মাজুল হাসান
কোনো এক জায়গায় আব্দুল মান্নান সৈয়দ বলেছিলেন: আধুনিকতা নয়; পশ্চিমবঙ্গের দাদাবাবুরা আমাদের এপারেরর গল্পে সাপ-ব্যাঙ-কুঁচে দেখতে চান। জানি না কোন খেদ থেকে এসব বলেছিলেন মান্নান সৈয়দ তবে একথা নিশ্চিত তার অনেক গল্পই পূর্ববঙ্গের সেই গদবাঁধা বুনো, আদিমতা ও লতা-পাতা ভরা (আনস্মার্ট! গেঁয়ো) বর্ণনার ধার ধারেনি। যদিও সেখানে হলুদ পাখি আছে, বউ-কথা কও আছে, ডোবার মতো পুকুর আছে; কিন্তু তার ভেতরের চালিকাশক্তি এক সচেতন ও ব্যক্তিস্বাতন্ত্রতাবাদী সত্তা। যে মানুষকে পর্বতের মতো অহংকারী করে, জলের মতো আকার-আকৃতি নির্বিশেষ করে, নিজের জালে আটকাপড়া মাকড়শার মতো দুঃসময়ে কামড়ে খেতে বাধ্য করে নিজেরই পা। এই হলো আধুনিকতা–আরো পরিষ্কার বা গণ্ডিবদ্ধ সংজ্ঞায়নের হলে বলতে হয়–নাগরিকতা। মান্নান সৈয়দ আধুনিক ও নাগরিক, অন্তত গল্পে।
পশ্চিমবঙ্গের দাদাবাবুরা পূর্ববঙ্গকে দেখে স্মৃতি থেকে, সেই দেখা দেশ বিভাগের আগের অর্থাৎ ১৯৪৭ সালের আগের। এরমধ্যে পূর্ববঙ্গে অর্থাৎ বর্তমান বাংলাদেশে যে একটি আধুনিক ও মধ্যবিত্ত শ্রেণী গড়ে উঠেছে তা বলাই বাহুল্য। যে অর্থে ইলিয়াস বা হাসান আজিজুল হক ওপার বাংলায় গৃহীত, সেই অর্থে গল্পকার মান্নান সৈয়দের গল্প ওপারে প্রশংসিত নয়। কারণ, তাঁর নিজ জবানীতেই: বাবুরা পূর্ববঙ্গের গল্পে যে সাপ-ব্যাঙ দেখতে চায়, তার অনুপস্থিতি। তবে ঠিক অনুপস্থিতি নয়, মান্নানের গল্প অনেক বেশি নাগরিক, সেখানে নাগরিক মানসের টানাপোড়েন আছে, আছে অর্থহীনতা ও শ্লেষ মেশানো মধ্যবিত্ত ব্যবচ্ছেদ। আর এই কাজটি যদি পূর্ববঙ্গের কেউ করেন, তবে তাতো ওপারেরই সংস্করণ, তা বাবুরা কেন নেবে? কিন্তু এই যে আধুনিকতা, পূর্ববঙ্গের আধুনিকতা তার যেমন একটি স্থান-কাল নির্বিশেষ রূপ আছে তেমনি স্থানিকতার নানা অনুসঙ্গ তাকে অবধারিতভাবে নতুন একটি মাত্রা দেয়। সেই মাত্রাগুণে একটি ইসলামিক কিংবা সাংবিধানিক ধর্মীয় অনুশাসিত সমাজের ভেতরেও নতুন সম্ভাবনা ও শঙ্কার জারণ ও জঞ্জাল নিয়ে বিকাশ ঘটে আধুনিকতার। এই যে স্থানিক আধুনিকতা, যার দাবিদার ওপারের শিক্ষিত মুরুব্বিরা, কেবল তা-ই নয়, মান্নান সৈয়দের গল্প বহুল পাঠের অন্তরায় বাংলাদেশের সাহিত্য রাজনীতিও। বাংলাদেশে (হয়তো সবখানেই) সাহিত্যে এক সুচতুর রাজনীতি দেখা যায়; তা হলো মূলতঃ-র রাজনীতি। বলা হয় উনি তো মূলতঃ কবি, আরে উনি তো মূলতঃ প্রাবন্ধিক। এই মূলত’র রাজনীতি একজন পরিপূর্ণ লেখক তৈরীর পথকে রুদ্ধ করে দেয়। প্রাচীন গ্রিসে আমরা দেখি প্লেটো-অ্যারিস্টটলদের। তাদের রচনা কবিতা-গদ্য-প্রবন্ধ-দর্শন সবকিছুকে ধারণ করে হয়ে উঠতে চায় সয়ম্ভু। সেই টোটাল লিটারেচারের নজির ভূ-ভারতেও কম