পর্ব-১।। পর্ব-২।। পর্ব-৩।। পর্ব-৪
গাজী তানজিয়া
দশ
প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান গম্ভীর মুখে বসে আছেন। তাঁকে খুব চিন্তিত দেখাচ্ছে। মাঝে মাঝে ওয়াইনের গ্লাসে চুমুক দিচ্ছেন। এ পর্যন্ত তিন পেগ খাওয়া হয়েছে। তার লিমিট চার পেগ। যতবার গ্লাসে ঠোঁট ছোঁয়াচ্ছেন ততবার তার চিন্তাটা আরো মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। ওয়াইনে আবার ভেজাল নেই তো! এই বাঙালী খানসামাকে কোনো বিশ্বাস নেই। এ বড় অদ্ভুত এক জাতি! মাথা গরম জাতি। ওরা যদি একবার ক্ষেপে যায় আর কোনো রকমে যদি রাস্তায় নেমে পড়তে পারে তাহলে আর রক্ষা নেই। দাবী আদায় করে ছাড়ে। এদের কীভাবে কন্ট্রোল করতে হয় হাড়ে হাড়ে জানেন তিনি কিন্তু ওই এক জায়গায় গিয়ে থেমে যেতে হয় শালা! গণতন্ত্র, মানবাধিকার যত্ত সব বাকোয়াস। এবার ওদের একটা কড়া টাইট দিতে হবে। ৫২’য় যা হয়েছে হয়েছে এবার আর নয়। সচেতনভাবেই হোক কি অচেতনভাবে ধীরে ধীরে বাঙালীরা পৃথক হওয়ার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। ঠাকুর তাদের ঈশ্বরে পরিণত হয়েছেন ডায়েরিজ অব ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান-ইউনিভার্সিটি প্রেস।)। এই ঠাকুর পুজা পাঠের ঠাকুর নন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। সব কিছুরই বাংলা করণ করা হয়েছে। এমন কি গড়ির নেমপ্লেটগুলোও বাংলায় লেখা। পশ্চিম পাকিস্তানের কেউ ঢাকায় গেলে নিজেকে বিদেশী ভাবতে থাকে। বাঙালীর মাথা থেকে ঠাকুরের ভূত টিপে বের করে ফেলতে হবে। পঞ্চম পেগ গ্লাসে ঢেলে পিএসকে ফোন লাগাতে বললেন মোনায়েম খাঁকে..।
পূর্ব-পাকিস্তানের গভর্নর মোনায়েম খাঁ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলাবিভাগের চেয়ারম্যান আব্দুল হাই সাহেবকে গভর্নর হাউজে ডেকে পাঠিয়েছেন। হাই সাহেব উদ্বিগ্নমুখে গভর্নর হাউজের লম্বা-চওড়া ড্রইংরুমে বসে আছেন। শুধু চেয়ারম্যান সাহেবই না গুরুতর বিষয়ে অভিযুক্ত আরো দু-চারজন ব্যক্তি বসবার ঘরে বসে উসখুস করছেন। কেউ কারো সাথে কোনো কথা বলছেন না।
বেশ কিছুক্ষণ পর হাই সাহেবের ডাক পড়ল গভর্নর সাহেবের খাস কামরায়। সেখানে একটা উঁচু রিভলভিং চেয়ারে বসে আছেন মোনায়েম খাঁ। বাংলা বিভাগের চেয়ারম্যান ঘরে ঢুকতেই কোনো রকম ভূমিকা না করে তিনি বললেন, কী করেন আপনারা বলেন তো!
কেন স্যার? কি হয়েছে।
ময়মনসিং কোর্টের এক সময়ের উকিল মোনায়েম খাঁ অনেকটা ধমকের সুরে বললেন, চারদিকে কি হচ্ছে আপনারা শুনতে পাচ্ছেন না?
কি ব্যাপারে? ঠিক বুঝতে পারলাম না স্যার।
ওই দাড়িওয়ালা হিন্দু বুড়োটাকে নিয়ে বাঙালীর এতো মাতামাতি কিসের? রবীন্দ্র সঙ্গীত, রবীন্দ্র সঙ্গীত, রবীন্দ্রনাথ, এসব কি?
আপনাদের ঘটে কি কোনো বুদ্ধি নেই? বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগের চেয়ারম্যান হয়েছেন, এতো সাহিত্য জানেন আর রবীন্দ্রসঙ্গীত লিখতে পারেন না!
