শিবলী সাদিক
বিদূষকের কথা
বৃষ্টির পরে এখন সব শান্ত হয়ে এল,
গাছের থেকে সুন্দর নেমে এল।
জানি সব নাচ দেখা হয়ে গেছে,
শাড়ির গোপন ভাঁজ দেখে কবি চলে গেছে।
তাহলে সুন্দর কী দেখাবে?
মঞ্চের বাইরে কী কিছু ঘটবে?
বিদূষক হেসে বলে- নাচ দেখা শেষ,
বাড়ি যাও এবার গাধার পিঠে চড়ে,
সেখান চুল্লীর পাশে সারা রাত স্বপ্ন সেঁকো,
স্বরলিপি হতে নোট নিয়ে
আগুনে পোড়াও, গাও গান ‘এসো এসো’
সুন্দর তোমার সাথে দেখা করবে না।
সকাল
তারপর যেমন ধরুন, ব্যক্ত হওয়ার সমস্যাটা, কোনো মৌন বা সাকার বাক্যে যা বলা যায় না। যেমন আজকের সকালে মেঘ আর রোদ। রোদে বহু মুদ্রা সোনার ছড়ানো থাকে আর প্রভূত অনর্থ – অব্যক্তের সব হাসি। সকল সকাল অপরূপ, অপরের রূপ হয়ে থাকে।
আর দৃশ্য যা দেখা যায়, তাও তো অসৎ, বহু ভাষ্য করা যায়। কারণ রোদের আছে সিল্কের অনেক কারকাজ, মসলিনের ফোকর দিয়ে যে গাছ দেখা যায়, তার রূপ কতটুকু ধরা পড়ে? আর কীট-পতঙ্গের প্ররোচনা ও প্রপাগান্ডা তো আছেই। তাই বসন্তকালের ফুল, যাকে যৌথ রচনা মনে হয়, আলো বাতাসের বহু বর্ণ, এমন কী দূরের নদীর সুর, সবসহ আর জানা গেল না, আমাদের চিন্তার সাধারণ সংকট তাতে কাটছে না। মসলিনের অনেক উজ্জ্বলতা চারদিকে, বহু পর্দা রোদে, আভাস আর ইঙ্গিতের ছড়াছড়ি।
তদুপরি আছে স্মৃতি সমস্যা হয়ে, কারণ গাছের ডালে এক গলমান ঘড়ি ঝুলে আছে, আমাদের স্বপ্ন, আশা-আকাংখা, যৌনতার আলো সব গলে পড়ে বলে বর্তমান বলে আর কিছু স্পষ্ট নয়। এমন ঘড়ি দালির চিত্রে আছে। ফলে বর্তমানতার সমস্যা আমাদের ইগোর সমস্যা। আলো তাকে উস্কে দেয়।
আর সকালে তো সদাই মেঘেরা ধীরে যায় দূর অলিম্পাসের দিকে। মেঘের আড়ালে কত শত রাগিনী গাইছে, ফলে রোদ-ছায়া মন আনমনা করে দেয়। একটি সকালের রূপ আঁকা যায় না, তা মধুর, ফুল আর পাখিদের নিয়ে বচনাতীত হয়ে মনে রয়ে যায়। আলো ব্যর্থ ও অব্যর্থ কত যোগাযোগে, আর তা কত না মধুর!
বর্ষা
বর্ষা নিয়ে আমাদের লেখা কম, এ নিয়ে ভাবার লোক কই? গত শতকের কিছু আবেগ এখনও ভেজা, আমাদের ঘন ঘন ভিজিয়ে ফেলছে, তাতে অনেক জরুরী কাজ পন্ড হয়ে যায়। উল্লেখিত আছে- জনৈক যামিনী রায় আষাঢ়ের দিনে ঘোরতর আবেগ আক্রান্ত হয়ে বাড়ি ছেড়ে আর ফেরেন না। তাকে পরে এক পুস্তকের কাভারে আবছা দেখা যায়, আর তার কবিতায় তার ছাপ স্পষ্ট। কেউ কেউ বর্ষাকালে ‘কদমের ফুল নিজ মর্মজ্ঞানে প্রকাশিত হও’ এই পদ লিখে হাহাকার করে থাকে। জগৎ ভাবুক শক্ত ব্যক্তি, তা নাহলে এত ভেজা কার পক্ষে বা সম্ভব!
