেই, কখনোই শেষ হবার নয়।
ইন্সটিটিউটের গেটে নেমে হাঁটতে হাঁটতে আমি তাঁর সাথে প্রথম কথা বলি, ‘স্যার, যশোর কেমন লাগছে?’ ‘যশোর আবার কেমন লাগবে?’ একটু রেগে গিয়ে তিনি ত্বরিত উত্তর দিলেন। তিনি কথা বলেন তাৎক্ষণিক, একটু নেত্রকোনার আঞ্চলিক টানে, কোনো ভান করেন না, বলার আগে কিছুই ভেবে নেন না। ক্রোধ আমাকে চেপে ধরলো, আমি বললাম, ‘শুনুন, আমি একবার দু’মাস ফরিদপুরে ছিলাম। প্রত্যেকদিন বিকেলে ওই শহরের পাবলিক লাইব্রেরির দিকে হাঁটতে যেতাম। মাঠে একটা বাছুর চরতো আর একফালি রোদ এসে পড়তো। পৃথিবীর কোনো দেশের, কোনো শহরের রোদ ওই রোদের মতো নয়। ওই রোদের রঙ আলাদা, ওই রোদের গন্ধ আলাদা, ওই রোদের রূপ আলাদা। যশোরের সাথেও অন্য কোনো শহর মিলবে না।’ হঠাৎ তিনি বন্ধু হয়ে গেলেন। হঠাৎ ফিরে-পাওয়া হাজার বছরের পুরোনো বন্ধুর মতো।
ইন্সটিটিউটের দোতলায় বসে তিনি ক্লান্তিহীন অটোগ্রাফ দিতে লাগলেন। সমান যত্নে, সমান অক্ষরে তিনি প্রত্যেককে ফাউন্টেন পেনের কালিতে তাঁর নিজের নামটি লিখে দিতে লাগলেন। আমি তাঁর সিগারেট ধ্বংস করতে করতে তাঁকে দেখতে লাগলাম। তাঁর শার্টে সীমাহীন সভ্যতা। তাঁর চপ্পলে অশেষ মসৃণতা। তিনি বর্ষার চাঁদের মতো। সারাক্ষণ তাঁর মস্তিষ্ক তাঁর চতুষ্পার্শ নিয়ে কল্পনার মায়াজাল বুনতে থাকে। তাঁর চারপাশে ঝলমলে অদ্ভুত সব মায়াবী জ্যোৎস্নার মতো গল্প জন্ম নিতে থাকে। তাঁর পাশে বসে থাকলে একটা অদ্ভুত তরঙ্গ টের পাওয়া যায়। তরঙ্গটা তাঁর নিজস্ব। নিরন্তর, স্বচ্ছ, ইলেক্ট্রিসিটির মতো একটা ইনটেলিজেন্ট বিকিরণ। তিনি কি সেটা জানতেন?
আমি তাঁকে একটা বই আমাকে দিতে বললাম। তিনি জানতে চাইলেন তাঁর নি পড়েছি কিনা। আমি বললাম, ‘না।’ তিনি সময় প্রকাশনের ফরিদ আহমেদকে একখণ্ড নি আনতে বললেন। বইটা এলে তিনি সেটা আমার দিকে এগিয়ে দিলেন। আমি সেটা ফিরিয়ে দিয়ে তাতে কিছু লিখে দিতে বললাম। মুক্তোর মতো গুটি গুটি অক্ষরে তিনি লিখলেন, নান্নু, তোমার সাথে গল্প করতে আমার সবসময়ই খুব ভালো লাগে। হুমায়ূন আহমেদ। আমার এতো ভালো লাগলো যে চিরকালের মতো আমি তাঁর বলয়ে বন্দী হয়ে গেলাম। এতো সহজে তিনি এতো ভালোবাসতে পারেন!
