শনিবারের জার্নাল – ২

দোলনচাঁপাচক্রবর্তী

ব্লগ লিখতে শুরু করার পর তৃতীয় শনিবার। বরফি রিলিজ করেছে। তুমুল উন্মাদনা। সারা মুম্বাই এসে পড়েছে মাল্টিপ্লেক্সগুলোতে। সাধারণ সিনেমা হলের কী অবস্থা জানিনা। যাওয়া হয়না কখনো। মাল্টিপ্লেক্সে নিয়ন্ত্রিত শীতের আরাম,পেপসি-কোলা-স্প্রাইট,আলুর বড়া। ফিল্ম দেখতে যাই নাকি আসলে সারা সপ্তাহের ক্লান্তি কাটাতে যাই !

মাল্টিপ্লেক্সবিহীন সিনেমা দেখেছিলাম প্রায় ষোলো বছর আগে – যতদূর মনে পড়ে। বাবার সাথে কলকাতায়। রকি সিনেমা হলে। তার প্রায় বছর দশেক বাদে ব্যস্ত নিউ মার্কেট। গলিঘুঁজির ভিতর দিয়ে হাঁটতে গিয়ে প্রচুর ধাক্কা খাচ্ছি। ব্যাগ কিনব না স্টাফ্‌ড খরগোশ – সেই তাড়নায় উদ্বেল। জারি আছে টুকটাক ফুটপাথ শপিং। তখন বাবা আর নিউ মার্কেটে আসার মত অবস্থায় নেই। বাবা তখন কলকাতাতেই নেই। ঝকঝকে দোকান পসরার মধ্যে অন্ধকার ছাপের কিছু লোকজন,কিছু বিনিময়, সিনেমা দেখা,আরোপিত অন্ধকার,ভাল লাগা ও না-লাগার কলকাতা এক হয়ে যাচ্ছে পুরনো স্মৃতির সাথে। এভাবেই মানুষ মেদুর হয়। মেদুরতা মানুষের একান্ত।

সেইসব ও কলকাতা ছেড়েছি অনেকদিন আগে। মুম্বাই শহরের চরিত্রের সঙ্গে এমন নরম ডানাঅলা শব্দের মিলমিশ হয়না। তবু, মুম্বাইতে আমার শনিবার কিছু স্পেশাল। এদিনই আমার শপিং। আমার আউটিং। আমার ফিল্ম দেখা। প্রত্যেক শনিবার নয়। কখনো কখনো। আজ যেমন বাড়িতে থাকব সন্ধ্যায়। অনলাইন কোনভাবে টিকিট কাটানো গেল না।

বাবা কোন সন্ধেই বাড়িতে কাটাত না। লেক পর্যন্ত একা একা হাঁটতে যেত। প্রচন্ড ঠান্ডায় গলায় চাদর জড়াত না। জলের দেশের লোক। জল থেকে তুলে শহরে পুঁতে দেয়ার চল্লিশ বছর পর, আবার জল খুঁজে পেয়েছিল। জলের শীতবোধ থাকে না। বাষ্প থাকে। হিমশৈল থাকে। বালিহাঁস থাকে এক ঝাঁক,যারা জলের ইচ্ছেমত উড়ে যায়,শূন্যতার দিকে। বাবা এখন ওই বালিহাঁসের বিরাট ঝাঁকটার পাশাপাশি হাঁটছে। ওরা এক এক সময় নেমে আসছে মাটিতে। হেঁটে হেঁটে দানা খুঁজছে সিগ্যালের মত। বাবা থামছে। ভাল লাগছে বাবার। জুতোটা যে প্রায় ছিঁড়ে এসেছে,বাড়ি ফিরে সেটা মা’কে বলবে কীনা ভাবছে। হঠাৎই আবার উড়াল দিচ্ছে পাখিগুলো। বাবাও হাঁটা শুরু করছে আবার। যাক,এ দফায় তাহলে বলতে হলনা। এখনো তো ছেঁড়েনি জুতোটা।

আমার এ’রকম প্রায় পোষা একগোছা বালিহাঁস নেই। পুনর্বিবেচনার জন্য রেখে দেয়া দ্বন্দ নেই। তাই আমি কবিতা পড়ব। আপন মাহ্‌মুদের কবিতা। পরশু থেকে আপনের অনেকগুলি লেখা পড়লাম। আগে পড়িনি। লেখাগুলো পড়ে মনে হল,কেন পড়িনি।

“পাহাড়,তোমাকে কিছু বলতে ইচ্ছে করে — বিশেষত মনমরা বিকেলে
কী করো তুমি — কার কথা ভাবো – কে তোমার কান্নাকে প্রথম ঝরণা
বলেছিলো? আমি? আমি দু-চারটা সিগারেট বেশি খাই, চুপচাপ
ঘুরি-ফিরি–দাড়ি কেন কাটতে হবে, ভাবি…

মাঝেমাঝে নিজেকে শৈশবের হাতে তুলে দিয়ে ঘড়ি দেখি–ঘড়িতে
৩৪টা বাজে! ফুল পাখি নদী ওরা কেমন আছে?