কয়েক শ বছরের ইতিহাসে আরও কিছু মহাজন আছে, যারা নারীদের ভেজাচুলে আত্মহারা হয়ে কবিতা লেখেন। মেঘ আর চুল ফলে আমাদের স্মৃতি হয়ে ওঠে। আর কেউ কেউ চুলে মৃত্যফুল খোঁজ করে, বর্ষাকালে তারা অন্য দেশে চলে যান। সেই দেশে এক রাজকন্যা ছাড়া অন্য মেয়ে নাই, আর পুরুষেরা তার রূপে সিক্ত হয়ে যুদ্ধ ভুলে খোলা আকাশের নিচে বসে থাকে। ফলে ঘন ঘন বৃষ্টি হয়। আমরা ভিজতে থাকি।
অনেক শতক ধরে এই প্রকাশ-অপ্রকাশের ধারা আমাদের আবেগকে নাড়া দিয়ে যাচ্ছে, আমাদের সমষ্টি চেতনা তাই কিছুটা আষাঢ়ে গদ্য হয়ে আমাদের তাড়া করে, ভাবছিই না কেন ঋতুসকল এতটা সিক্ত করে রাস্তাঘাট, মায় আমাদের ব্যক্তিগত মন, আমাদের ফুল আর গাছসকল নব রূপে জাগ্রত হয় মনে, মনোবাক্যে, অধিবিদ্যার ঘন রূপে, বর্ষায় জাগতে থাকে ঘন ঘন বিদ্যুচ্চমকে। এমত বিষয়ে কারো দ্বিমত থাকলে শীঘঘির জানাবার দরকার নেই, আমরা কদমফুলে কি বর্ণ জাগরিত হয়, তা এখনও পাঠ করে দ্বিধামুক্ত না হয়ে বিভক্ত হয়ে পড়ছি জড় ও জীবকূলে।
বিল
কাউয়াগারা বিলের রূপ হল না দেখা
বৃষ্টি এসে ঝাপসা করে দিয়েছিল সব বিবেচনা
জল দেখেছি, দেখিনি তবু জলের গান আর রচনা
কাজল জলে পদ্ম দেখে বুঝিনি রূপ, ছিল নিষেদ টানা
বিলেতে মাছ, কচুরী পানা পরস্পর করেছে খেলা
একজনের নিরব ভাব অপরে করে জলে রটনা
ভাব ও রূপে নিরন্তর রচনা ফুল – ভাবিনি আগে
দেখেনি তাই কলমিফুলে নিহত ভ্রমরের ডানা
বিলের পাড়ে কাঁঠাল গাছে ধরেছে ফল
ফুটেছে তাতে জনপদের স্বপ্ন শ্রম
পাড়ের যত কাহিনী, সুখ ও সংবাদ নামছে জলে
ডালিমফুল বলেনি কথা দিবস কত বধূর সাথে
ছিদাম মাঝি উধাও শোকে শ্রাবণ মাসে
নামল কবে রংধনু ও কামজ মেঘ মুষলধারে ছাতিম গাছে
রূপের জল, সুখের জল বিলের বুকে
রঙকাহিনী বহুকালের ঝিলিক মারে অথৈ জলে
ডুবেছি জলে আনিনি তুলে মানব শিকড়
ছিলাম স্রোতে, বুকের ফুল পারিনি তুলে নিতে
ফল ২
(দ্বিতীয় লিখন)
ফলে যত অপ্রকাশ, তা প্রকাশ পেলে খুব ভাল হতো কি না, তা নিয়ে এই লেখা।
আমি ফল লোভী, গোপন জলের নিচে কত রং আর ফল আছে, তা-ই চিন্তার বিষয়।
স্নান দেখি ঐ মহিলার, তার স্তন জলে পদ্ম হয়ে কভু ভাসে, ডুবে, তাতে ঘন ঘন
শ্বাস ফেলি, এ যেন ভাষাবিজ্ঞানের নবীন অধ্যাপিকা ছাত্রের টেবিলে আপেল রেখে