তাঁর কাছে শুধু আমার একটামাত্র প্রশ্ন জিজ্ঞেস করার ছিলো। আমি তাঁকে বললাম, ‘আপনার কি মনে হয় অলৌকিক বলে কিছু আছে?’ তিনি সঙ্গে সঙ্গে বললেন, ‘না।’
সেইসময় পুতুল নামের একটা বাচ্চা মেয়েকে জড়িয়ে তারকালোকে তাঁর নামে আবোলতাবোল লেখা হচ্ছিলো। আমি বললাম, ‘ব্যাপারটা কী বলুন তো।’ তিনি বললেন, ‘মেয়েটার বাবা নিজেই লোকজনকে দিয়ে এইসব লেখাচ্ছে।’ আমার একটু অবাক লাগলো। তখন তিনি সেলেব্রিটি হতেও শুরু করেছেন। হঠাৎ তাঁর ভেতরে উথালপাথাল জ্যোৎস্নাভরা একটা প্রেমিক তরুণকেও একঝলক দেখতে পেয়ে আমার খুব অদ্ভুত লাগলো। খুব কাছ থেকে না দেখলে সেটা কখনোও দেখা হতো না। সেটা নিয়ে আমি তাঁকে ঠাট্টা করলাম। তিনিও অকপটে ঠাট্টা করে উত্তর দিলেন, যেন অন্য কাউকে ঠাট্টা করছেন!
আমি বললাম, ‘আপনি দুই লাইনে একটা ক্যারেকটার এঁকে ফেলতে পারেন।’ তিনি সাথে সাথে বললেন, ‘হ্যাঁ, এই জিনিসটা আমি পারি।’
তিনি বললেন, ‘ক্যান্টনমেন্টের রাস্তায় আমাদের গাড়িটা আটকে দিলো। ঢুকতে দেবে না। আমি বললাম, তোমরাই বাংলাদেশের দুইজন রাষ্ট্রপতিকে হত্যা করেছো। তোমরা জনগণকে কেন আটকাও?’ আমি অস্বস্তি নিয়ে বললাম, ‘আপনি তো এইভাবে কথা বলেন না। বললেন কীভাবে?’ হুমায়ূন বললেন, ‘সাথে আমার মেয়েরা ছিলো তো, সেইজন্যেই বোধহয় বলে ফেলেছি!’
আমি বললাম, ‘আপনি গৌরিপুর জংশন-এর মতো উপন্যাস আরো লেখেন না কেন? এটা তো দুর্দান্ত! যারা ভাবে আপনি সব শ্রেণীকে নিয়ে লিখতে পারেন না তারা তাদের ভুলটা বুঝতে পারতো।’ তিনি বললেন, ‘এইগুলো লোকজন পড়তে চায় না।’
কিছু বামতাড়িত বুদ্ধিজীবী লেখক তাঁকে বুঝতে পারতেন না। নিত্য তাঁরা তাঁকে সরবে-নীরবে বিক্ষত করেছেন। তাঁরা কিছুতেই বুঝতে পারেন না সৌন্দর্যটাই শিল্পকলার প্রাণ, আর কিছু নয়।
আমি বললাম, ‘বাংলাদেশের ঈদসংখ্যাগুলো পশ্চিমবাংলার উপন্যাস ছাপার জন্যে মরিয়া হয়ে থাকে। শারদীয় দেশ কেন আপনার উপন্যাস ছাপে না?’ হুমায়ূন চুপ করে রইলেন।
দু’বছর পর আবার তিনি বইমেলায় এলেন। আবার তাঁর সাথে দেখা হলো। আবার হাজার বছরের পুরোনো বন্ধুর মতো তিনি কথা বললেন। গল্প করলেন। হুমায়ূন তাঁর ছোট বোনকে ডাকলেন। গুলতেকিনকে ডাকলেন। আমার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন। গুলতেকিনের কোলে কাগজের ঠোঙার মতো মাথাওলা শিশুপুত্র নুহাশ। আমি নুহাশকে কোলে নিতে গেলাম। নুহাশ বিরক্তমুখে মুখ ফিরিয়ে নিলো। গুলতেকিনকে সদ্য-জননীর মতো বিধ্বস্ত দেখাচ্ছিলো। হুমায়ূনের ছোট বোন খুব আপন আর মিষ্টি করে আমার সাথে কথা বললেন।
তারপর বিশ বছর চলে গেছে। হুমায়ূনের সাথে আর কখনো দেখা হলো না।
হুমায়ূন বর্ষার চাঁদের চেয়েও সুন্দর। চাঁদের শুধু একদিকটা দেখা যায়। হুমায়ূনের সবটাই প্রকাশ্য, দীপ্য।
I have read an unique article just right now written by Nannu Mahbub.
খুব ভালো লাগল ।ধন্যবাদ