এই প্রশ্নের কী উত্তর হয় হাই সাহেব জানেন না, তবে তাঁকে রবীন্দ্রসঙ্গীত লেখার একটা নীরব সম্মতি দিয়ে ওখান থেকে সেদিনের মতো উঠতে হলো।
মোনায়েম খাঁ সে দফা রবীন্দ্রসঙ্গীতের কোনো সুরাহা করতে না পারলেও ১৯৬৮ সালে আইয়ুব খান সাহেবের ঢাকাইয়া মন্ত্রী খাজা শাহাবুদ্দিন একদিন হঠাৎ ঘোষণা করলেন রবীন্দ্রসঙ্গীত ব্যান্ করা হলো। কথাটা শোনামাত্র গোটা শিক্ষিত বাঙালী জনগোষ্ঠীর মাথার ওপর যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়ল। বলে কি লোকটা!
সারাদেশের শিক্ষিত মানুষ মিছিল মিটিং সহ যত রকম প্রতিবাদের ভাষা আছে সব ব্যবহার করতে লাগল। বুদ্ধিজীবীরা পত্রিকায় এখানে সেখানে স্টেটমেন্ট দিতে লাগলেন। বর্শার ফলার মতো ধারাল প্রতিবাদ জেগে উঠল। কিন্তু ছফা ভাবলেন এভাবে স্টেটমেন্ট দিয়ে কিছু হবে না। মিনিংফুল একটা বই বের করতে হবে। যে বইয়ের ভেতরে সবাই রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে লিখবেন। ভাবনাটা ড. আনিসুজ্জামান স্যারকে জানালে তিনি বললেন, ‘আইডিয়াটা ভালো। তাহলে তুমি সবার কাছ থেকে লেখা জোগাড় করতে থাক।’
ছফা আর তাঁর বন্ধু শিল্পকলা একাডেমীর সেক্রেটারি কাজী সিরাজ পূর্ব বাংলায় রবীন্দ্রনাথের জন্য বন্ধ হয়ে যাওয়া দ্বার উম্মুক্ত করতে উঠে পড়ে লাগলেন। লেখা সহজেই পাওয়া যাচ্ছিল কিন্তু মূল সমস্যাটা তো গিয়ে দাঁড়ায় ওই বই আকারে প্রকাশিত হওয়ার পুলসুরতে গিয়ে! কোনো প্রকাশক রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে লেখা বই প্রকাশ করতে চায় না। শাসকগোষ্ঠীর খড়গের ভয় তো আছেই তার ওপরে অনর্থক অতগুলো টাকা কে ইনভেস্ট করতে চায়! তবে রাজরোষের ভয়টাই যে মুখ্য সেটা বুঝতে ছফার কষ্ট হয় না। তারপরও অনেক বলে কয়ে স্টুডেন্ট ওয়েজকে যদিও রাজি করানো হলো। তবে টাকা লাগবে চল্লিশ হাজার। প্রকাশক এর পেছনে কোনো টাকা ইনভেস্ট করতে পারবে না সাফ জানিয়ে দিল। ওদিকে ছফার জেদ চেপে গেছে। রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে প্রতিবাদী প্রবন্ধ সংকলন বের করতেই হবে। তাই লেখা সংগ্রহের পাশাপাশি সে ছুটছে টাকার খোঁজে প্রকাশককে দেয়ার জন্য।
ডক্টর মফিজ চৌধুরীর অফিসে গিয়ে আবারও হানা দিল সে। মফিজ চৌধুরীর সঙ্গে ততদিনে তার সম্পর্ক প্রায় পিতা-পুত্রের কাছাকাছি একটা জায়গায় এসে পৌঁছেছে। কোনো এক বিচিত্র কারণে মফিজ চৌধুরী ছফাকে ভয়াবহ পছন্দ করে বসেছেন। সেই যে বার্ট্রান্ড রাসেলের ম্যানুস্ক্রিপ্ট রেখে টাকা অনেকটা হাইজ্যাক করে নিয়ে যাওয়ার পর তাঁর সাথে ছফার দেখা হয় সাতষট্টি সালে বিএ পরীক্ষার রেজাল্ট বের হবার পর। বিএ পাশ করে মফিজ চৌধুরীকে তাঁর টাকাগুলো ফেরত দিতে যায় ছফা। মফিজ চৌধুরী তখন হেসে বলেন, আরে বেটা এ টাকা তোমাকে ফেরত দিতে বলেছে কে? এগুলো তুমি কর্জে হাসানা হিসেবে ধরে নাও।
ছফার এবারের প্রস্তাব শুনেও মফিজ চৌধুরী উৎসাহিত বোধ করলেন। বললেন, প্ল্যানটা তোমরা ভালই করেছ। তবে ওই ব্যাটা প্রকাশক এতো টাকা কেন চাইছে?