নয়। কবিতার মধ্য দিয়ে আখ্যান, আখ্যানের ভেতর দিয়ে ধর্ম, ধর্মের ভেতর দিয়ে রাজনীতি আবার রাজনীতির ভেতর দিয়ে কবিতা সৃষ্টির নজির কিন্তু খুব বিরল নয়। তারপরেও এই মূলত’র রাজনীতি এখনো বিদ্যমান। যে কারণে বন্ধুজন শওকত ওসমান যখন এপার বাংলা-ওপার বাংলা গল্প সংকলন করেন তখন তাতে মান্নান সৈয়দের জায়গা হয় না। কিন্তু ভাবুন তো, সুনীলের বেলায় কি তা করা সম্ভব? কারো সেই বুকের পাটা আছে? যা হোক এই দীর্ঘ ভূমিকাংশের অবতারণা খুব বেশি জরুরী না হলেও মান্নান সৈয়দের গল্প আলোচনায় বেশ প্রাসঙ্গিক বৈকি। শুরুতেই বলেছি, মান্নান সৈয়দ গল্পে আধুনিক। তার গল্পালোচনায় ঢোকার আগে তাই এই আধুনিকতাকে একটু সংজ্ঞায়িত করা জরুরী মনে করছি।
সাহিত্যে, পশ্চিমে ১৮৮০ সালে বোদলেয়ার, ম্যালার্মের আবির্ভাবকালকে আধুনিকতার সূচনাকাল ধরা হয়। এ সময় কতকগুলো বৈজ্ঞানিক হাইপোথিসিসকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা মতবাদের কারণে মানুষ ঈশ্বরকে বহুলাংশে চার্চবন্দী করার মনোস্থির করেন, সমালোচনা করেন ধর্মের বাড়াবাড়ির ও রাজনীতিতে তার অনধিকার নাকগলানোর। অর্থাৎ পশ্চিমে আধুনিকতাবাদ ছিল: সমাজ ও দেশের সামন্তবাদী পুরনো মতবাদ, ঈশ্বরবিশ্বাস ও চার্চের একচ্ছত্র আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে একটি রাজনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক লড়াই। মোটা দাগে বললে, আধুনিকতার কয়েকটি চরিত্র বা ক্রাইটেরিয়া আছে। যেমন: ব্যক্তিস্বাতন্ত্রতাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা, সমানাধিকার/ উদারনৈতিকতা *(১), মত প্রকাশের স্বাধীনতা, মানবতাবাদ…ইত্যাদি…।
(এক্ষেত্রে আধুনিকতার মুখোশি রূপ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের উক্তিও*(১) স্মরণ করা যেতে পারে; যদিও সেই বক্তব্যের সত্যমিথ্যা পরীক্ষা করা এই লেখার উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য নয়) এই যে আধুনিকতায় দীক্ষা নেয়া শিক্ষিত বাঙালির মানস; মনন, এপার বাংলার ছোটগল্পে তার অন্যতম রূপকার মান্নান সৈয়দ।
তার ‘চমৎকার অবচেতন’ গল্পের কথাই ধরা যাক। মন্টু নামের এক কিশোরের বয়ঃসন্ধিকালের টানাপোড়েন নিয়ে এগিয়ে চলেছে গল্প। শহরে বাড়ি থাকলেও যে দাদীর সঙ্গে গ্রামে থাকে, যে দেখতে পায় কমলালেবুর কোয়ার মতো খুলে গেছে জানালা, যার কাছে প্রকৃতির রূপরঙ, তার পরিবর্তন সব ধরা পড়ে, কিন্তু তার যে দ্বন্দ্ব, যৌন চেতনা; সেসবের বর্ণনা, দেখা ও বলার ধরন পুরোদস্তুর আধুনিক। গ্রাম ও শহরের মধ্যখানে লটকে থাকা মন্টুর অস্তিত্ব চেতন-অবচেতনের যে পর্দায় ঘুরপাক খায় তার বর্ণনা আধুনিকতা ছাড়া আর কি?