শিক্ষা দেয়, আর ছাত্র বইখাতা ভুলে স্নান করে সৃষ্টিজলে। আর তাতে মনে কিছু গ্লানি
আসে, শিক্ষিকার হাতে লাল রং দেখা কিছু অশোভন মনে হয়।
ফল সব সময় আমাকে বাগানের কথা মনে করায়, যে বাগানে পাখি শিষ দেয়
আর এই শিষে আমি জানি ফলের রঙিন সুখ থাকে, পাখি খুব ফল খায়,
তার ঠোঁটে রস লেগে থাকে ডালিমের, আহা, কেন এত সুস্বাদ ফলের,
এ সব হয়তো বই পত্রে জেনে যাব আমি কোনো দিন, কিন্তু তার
আগে পৃথিবীর সব ফলবতী গাছের গোড়ায় বসে স্তবগান করে উপরে তাকিয়ে
শোভা ও বিদ্যুৎ দেখে শুধু বলব, “উঠ হে প্রকাশি”
(প্রথম লিখন)
আপেল খামারে ঢুকে একদিন অভিমানে পাকতে থাকব
তোমার প্রকাশে এক রাঙা যতিচিহ্ন হয়ে
আগামী বছরে, অথবা সহসা এক দিব্যক্ষণে
তোমার খামারে আমি কিছু অভিমান হব
আমি লোভী লোক, ফল দেখে কাতরতা খুব
সর্বদাই ঘ্রাণে রঙে মসগুল হয়ে আছি
এর জ্যামিতি ও আকারে মুগ্ধ আমি প্রজাপতি হেন,
এ-যে জ্যামিতির আদর্শ আকার- শূন্যতার রূপ
যথাযথ মূর্ত ফলে, ঘ্রাণ আর স্পর্শ ফেটে পড়ে
সব ঋতু ফলে গুপ্ত, সব বিদ্যা, অধিবিদ্যা
রসে ও মাংসে ঘন, একাকার হয়ে আছে
বীজাকারে আছে জগতের সব অর্থ, তাৎপর্য
আর সব অপ্রকাশ, যা প্রকাশিত হয় না
ফল দেখে তাই জ্ঞানচক্ষু মুদে আসে
মৌমাছিরা বলে- যদি রূপে পুড়ে যাই ক্রমাগত
একদিন আমি নিজেই রং হয়ে, রস হয়ে
ফলে ফলে এঁকে যাব আমার মিনতি
নদী ১
সুদূরে হাঁসের দল উড়ে গেলে জলে ছায়া পড়ে থাকে
এই ছায়াটুকু নিয়ে নদীতীরে বসে আছি প্রায়ান্ধকারে
ছাতিম গাছের সাথে কথা বলে বলে দিন চলে গেল
কিছুই তো হল না জানা মাঠের ঘাসের কথাগুলি
আর কচুরীপানার নীল ফুলে স্তব্দ হয়ে বসে-থাকা আলো
নদীতীরে আমি গর্ত খুঁড়ে থেকে যাব
আর বনভোজনের স্থায়ী আলো যাব দেখে
দিনমান নদীর স্ফটিক জলে ভেসে-আসা নাচ
কত নারী কাঁখের কলস ছেড়ে আনমনে ভাসে
তাদের দেহের রূপ জলে কত দূর বয়ে যায়
কত সুর কত কথা ভেসে আসে জনপদ হতে
তাঁত-মন দিয়ে নদী তার রূপ বুনে জলে
মাছের আনন্দে আমি দিনভর দেখে যাব
নদীর শরীর ভরা শ্যাওলার গন্ধ, শ্যামলতা
নদী ধরে আসে কত উজান দেশের কথা
সেই দেশে স্নানরতা কুমারীর দেহ হতে
অলংকার হারায়, আর তার রূপ বয়ে নদী
এঁকে চলে বাঁকে বাঁকে কত স্বপ্ন ইতিহাস
পদ্মমাতা তার চুলে কত ফুল গুঁজে দেয়