পাঁচ হাজার কপি তো তাই।
ওরা কোনো ছাড় দেবে না?
না, ছাপাতেই চায় না কেউ। তার ওপরে কনসেশান! ওরাতো তাও রাজি হয়েছে।
কিন্তু এতো টাকা তো আমার একলার পক্ষে এখন দেয়া সম্ভব না।
আপনার একলার দিতে হবে না, আপনি বরং আরো দু’একজনকে বলে দিন। আমরাও আরো অনেকের কাছে চেষ্টা তদবির করছি।
সে করছ কর প্রকাশককেও কিছু কমাতে বল। শোন ওদরেকে বোঝাও। ওরাতো ইতিহাসের একটা পার্ট হয়ে গেল এজন্য, সেজন্য কিছু ছাড় দেবে না!
মফিজ চৌধুরীর কথায় যুক্তি আছে। পরদিন ছফা আবার ছুটল বাংলাবাজার। যদি কাউকে বোঝানো যায়।
কিন্তু না কিছুই হলো না। ওদিকে মাঝখান দিয়ে মেজাজটা গেছে ভীষণ খিচড়ে।
একদিকে গরমে গনগনে সূর্য মাথার ওপরে। তার ওপরে রাগ, মনে হচ্ছে যেন ঘিলু ফুটছে টগবগ করে।
ছফা হনহন করে হাঁটছে ইউনিভার্সিটির দিকে। হঠাৎ পেছন থেকে কেউ এসে পিঠে হাত রাখল। কই যাও ছফা?
আরে সুনির্মল’দা, কেমন আছেন?
ভালো, কিন্তু তুমি এতো জোর কদমে কোথায় চললা?
মাথায় রাগ উঠে গেছে। রাগ উঠলে কেউ আস্তে হাঁটে আপনি দেখেছেন?
না, তা দেখি নাই তবে তোমার রাগের কারণ কি?
বাংলাবাজার থেকে আসতেছি। রাগের কারণতো বোঝাই যায়।
বুঝতে না পারলেও আঁচ করতে পারছি। হয় প্রকাশক রয়্যালটির টাকা নিয়ে ঘোরাচ্ছে, না হলে বই পাবলিশ করতে চাচ্ছে না।
না রয়্যালটির টাকা নিয়ে আবার ঘোরাবে কি। কেবল তো দুইটা মাত্র বই বের হয়েছে। একটা উপন্যাস আর একটা ‘তানিয়া’র অনুবাদ এ নিয়ে আর ….।
তাহলে নতুন বই?
হ্যাঁ, ওই রবীন্দ্রনাথ….।
ও বুঝেছি ওটা নিয়ে তোমার ফাইটিংটা তো সবাই জানে এখন। তো সেজন্যই তো বলি …! চলো তোমাকে এক জায়গায় নিয়ে যাই দেখবা রাগ-টাগ কিছু থাকবে না।
কোথায়?
আরে চলো না, দেখবা।
বাংলাবাজার থেকে হেঁটে হেঁটে গেণ্ডারিয়ার লোহার পুল পেরিয়ে বুড়িগঙ্গার পাড়ের একটা ছোট্ট একতলা বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে সুনির্মল’দা বললেন, চলো ভেতরে।
টিনশেড একতলা বাড়িটার ভেতরে একটা আড়ম্বরহীন বসবার ঘর। আসবাবপত্র বিশেষ নেই। একটা তক্তপোশের ওপরে হারমোনিয়াম, তবলা, তানপুরা পাশে পড়ার টেবিল, সামনে একটা চেয়ার, পাশে একটা বুকশেলফ সেখানে অন্যান্য বইয়ের সাথে সার বেঁধে দাড়িয়ে আছে বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু পাঠ্য বই। শেলফের একেবারে ওপরের তাকে একটা নীল রঙের চারকোনা কাচের ফুলদানি। সেখানে শোভা পাচ্ছে সদ্যছেঁড়া দু’গুচ্ছ রজনীগন্ধা। ছফার বুঝতে অসুবিধা হলো না যে এ বাড়িতে যারা থাকেন তারা যথেষ্ট রুচিবান এবং সংস্কৃতিমনস্ক। তবে মধ্যবিত্তের ঠাঁসবুনোটের ছাপও স্পষ্ট। ওই ঘরজোড়া তক্তপোশটাতে যে রাত হলে এক বা একাধিক মানুষ শোয় সেটাও বোঝা যায়। দিন হলে ওটাই বসবার ঘর হয়ে ওঠে।