আধুনিকতা মানুষকে সয়ম্ভু হতে উদ্বুদ্ধ করে, কিন্তু সত্তার কাটাকুটি খেলায় সে তো অসহায়। তাই প্রয়োজন মুখোশ। যেই মুখোশের উন্মোচন দেখি আমরা ‘শিকার’ গল্পে। ইঞ্জিনিয়ার হারুনের বন্ধু ফরহাদ এসে তাকে এক অনাকাঙ্খিত পরিস্থিতির মধ্যে ফেলে দেয়। হাস্যজ্জ্বোল ফরহাদ পটু শিকারী, দিলখোলা। তার প্রতি স্ত্রী জাহানারার প্রশংসাসূচক বক্তব্য তাকে মরিয়া রকমের ঈর্ষাকাতর করে তোলে। এখানে গল্পের শেষ অংশের কিছু লাইন উদ্ধৃত করতে চাই:
ফরহাদ কাছে এলো। হারুন কিছুতেই হাসি থামাতে পারছে না, যেন বিজয়ীর হাসি হাসছে সে। ফরহাদও লজ্জার হাসি হাসলো একটু। তারপর হাসি নিভিয়ে জাহানারার দিকে তাকালো। তারপর হারুনেরে দিকে তাকিয়ে বললো, ‘গুলি বকটার গায়ে লাগেনি, কিন্তু ওখানে গেলে দেখতে পাবে কয়েকটা পালক পড়ে আছে’॥ (শিকার)
হারুন শেষ পর্যন্ত কোনো শিকারে পরিণত হয়নি ঠিকই, তার স্ত্রী জাহানারা তার বন্ধু ফরহাদের প্রেমে পড়েনি ঠিকই। কিন্তু ঈর্ষায় হারুনের কিছু পালক খোয়া গেছে নিশ্চয়। এই পুরো বিষয়টি তিনজনের কাছেই পরিষ্কার, কোনো লুকোছাপা নেই, সব জানা; কিন্তু সবকিছুর ভেতরে এক নাগরিক ভদ্রতা ও নির্লিপ্ততা আছে, আছে সূক্ষ্ম যুদ্ধও।
যুদ্ধের প্রসঙ্গ যখন এসেই গেল তখন ‘ব্ল্যাকআউট’ গল্পটির কথা উল্লেখ না করলেই নয়। ১৯৭১ সালের পটভূমিতে রচিত এই গল্পে উঠে এসেছে মুক্তিযুদ্ধকালীন শহুরে চিত্র। এই গল্পটি সাথে (কাঠঠোকরা ও অস্থির অশ্বক্ষুর গল্প দুটিতেও) মান্নান সৈয়দ বিভিন্ন দৃশ্য বর্ণনা করেছেন ১..২… এভাবে সংখ্যা দিয়ে। যেন এক-একটা শট, চকিত দৃশ্য, চকিত ভাবনা অথবা অবচেতন।
আধুনিকতার অন্যতম বড় নজির ‘অস্থির অশ্বক্ষুর’ গল্পটি। একজন কবির আত্মজবানীতে উঠে এসেছে তার স্খলন ও অতৃপ্তির কথা, ক্ষমতার অপব্যবহার (শিক্ষক-ছাত্রী এমন কী বাড়ির কাজের মেয়ের সঙ্গে গৃহকর্তার দৈহিক সম্পর্ক), টুকরো ভালো লাগা, টুকরো পঙক্তি এই তো নাগরিক বিবমিষা, সব জানা, সব বোঝা। নাগরিক মন প্রেম ও কামের মধ্যে পার্থক্য করে যুক্তি দাঁড় করানোর চেষ্টা করে। কাজের মেয়ের সাজগোজ ও কথার ধরন দেখে অসহায় ও মায়া বোধ করে, মনে মনে বলে– বেচারা! তবু শান্তি কোথায়? মুক্তি কোথায়? হয়তো ডা-লি-য়া’য়। কোনো একদিন আদর করে যার হয়েছিল নতুন নামকরণ। যে হয়তো ছিলো, হয়তো আছে, আবার হয়তো সত্যিই কেউ নেই। কী ট্রাজেডি!