পাহাড়, তুমি কি জানো, রজনীগন্ধা সবজি নয় কেন!”  (আপন মাহমুদ)

শৌনক স্মৃতিচারণা লিখেছে ক্ষেপচুরিয়াসের ব্লগে। পাঁচশ টাকায় পাঁচজন মানুষের সাথে ঝুপড়ির একটা ঘর ভাগাভাগি করে থাকতেন আপন। আর,কবিতা লিখতেন। প্রেম করতেন? বিশ্বাস করতেন যে প্রেম তার খারাপ মূহুর্তগুলো মুছে দেবে? দিতে পারে কিনা – সে অপেক্ষার অবসর ছিল কী তার? নাকি শেষ হয়ে গিয়েছিল সমস্ত অপেক্ষা? মানুষটি না থাকলেও অপেক্ষা থাকে অনন্তর। কেউ গোড়ালিতে লাগা জলের ধাক্কার মত আলতো করে বাসী স্রোত পেরিয়ে আসে। কেউ পাড় বরাবর হেঁটে যায় দক্ষিণের জানলার দিকে।

(আমার দক্ষিণ খোলা জানলা
মাঘের এই অন্তরঙ্গ দুপুরবেলায়
না শোনা গল্প, সুর অন্য, মনে পড়ে যায়
এক দমকা হাওয়ায়)

– মহীনের ঘোড়াগুলি

কলেজে পড়ার সময় এই গানটা খুব শুনতাম। আমার এক বন্ধু ছিল। সেও শুনত খুব। কবিতা লিখত। শায়রী অনুবাদ করত দুর্দান্ত ছন্দে। ছবি আঁকত। গাঁজা বানাতে আর চশমা পরতে ভালবাসত। অসম্ভব বেসুরো সুরে ভাঙা গলায় তাবৎ দুনিয়ার লোককে গান শোনাত। আর বৃষ্টি হলে বারান্দা দিয়ে ঘড়িপরা হাত বার করে দিত। জল পড়ছে ঘড়ির কাঁচে। ও দেখছে,ভিজলে সময়ের গতি স্লথ হয় কীনা !

দ্বিখন্ডিত ধমনী থেকে ওই যে রক্তস্রোত প্রবল আবর্ত সৃষ্টি করে সরে যাচ্ছে হেমন্তের দিকে। লঘু ছন্দে পেরিয়ে যাচ্ছে ভুট্টার ক্ষেত। জোয়ার আসছে লাইটহাউসের সীমানায় – বড় বড় বোল্ডারকে টপকে চলে যাচ্ছে অনায়াস শীতলতায় – ফিরে চাইছেনা,হোঁচট খায়নি একবারও। উইন্ডমিল ঘুরে তাকাচ্ছে তার দিকে – ঘুরেই চলেছে অনাঘ্রাত টানে – জলজ ঘাস ফুটছে ভাঙা চাঁচের গায়ে, শালুকের পাশাপাশি। ওখানে ভিটে ছিল,দরজা ছিল। এখন জল প্রবল ঘূর্ণিতে ধেয়ে যায় – স্থবির, পরিশীলিত,ও সাজানো নির্জনতার দিকে। এই বিসর্জনের কোন নিয়ম নেই,ছন্দ নেই,ব্যতিক্রমও নেই।

পছন্দের পাথর পেরোলে সমস্ত স্রোত অভিবাসী
সব ঢেউ চেনা যায়
প্রগাঢ় আলাপ, তুমি কী সাঁতারে নামবেনা ?
দ্যাখো রোদ
আলোর ঝলক দ্যাখো –
যে কোন তীব্রতার পিছনেই একটি মেঘ
খামে মুড়ে তাকে আহুতি দিলাম
প্রথাগত ব্যাকুলতায়,  তোমার বিসর্জন হোক

Facebook Comments

One comment

  1. farhana mannan

    বাংলাদেশে মাল্টিপ্লেক্সবিহীন সিনেমা দেখেছি একটা সময় আমিও। তখনকার ঐ পুরনো ধাঁচের আলাদা একটা জেল্লা ছিল। পুরনো কাপড়ের ভাঁজের গন্ধের মতন। এখন অবশ্য এসির ঠাণ্ডা বাতাস ছাড়া আর চলে না! সময় আমাদের কতখানি বদলে দেয়!

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top