আমি তার রূপ দেখে যাব নদীতীরে বসে
নদী-২
(উৎসর্গঃ আদিমতাবাদীদেরকে)
নদীর কিনারে বসে পদ্ম মাছ মেঘ স্রোত আর
ভৌত জগতের স্নায়ু যোগাযোগ নিয়ে ভাবি-
পদ্ম আর দূর মেঘ কী করে বিযুক্ত আর যুক্ত
তার সবটুকু আজ বুঝে নিতে চাই মূলসহ
আমাদের ক্ষীণ দৃষ্টি, অপচায়িত বিবেক বোধ বলে
নদী আর তীরবর্তী সংকেত না জানায়
জীবন ক্রমেই হ্রস্ব হয়ে যাচ্ছে বিকেলের মেঘের মতন,
আমরা মাছের মত বাঁচতে পারছি না স্রোতের উৎসবে,
আমরা রাতের বেলা তারাদের তাঁত বুনছি না আর,
বন উজাড় না করে নির্মম কুঠার রেখে
জলাশয় পাশে বসে আর স্বপ্ন দেখছি না,
আমাদের উপকথা শেষ হয়ে যাচ্ছে,
আমরা পাশাখেলায় মেতে আছি,
বাজারে নিঃস্ব দেহ বেচে মৃত হাঁস হাতে
যুদ্ধ হতে আরও যুদ্ধে যাই যেন
বিজ্ঞাপনে দেখা মোহ সুখ সব চাই,
বনে হরিণের প্রেমে আর পথ হারাই না,
আমরা বনের সাথে অবিমৃষ্য যুদ্ধে মেতে আছি
একদল লোভী লোক অস্ত্র আর মোহ হাতে
তাড়া করে এত দূর নিয়ে এল, ভুল গেছি
উৎস ও স্রোত কোথা, ঘুরছি অলাতচক্রে
সংকটে সংকটে শ্বাসরোধ হয় সকলের
বেলা পড়ে আসে, কালবেলায় আহত তবু
ধমনী আমার কেটে দেখি গূঢ় রক্তস্রোত
পূর্বাপর স্রোত শুধু দেখি, যেন
ঘাসপোকাদের জীবনীর রং, বৃষ্টিবাতাসের সব
সর্বদেহে রক্তবাহী যোগাযোগ জেনে নিয়ে
সমগ্রতার অশেষ বিষ সম্পূর্ণ গলধারণ করে
নীলকণ্ঠ শিব হয়ে সত্যসার বুঝে যুদ্ধে যাই
নিরবতা
কেন পুকুরের জল নিয়ে লেখা যায় না, যায় না বাঁধা গান, তা আমি জলের উপরে ভাসা গান দেখে বুঝে নেই। রাত তার গান জলে ফেলে গেছে, ভোরের আলোর সাথে তার আভা দেখে আমি বুঝি উপযুক্ত নই, এক দিন জন্ম নিব শুধু এই গান লিখে নিতে। আজ আমি পুকুরের পাড়ে মরে যাই জলে গান আর আভা দেখে।
স্তব্ধতার ফুল ফোটে জলে, নিরবতার আকার নম্র জল হয়ে যায়। জলে সব কিছু নিরবতা। মাছের নিরবতর শ্বাস। যত কিছু ফোটে চার পাশে, তাদের আকার জলে ছায়াফুল হয়ে কোথায় হারায়।
নিখিল বাস্তবতার কত রূপ – কিছু পাখি, কিছু হাঁস, গাছ, জড়, জীব অযুত প্রকারে কিছু ব্যক্ত ও অব্যক্ত হয়ে মুহূর্মুহূ ছুঁড়ে দিচ্ছে কত কোলাহল! সব রূপ জলে মরে গিয়ে নিরবতা জাগে। মৃত্যুই হয়তো সব ভাষার শেষ ভাষা, রূপের অশেষ। জলে তার রূপ জাগে গান হয়ে, নিরবতা হয়ে। আমি মরে স্বাদ নেই।