“বিবি মাপ করো আমাকে। মিনা, মাপ করো আমাকে। কাজের মেয়ে, মাপ করো আমাকে। কবিতা, আমাকে মাপ করো। রাত্রি, আমাকে মাপ করো। তোমাদের সবার মধ্যে অন্য এক কেন্দ্রীয় ধ্যানের প্রতিরূপ খুঁজে ফিরেছি আমি। তোমাদের সবার প্রতি অন্যায় করেছি আমি” (অস্থির অশ্বক্ষুর)
এই উপলব্ধি সত্বেও কিছু করার নেই মানুষের*(২)। তবে মান্নান সৈয়দের অবলীল বয়ান মুগ্ধ করে। “ফুলকপির মতো স্তন, বাঁধাকপির মতো পাছা” (!!) এই বয়ান শৈলী এক ধরনের বিবমিষাও তৈরী করে। হুমায়ূন আজাদ সৈয়দ হক সম্পর্কে বলেছিলেন, নিষিদ্ধ লোবানের মূল চরিত্র বিলকিসের সাথে পাকিস্তানী অফিসারের কথপোকথন, তার ধর্ষণের বর্ণনা দেখে মনে হয় লেখক নিজেও সেখানে এই ন্যাক্কারজনক ভোগক্রিয়ায়/ধর্ষণে লিপ্ত। সেই একই কথা মনে হয় হুমায়ূন আজাদের ‘ফালি ফালি করে কাটা চাঁদ’ পড়তে গিয়ে। মান্নান সৈয়দও কি সেরকম?! আমি অবশ্য একে দেখি অকপট বয়ান হিসেবে। এই অভিযোগ আরেক দিকপাল আল-মাহমুদের বেলায়ও খাটে, যার একটি গল্পে দেখা যায় বাবা তার মেয়ের জিন্স পরা উরু দেখছেন নির্লিপ্তভাবে। জেন্ডার এ্যাপ্রোচ থেকে এসব গল্প ভিন্নভাবে পাঠ ও ব্যাখ্যা করার সুযোগ থাকলেও থাকতে পারে। তবে শাদা চোখে, আমার মত: এই যে অকপট বয়ান বা ভোগ মানসিকতা এটা কি সবার বেলায় ঘটে? এ পর্যন্ত যাদের নাম বললাম তাদের কিন্তু আরেকটা পরিচয় আছে, তারা সবাই গল্পকার ও কবি। তাহলে কি কবিরা গল্প লিখলে (বাংলাদেশ পার্সপেক্টিভে) তাতে যৌনতা সুড়সুড়ি মূর্ত হয়ে ওঠে? তবে আরেকটি মিলও আছে তাঁদের মধ্যে, তা হলো: তাঁরা সবাই মোটাদাগে ‘আধুনিকতা’য় দীক্ষিত। মর্ডানিজম যে এপ্রোচ থেকে স্বাধীনতা, ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা, যৌনতা, নারীদেহের বর্ণনার একটি পাশ্চাত্যধারা তৈরি করেছে তাঁরা সকলেই তাতে সমর্পিত। তা যা হোক। এসব প্রশ্নের জবাব না খুঁজে, আপাতত বলতে চাই: যৌনতা ও নাগরিক বিকৃতি মান্নান সৈয়দ তাঁর গল্পের অন্যতম অনুসঙ্গ করেছেন।