এরই মধ্যে ঘরে প্রবেশ করল শ্যামলা রঙের যে মেয়েটা তার পরনে হালকা নীল রঙের তাঁতের শাড়ী, লম্বা চুল পেছনে এক বিনুনিতে বাঁধা। বয়স চব্বিশ-পঁচিশ হবে। দেখলে কেন জানি না বোঝা যায় এখনো বিয়ে করেনি। ঘরে ঢুকেই চটপটে ভঙ্গিতে মেয়েটা বলল, আরে, সুনির্মল’দা কখন এলেন? দেখেছেন, কাণ্ড! এতক্ষণ আপনাকে বসে থাকতে হলো। ছেলেটা দরজা খুলে দিয়ে ভেতরে গিয়ে আমাকে বলেনি যে আপনি এসেছেন। আমি ভাবলাম দাদার কাছে কেউ এসেছে বোধ হয়।
তাতে কি! খুব বেশি সময় তো অপেক্ষা করি নাই। তাছাড়া তোমার ভাবনাতেও বা ভুল কি আছে, আমি তো হেনার কাছে, তোমার কাছে তোমাদের সব ভাই বোনের কাছেই আসি এখন। চলো তোমাকে একজনের সাথে পরিচয় করিয়ে দেই। এইযে ইনি হলেন আহমদ ছফা। তরুণ লেখক। আমাদের দেশের যে কজন প্রতিশ্রুতিশীল লেখক আছেন ইনি তাঁদের মধ্যে একজন। তাছাড়া ওর আরো অনেক গুণ আছে কালে কালে তারও পরিচয় পাবে।
এসব বাড়িয়ে বলা আমার অত গুণ-টুন নেই। প্রতিবাদ করে ছফা।
কথাতো শেষ করতে দিলা না। শুধু গুণের কথা বলে ছেড়ে দেব ভেবেছ, সবচেয়ে বড় গুণটার কথা বলব না?
আরো বড় গুণ আছে! চোখ বড় বড় করে জানতে চায় মেয়েটা।
সে কি আর বলতে! সবচেয়ে বড় গুণ যেটা সেটা হলো ভীষণ বদরাগী। নাকের ওপর দিয়ে মাঝি উড়ে যাবার উপায় নেই, দু টুকরো হয়ে যায়।
সে বোঝাই যাচ্ছে। যা খাঁড়া নাক!
মেয়েটা ঠিক তার প্রশংসা করল কি নিন্দা করল বলার ভঙ্গিতে কিছুই বোঝা গেল না। তবে হঠাৎ চমকে উঠে বলল, আপনার পাঞ্জাবির বুকের কাছে ওই খুন খারাবির রঙ লাগিয়ে দিয়েছে কে?
সঙ্গে সঙ্গে চমকে উঠল সে। সেদিন সকালে উঠে গোসল সেরে একটা পাট ভাঙ্গা সাদা পাঞ্জাবি পরেছিল। বাংলাবাজারে গিয়ে একটা লাল কাপড়ের মলাট দেয়া বই কিনেছিল। সেই বইটা বুকের কাছে চেপে ধরে রোদের মধ্যে গরমের মধ্যে হাঁটাহাঁটির ফল এটা বুঝতে বাকি রইল না। এখন বইটা তার কাঁচা রঙের চিহ্ন গেড়ে বসেছে তাঁর বুকে।
ছফা একটু অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে বইটা দেখিয়ে বললেন, কখন মলাটের রঙ পাঞ্জাবিতে লেগে গেছে খেয়াল করিনি।
লক্ষণতো সুবিধার না, বলে মেয়েটা তার সুন্দর দাঁত দেখিয়ে হাসল।
কিছু কিছু শব্দ মানুষের হৃৎপিণ্ডের কম্পন বাড়িয়ে দেয়। কেমন এক ঝড় বয় মনের ভেতরে মেয়েটার হাসি তার ভেতরে তেমন অনুভূতি জাগিয়ে তুলছে কেন?