মান্নান সৈয়দের আরেকটি গল্প ‘একজন আবু হোসেন’ ও শিক্ষক-ছাত্রীর সর্ম্পক নিয়ে লেখা। এসব গল্প পড়ে এগুলোকে মান্নান সৈয়দের ব্যক্তিগত জীবনের প্রতিচ্ছবি মনে করার যথেষ্ঠ অবকাশ আছে। একে তো উত্তম পুরুষে লেখা, তার ওপর মান্নান সৈয়দ নিজেও ছিলেন পেশায় অধ্যাপক (হুমায়ূন আজাদও, তার সব কিছু ভেঙে পড়েসহ একাধিক উপন্যাসে নায়ক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক)। এখানেই প্রয়োজন বাড়তি সতর্কতা। লেখকের ব্যক্তিজীবনের প্রতিফলন খোঁজা সাহিত্য-সমালোচনার অন্যতম টুলস হিসেবে পরিগণিত। ব্যক্তি ও লেখকের সৃষ্টিতে তার অভিজ্ঞতার রেশ আবিষ্কার করা পাঠকের জন্য বাড়তি এক ধরনের উত্তেজনা যোগান দেয়। আর সেখানেই মার খায় সাহিত্যের দাবি। কারণ, লেখা নিজেই সয়ম্ভু। তাতে লেখকের জীবনের ছাপ পড়লো কি পড়লো না, তাতে কতটুকু সত্য আর কতটুকু খাঁত তা খুঁজতে গেলে টেক্সটের মাহাত্ম্য খর্ব হয়। কারণ, তাতে নতুন ইন্টারপ্রেটেশনের পথ পুরোপুরি নয়তো আংশিকভাবে রুদ্ধ হয়ে পড়ে। মান্নান সৈয়দের (অন্যান্যদেরও) গল্প পড়ার সময় এসব স্থূল বিষয়কে শুরুতেই মাথায় না আনাই শ্রেয়। তা যা হোক।
মান্নান সৈয়দের ভাণ্ডারে আরেক ধরনের গল্পের প্রাচুর্য দেখা যায়। সে অনেকটা পৌরাণিক কাহিনী আশ্রিত, যেখানে তুলে ধরা হয় গৌতমবুদ্ধের সময়কার প্রেক্ষাপট অথবা নাম না জানা কোনো প্রাচীন রাজার রাজ্যপাট। এসব গল্পে এক ধরনের শিক্ষা দেয়ার মানসিকতা লক্ষ্যণীয়। গল্পের আঙ্গিকে সেগুলো পৌরাণিক, ভাষায় তৎসম-তদ্ভববহুল, লক্ষ্যে ঈশপের গল্পের সমগোত্রীয়। তবে এসব গল্প বেশ কমিউনিকেটিভ; তাতে একটা রূপকথা বা আবহমান গল্পবলিয়ের স্বর বেশ টের পাওয়া যায়। এসব গল্পের মধ্যে আছে: আম্রকাননে, রাজা, চোখ, অমরতার জন্য মৃত্যু।
এধারার গল্পের পটভূমি ও ভাষার কৃতকৌশল একটি পৌরাণিক আবহ তৈরি করলেই অনেকক্ষেত্রে তা বর্তমান আধুনিকতাকে রিলেট করে। উদাহরণ হিসেবে অমরতার জন্য মৃত্যু গল্পটির কথাই ধরা যাক। এই গল্পে রাজা ও তার সভাসদ, সাথে পুরো জনপদ এক বা একাধিক অদৃশ্য দুষ্টুজনের ক্রিয়াকর্মে হতভম্ব হয়ে পড়ে। প্রথম দিন কে বা কারা যেন ভেঙে ফেলে আদিপিতার মূর্তি, দ্বিতীয় দিন ধর্ষিতা হন প্রধানা রাজনর্তকী, তারপর সরোবরে বিষ মিশিয়ে মানুষ হত্যা। নিরুপদ্রপ জনপদে অজ্ঞাত আততায়ীর মতো মুখে মুখে প্রচারিত হতে থাকে সেই অদৃশ্য ব্যক্তি। অবশেষে ধরা পড়ে সে। আনা হয় রাজদরবারে। সেখানকার দৃশ্যটি পুরো তুলে ধরছি পাঠকের জন্য:
রাজা স্বয়ং জেরা শুরু করলেন–জনতা মুহূর্তে স্তব্ধ হয়ে গেলো–তুমি গত নিশীথে প্রাসাদে প্রবেশ করে আমার কক্ষ সন্ধান করছিলে?