তার ভাবনায় ছেদ ফেলে সুনির্মল’দা বললেন, আর ছফা এ হচ্ছে তরু। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে, আমাদের পার্টি করে। খুব ডেডিকেটেট কর্মী।
এরপর তরু একে একে তার অন্য দু’বোনের সাথে পরিচয় করিয়ে দিল। যাদের মধ্যে একজন কলেজে পড়ে অন্যজন স্কুলে পড়ে এবং গান শেখে। তরুই ওদের অভিভাবক এখন। ওদের বড় ভাই সেও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছেন। ওদের বাড়ি দিনাজপুর। মূলত দিনাজপুরও নয় মূল বাড়ি মুর্শিদাবাদ। ৪৭’এর দেশভাগের সময় ওরা দিনাজপুরে এসেছে। ওর বাবার গোড়া রক্ষণশীল মুসলিম পরিবার। তারা নাকি ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে আরব দেশ থেকে ভারতবর্ষে হিযরত করেছিলেন। কলকাতার বাড়িতে তারা কেউ বাংলা ভাষায় কথা বলে না। বাঙলা মুসলমানের ভাষা হতে পারে না বলে মনে করে। সেই পরিবারে বৌ হয়ে আসেন তরুর মা। যিনি ছোটবেলায় শান্তিনিকেতনে বিশ্বভারতীতে লেখাপড়া করেছেন। বালিকা বয়সে তার মনে সংস্কৃতির রঙ লেগেছিল। কিন্তু বিয়ে হওয়ার পর শ্বশুর বাড়িতে এসে তিনি প্রকাণ্ড এক সমস্যার মধ্যে পড়ে যান। সবাই কথা বলে উর্দূ ভাষায়। তার সঙ্গে স্বামী আর দাসদাসী ছাড়া কেউ কথা বলে না। শ্বশুরবাড়িতে থাকার সময়ই তার মনে মুসলিম সমাজ সম্বন্ধে এক প্রচণ্ড ভীতি জম্মেছিল। তাই ভারতবর্ষ যখন দু’ভাগ হলো তখন স্বামীকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে তিনি পূর্ব-পাকিস্তানের দিনাজপুরে এসে বসত গাড়েন। সেখানেই তিনি তার পুত্র-কন্যাদের সংস্কারহীন সংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে বড় করার জন্য মনোযোগ দিলেন। বাড়িতে সব হিন্দু শিক্ষক নিয়োগ দিলেন। ছেলেমেয়েদের রবীন্দ্রনাথের গান শেখানো ও রবীন্দ্র সাহিত্য পড়ানোর এক অনমনীয় জেদ মহিলাকে পেয়ে বসল। এই ফাঁক দিয়ে প্রগতিশীল রাজনীতি, কমিউনিষ্ট পার্টি এসব একেবারে বাড়ির অন্তঃপুরে প্রবেশ করল। তরুরা তিন বোন যখন বড় হয়ে উঠল তখন তিনি তাদের দিনাজপুরে না রেখে আরো উন্নত শিক্ষার জন্য ঢাকায় স্থায়ীভাবে রেখে লেখাপড়া গানবাজনা শেখাবার একটা উপায় বের করলেন। তিনি দিনাজপুরের কিছু সম্পত্তি বিক্রি করে গেণ্ডারিয়ায় এই ছোট্ট বাড়িটা করে দিলেন। বাড়ির পেছনের ছোট্ট খালি জায়গাটাতে একটা স মিল বসিয়ে দিয়ে ছোট ছেলেকে তার দেখা শোনার দায়িত্ব দিলেন। আর তিনি যেহেতু ঢাকায় থাকতে পারবেন না তাই সংসার দেখার ভার দিলেন বড় মেয়ে তরুর ওপর।
অল্প কয়েকদিনের মধ্যে তরুদের বাড়ির সবার সঙ্গে ছফার বিশেষ ভাব হয়ে গেছে। মূলত তরু তাকে ভীষণভাবে আকৃষ্ট করে ফেলেছে। এমন মেয়ে সে এর আগে কখনো দেখেনি। একটা তরুণী মেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে, বাজনীতি করছে, সংসার সামলাচ্ছে, বোনদের কলেজে পাঠাচ্ছে, গানের টিচারের কাছে পাঠাচ্ছে, খাচ্ছে, খাওয়াচ্ছে, রাঁধছে, বাড়ছে, সব জায়গায় যেন একটা ঘূর্ণির বেগ জাগিয়ে দিয়ে যাচ্ছে। কখনো খলখল হাসিতে অপরূপা লাস্যময়ী। কখনো দিগ্বিদিকজ্ঞান হারিয়ে প্রচণ্ড রাগে ফেটে পড়ছে। একে ধমক দিচ্ছে, তাকে শাসাচ্ছে, সদা চঞ্চল, সদা প্রাণবন্ত। আবার কখনো চুপচাপ গম্ভীর। তখন তাকে ধরাছোঁয়ার বাইরে অত্যন্ত দূরের মানবী মনে হয়। যেন কোনো পুরুষের বাহুবন্ধনে ধরা দেয়ার জন্য তার জম্ম হয়নি। কোনো শাসন বারণ মানে না। ছফা এক গভীর ঘোরে ছুটে যায় সেখানে বার বার।
ওদিকে রবীন্দ্রনাথ পুনরুদ্ধার প্রকল্পও পুরো প্রস্তুত। সংকলন গ্রন্থটির এডিটিং পর্ব চলছে এমন সময় প্রফেসর মুনির চৌধুরী সাহেব বেঁকে বসলেন। তিনি বললেন, কোন নতুন লেখকের লেখা ওই সংকলনে থাকলে তিনি লেখা দেবেন না।
তরুণ লেখকদের মধ্যে শুধুমাত্র ছফার লেখা ওই সংকলনে থাকছে। একটা বিষয় নিয়ে রাষ্ট্রের একটা সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে সে এতোবড় একটা কাজে নেমেছে, সেই সেখানে তার একটা লেখা থাকতে পারবে না!