বন্দী জবাব দিলো, হ্যাঁ।
তোমার অভীষ্ঠ ছিলো আমাকে হত্যা করা?
হ্যাঁ।
তুমি আদিপিতার মূর্তি ভেঙেছিলে?
হ্যাঁ।
তুমি প্রধানা নর্তকীকে বলাৎকার করেছিলে?
হ্যাঁ।
তুমি সরোবরের জলে বিষ মিশিয়েছিলে?
হ্যাঁ।
তুমি যে এসব করেছিলে, তুমি জানো এর পরিণাম?
জানি।
কী পরিণাম?
মৃত্যু।
এই যে জেনেশুনে অপরাধ বা অপকর্ম এর মোটিভ কী? উত্তর মিলছে সেই বন্দীর জবানীতেই– “মহারাজ! আপনার কথা লিখবে ইতিহাস। আমার কথা লিখবে কে? আমি মানুষের মনে বেঁচে থাকতে চাই–এমন কাজ করে, যাতে লোকে আমাকে মনে করে, মনে রাখে।” –এই যে অমরতার প্রতি লোভ তা তো শাশ্বত। কিন্তু ন্যায়নীতি ও হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে এই যে মরিয়া প্রচেষ্টা, এটাও কিন্তু আধুনিকতার সংকট। যার কথা টীকা আকারে তুলে ধরেছি রবীন্দ্রনাথের জবানীতে (পরিশিষ্ট লক্ষ্যণীয়)। এই হচ্ছেন মান্নান সৈয়দ যেখানে যান না কেনো, আধুনিকতা বা নাগরিক মনষ্কতার টানাপোড়ন ঠিক তুলে এনেছেন। এখানেই তার বিশিষ্টতা।
এতো সব তত্ত্বকথা ও প্রমাণ-প্রচেষ্টার মধ্যে মান্নান সৈয়দের একটি গল্পের কথা বলে রাখতে চাই। গল্পটির নাম ‘হোসেন মিয়ার সঙ্গে’। এই গল্পে তিনি জ্যান্ত করেছেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়কে। গল্পের শুরুতে এক মজার দৃশ্য আছে: মানিক বসে আছে বৌবাজারে পতিতাপল্লিতে, খুঁটেখুঁটে দেখছেন সেখানকার জীবন, লিখবেন উপন্যাস। এরমধ্যে পুলিশের রেইড। সেখান থেকে সরে যাওয়ার আগে মানিক সেই বেশ্যার হাতে টাকা গুঁজে দিয়ে একটা মাই টিপে দিচ্ছেন। বেশ ফানি পিকচারাইজেশন। এই গল্পটির কথা আলাদাভাবে বলার কারণ, এই গল্পটি একটি টোটাল ডিকনস্ট্রাকশনের নমুনা হতে পারে। এই গল্পে উঠে এসেছে সব ঐতিহাসিক ঘটনা: কলকাতায় মানিকের ছোট ভাই সুবোধের প্রেস দেয়া, পরে তার নিরুদ্দেশে চলে যাওয়া, বিভূতিভূষণের সঙ্গে মানিকের সাক্ষাত ইত্যাদি প্রসঙ্গ। তবে এই গল্পে, মানিক ও সুবোধের প্রেসে মুখোমুখি হয় পদ্মা নদীর মাঝি উপন্যাসের কুবের আর হোসেন মিয়া, সাথে আমিনুদ্দি। মানিকের মূল উপন্যাসে চরিত্রগুলোর স্বর অক্ষুন্ন রেখে তাদের বর্ধিত রূপ দিয়েছেন মান্নান সৈয়দ যা এক নতুন মাত্রা তৈরি করেছে। মৌলিকত্বের দাবি না করেও বলা যায় এই গল্প বেশ উপভোগ্য।
আরেকটি বিষয় মান্নান সৈয়দের গল্পভাষা যেন তার কবিতার ছায়া। পদে পদে কাব্যিকতা গল্পের পা জড়িয়ে ধরে। তার একাধিক গল্পের প্রধান চরিত্র কবি, তাদের সমস্যা নারীঘটিত (বিবাহ বহির্ভূত)। কিন্তু সবচেয়ে বড় কথা, এক হাতে কবিতা ও গদ্য লেখা–শুরুতে যে মূলতঃ-র রাজনীতির কথা বলেছিলাম, সেই বাস্তব সমস্যাকে পাশ কাটিয়ে তাঁর (এরকম অলরাউন্ডার লেখক পাই আল মাহমুদ, সৈয়দ শামসুল হক, ওপারের সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়) সব্যসাচী হয়ে ওঠা সত্যিই চমকপ্রদ। সবশেষে তাঁর ‘রাস্তা’ গল্প থেকে দুটি লাইন তুলে দিয়ে এ লেখা শেষ করতে চাই:
“বন্ধুদের কাছে যেটা অত্যন্ত প্রবল-গভীর একটি সমস্যা ছিলো, আমি তা প্রায় অবলীলাক্রমে পার হয়ে গিয়েছিলাম। আসলে যে পেরোতে পারে সে অবলীলাক্রমেই পেরোয়। যে পারে না, সে কেবল একই বিন্দুতে ঘুরপাক খায়।” (রাস্তা)
মান্নান সৈয়দ পেরেছিলেন গল্প ও কবিতা দুই সতীনকে (!) এক ছাদের নিচে নিয়ে সংসার করতে, মাঝে মাঝে হয়তো কবিতাবধুর রঙ লেগেছে গল্পবিবির গায়ে; আবার কখনো গল্পখাতুনের ঝাপ্টা লেগেছে পরকীয়া কবিতায়—এই যা।
……
টীকা, পরিশিষ্ট :
(১) রাষ্ট্রতন্ত্রে একদিন আমরা য়ুরোপকে জনসাধারণের মুক্তিসাধনার তপোভূমি বলেই জানতুম–অকস্মাৎ দেখতে পাই, সমস্ত যাচ্ছে বিপর্যস্ত হয়ে। সেখানে দেশে দেশে জনসাধারণের কণ্ঠে ও হাতে পায়ে শিকল দৃঢ় হয়ে উঠছে; হিংস্রতায় যাদের কোনো কুণ্ঠা নেই তারাই রাষ্ট্রনেতা। এর মূলে আছে ভীরুতা, যে ভীরুতা বিষয়বুদ্ধির। ভয়, পাছে ধনের প্রতিযোগিতায় বাধা পড়ে, পাছে অর্থভাণ্ডারে এমন ছিদ্র দেখা দেয় যার মধ্য দিয়ে তার দুর্গ্রহ আপন প্রবেশপথ প্রশস্ত করতে পারে। এইজন্যে বড়ো বড়ো শক্তিমান পাহারাওয়ালাদের কাছে দেশের লোক আপন স্বাধীনতা, আপন আত্মসম্মান বিকিয়ে দিতে প্রস্তুত আছে। এমনকি, স্বজাতির চিরাগত সংস্কৃতিকে খর্ব হতে দেখেও শাসনতন্ত্রের বর্বরতাকে শিরোধার্য করে নিয়েছে। বৈশ্যযুগের এই ভীরুতায় মানুষের আভিজাত্য নষ্ট করে দেয়, তার ইতরতার-লক্ষণ নির্লজ্জভাবে প্রকাশ পেতে থাকে।
…
(২) এখানে পড়ে নিতে চাই পশ্চিমের আধুনিকতার অন্যতম পুরোধা বোদলেয়ারের একটি চিঠির খণ্ডাংশ, যেখানে Everything in it which is not hideous is incomprehensible, everything one understands is putrid এই বলে J. Habas writing তার সমালোচনা করলে রাগে-দুঃখে বোদলেয়ার তাঁর মাকে চিঠি লিখছেন, নিজের লেখার ব্যাখ্যা দিচ্ছেন, তা অনেকটা আধুনিকতার ব্যাখ্যাও বটে: You know that I have always considered that literature and the arts pursue an aim independent of morality. Beauty of conception and style is enough for me. But this book, whose title (Fleurs du mal) says everything, is clad, as you will see, in a cold and sinister beauty. It was created with rage and patience. Besides, the proof of its positive worth is in all the ill that they speak of it. [Charles Baudelaire, Richard Howard, Les Fleurs Du Mal, David R. Godine Publisher, 1994, p.238]