ড. আনিসুজ্জামানকে ক্ষোভের সাথে কথাটা জানাল ছফা। ড. আনিসুজ্জামান মুনির চৌধুরীর খুব প্রিয় ছাত্র। তিনিও প্রফেসর সাহেবের দারুণ ভক্ত। এই ঘটনায় তিনি খুব অস্বস্তিতে পড়লেন। তিনি কিছুক্ষণ ভেবে নিয়ে ছফাকে বললেন, দেখ স্যারের তো এই ধরনের একটা এ্যলিটিস্ট ব্যাপার আছে লেখার ক্ষেত্রে। আর এটা তিনি মেনটেন করেন। কিন্তু এক্ষেত্রে তোমার যা কন্ট্রিবিউশন, তোমাকেও তো না করা যায় না। ভেবে দেখ কি করবে! এক কাজ করো।
কি কাজ? হঠাৎ তার চোখে তারার ঝিলিক দেখা গেল।
ট্রাই টু প্রুভ ইয়োরসেলফ। যে লেখাটা তুমি এই সংকলনে দিতে চাও, তাকে একটু ঘাট পথ চিনিয়ে আনো।
ওকে স্যার, থ্যাংকস্ ফর ইয়োর এ্যাডভাইস।
ছফার ভেতরের সেই জেদী, একরোখা ঘোড়াটা আবার ক্ষেপে বসেছে। তাকে এক হাত দেখে নিতে হবে। সেই ক্ষেপা ঘোড়া হাঁটতে হাঁটতে তরুদের বাড়িতে গিয়ে হাজির।
কোথা থেকে এলেন ছফা ভাই? এমন ছন্নছাড়ার মতো চেহারা হয়েছে কেন আপনার? কোমরে হাত দিয়ে অনেকটা আদেশের স্বরে জানতে চাইল তরু।
আর বলো না রবীন্দ্রনাথকে পার করতে গিয়ে আমার পরপারে যাওয়ার অবস্থা হয়েছে।
একই অবস্থা আমাদের বুলারও হয়েছে। আঘাতটা আপনার যতটা, ওরও কিছু কম না।
ক’দিন ধরে দেখেন কেমন মুখ ভার করে ঘুরে বেড়াচ্ছে। রেয়াজ-টেয়াজ কিছু করছে না।
কেন?
রেয়াজ করতে বললে বলে, ‘রেডিওতে রবীন্দ্রসঙ্গীতের প্রোগ্রামতো বন্ধ আপা। এখন আমি কি গাইব? আমার কোনো প্রোগ্রাম নেই।’
বলি, অন্য গানতো গাইতে পারিস, অন্য কোনো প্রোগ্রামে তোকে ডাকতে পারে তখন। মেয়ের সেই একই জেদ, ‘না, অন্য কোনো গান গাইব না। আমি রবীন্দ্রসঙ্গীতের এনলিস্টেও শিল্পী আমাকে অন্য কোনো গান গাইতে ডাকবে ভাবছ! আর ডাকলেইবা, আমি যাব কেন?’
আমি ওকে বাজিয়ে দেখবার জন্য বলি, কেন অন্য গান কি গান না? তখন ওইটুকু মেয়ে আমাকে কি বলে জানেন? বলে, ‘তাহলে তো আর প্রতিবাদ করা হলো না। ওদের শাসন মুখ বুঁজে মেনে নেয়া হলো।’
বুলা কিন্তু ঠিকই বলেছে, গেল কোথায় সে?
বাড়ি নেই। ওর গানের গুরু ওয়াহিদ ভাইয়ের সাথে গেছে।
আসলে বলবে ওর এক প্যাকেট লজেন্স পাওনা হয়েছে আমার কাছে। আর তোমারও।
আমার কেন?
বুলা এই স্পিরিটটা তোমার কাছে পেয়েছে তাই।
আপনার স্পিরিটও কিছু কম নেই। আমরা তো দেখি আর অবাক হই।
অবাক হওয়া-হওয়ির কিছু নাই। এখন এক কাপ চা দাও। খেয়ে বিদায় হই।
এতো তাড়াতাড়ি! তরুর বুকের ভেতরটা যেন হঠাৎ খালি হয়ে গেল।
হ্যাঁ, আজ অনেক কাজ আছে, এই পথ দিয়ে যাচ্ছিলাম ভাবলাম তোমার সাথে একটু দেখা করে যাই।
কিন্তু আপনার কি জন্য পরপারে যাওয়ার অবস্থা হয়েছে সেটা বললেন না তো!
ও তেমন কিছু না। আচ্ছা তোমার কি মনে হয় তরু বাঙালীকে চাইলেই দমিয়ে রাখা যায়?
তাও কি সম্ভব! আমরা এতো সহজে ছেড়ে দেব!
আমাদের ভাষা আর সংস্কৃতি নিয়ে এই লড়াইটা যে কবে শেষ হবে! এই বাংলা ভাষাটা নিয়ে যুগে যুগে যত লড়াই সংগ্রাম হয়েছে এমন ইতিহাস আর কোনো ভাষার ক্ষেত্রে খুঁজে পাওয়া যাবে না। বাংলাভাষা অনেকটা অচ্ছুৎদের ভাষা ছিল জান। লেটলি যখন হোসেন শাহরা রাজত্ব করতে এলেন। তাঁরা দেখলেন যে বাংলাদেশে তাঁদের রাজত্ব করতে হবে। কিন্তু দিল্লির যে রাজত্বটা আছে আর সেটার যে ভাষা আছে এগুলো হচ্ছে ফারসি, সংস্কৃত অথবা আরবি। এসব ভাষা এখানে চলবে না। বাংলা ভাষাটাকে তারা গুরুত্ব দিল এই কারণে। এখানে যখন রাজত্ব করতে চাইল তখন এখানকার একটা ভাষা তাঁদের তৈরি করতে হবে, রাজনৈতিক নিরাপত্তার জন্যে। যেহেতু উর্দূ, ফার্সি, আরবি কিংবা সংস্কৃত এই ভাষাগুলো দিল্লির দরবারের সুতরাং এদের কাছ থেকে তিনি কোনো আনুগত্য আশা করেন না। সে কারণেই বাংলা ভাষাকে রাজভাষা করে তিনি অনেক পেট্রোনাইজ করেছেন। এমন কী শ্রী চৈতন্যেরও পেট্রোনাইজ করেছেন। সে কারণে বাংলাভাষাটা মুসলমানেরও কিন্তু। দে স্ট্রাগলড হার্ড। তাদের আইডেনটিটি ওই ভাষায় তুলে ধরার জন্য।
অথচ ওরা, মানে পশ্চিম পাকিস্তানীরা এখনো এটা মানতে চায় না দেখেছেন? ওরা ওদের সুবিধার্থে ওদের ভাষা চাপিয়ে দিতে চেয়েছিল এখন আবার আমাদের সংস্কৃতি থেকে আমাদের বিচ্ছিন্ন করতে চায়।
নইলে ওরা শোষণ করবে কী ভাবে? ওরা রাষ্ট্র পরিচালনায় ওদের নের্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত করতে চায়। তাই রাঙালীকে দমিয়ে রাখার এক একটা কৌশল বের করে এক এক সময়।
আচ্ছা ছফা ভাই ও কথা থাক। আপনি বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ডিপার্টমেন্টে পড়েছেন, আবার পরীক্ষা দিলেন গিয়ে প্রাইভেটে বি-এ। এখন আবার রাষ্ট্র বিজ্ঞানে মাস্টার্স করতে গেলেন কেন?
কেন আমার কি নানা বিষয়ে পড়তে নিষেধ?
আপনি কিন্তু এড়িয়ে যাচ্ছেন।
হুম্? অন্যমনস্ক ছফা কোন সূদূর পার থেকে যেন জবাব দিচ্ছে।
আপনি কি কিছু ভাবছেন?
ছফা এখন ভাবছে তার লেখাটা ঠিক কোন জায়গায় ছাপা হলে, সেটা ওই সংকলনে ড. মুনির চৌধুরীর স্টাটাসকে খাটো না করেই অবস্থান নিয়ে নিতে পারে।
হ্যাঁ, পেয়েছি।
কী পেয়েছেন?
লেখাটা সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে পাঠাব।
কোন লেখাটা?
আমি এখন উঠি তরু। ওহ্ চা-টা কিন্তু দারুণ ছিল।
ছফা ওভাবে কী একটা ঘোরের মধ্যে যেন উঠে চলে গেলেন। তরু মাঝে মাঝে এই লোকটার আচরণের মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝে উঠতে পারে না।
ছফার লেখাটা সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুর সম্পাদিত ‘রবীন্দ্র প্রসঙ্গ’ নামক পত্রিকায় ছাপা হলো। এবং মজার ব্যাপার হলো প্রবন্ধটা সৌমেন্দ্রনাথ কিছুটা অনুবাদ করে ‘স্টেটসম্যান’ পত্রিকায়ও ছাপালেন।
গোটা ব্যাপারটা ছফার জন্য একটা শক্তি হয়ে গেল। তারপরও সংকলনে তার লেখা থাকা না থাকা নিয়ে তার সংশয় দূর হচ্ছে না।
পরের দিন ভোরে পাতলাখান লেনে গিয়ে সংকলনের ম্যানুস্ক্রিপ্ট বের করে ছফা। ম্যানুস্ক্রিপ্ট থেকে ড. মুনির চৌধুরির লেখাটা বের করে পড়তে শুরু করে। পড়তে পড়তেই তার ঠোঁটে একটা হাসির রেখা ফুটে ওঠে। সে সোজা লেখাটা নিয়ে চলে যায় বইটার সম্পাদক ড. আনিসুজ্জামানের কাছে।
স্যার মুনির স্যারের এই লেখাটা ছাপা যাবে না।
মানে! আঁতকে ওঠেন আনিসুজ্জামান।
বুঝতে পারছি মুনির স্যার ব্যাস্ত মানুষ তাই বলে তিনি এরকম একটা গা-ছাড়া লেখা দেবেন?
কেন কি লিখেছেন তিনি?
এই যে দেখেন এই প্রবন্ধে। রবীন্দ্রনাথের কোটেশনে দিয়েছেন বাইশ লাইন আর তিনি লিখেছেন সতের লাইন।
যা লিখেছেন তাই নাও। ওনার মতো গুণী মানুষ কলম ছোঁয়ালেই হলো।
না, সেটা হবে না, আপনি এই লেখাটা বদলে দিতে বলেন।
সেটা কি করে সম্ভব! আমি তাঁকে গিয়ে এ কথা বলতে পারব না। তিনি আমার গুরু তাছাড়া আমার ডিপার্টমেন্টের বস্।
তাহলে কি আমি বলব?
অ্যাজ ইউ উইশ। তার আগে বলত, তুমি এটা কেন করতে চাচ্ছ?
স্যার অফেন্স ইজ দ্যা বেষ্ট ডিফেন্স। স্যার তো আমাকে ভেটো দিয়েছেন এবং দেবেনও তাই আমিও…। ছফা লক্ষ করল ড.আনিসুজ্জামানের মুখটা নীল হয়ে যাচ্ছে।
ওখান থেকে বের হয়ে ড. মুনির চৌধুরীর রুমে ঢুকল ছফা।
স্যার আসব?
আসো।
কি একটা প্রশাসনিক ফাইল দেখছিলেন, সেখান থেকে মুখ তুলে বললেন, তুমি, কেন আসছ?
স্যার আপনার লেখাটা নিয়ে একটা কথা বলতে আসছি। সহসাই কপাল কোঁচকালেন তিনি, প্রচ্ছন্ন বিরক্তির ছাপ চোখে মুখে।
কি বলতে চাও?
স্যার আপনি এই লেখাটা বদলে দেন।
কেন?
স্যার এই লেখায় কোটেশনের তুলনায় আপনার আলোচনা কম।
তিনি তাঁর এই গোঁয়ার ছাত্রের সাথে আর কোনো কথা বলে সময় নষ্ট না করে বললেন, ঠিক আছে যাও।
দু’দিন পর তিনি একটা নতুন লেখা দিয়ে দিলেন, কিন্তু ছফার লেখা ছাপা হওয়া না হওয়া প্রসঙ্গে কোনো কথা বললেন না।
অবশেষে ড. আনিসুজ্জামানের সম্পাদনায় সংকলন গ্রন্থটি স্টুডেন্ট ওয়েজ থেকে প্রকাশিত হলো। সেখানে সবার শেষে ছফার লেখা প্রবন্ধটির নাম ‘রবীন্দ্রনাথের সংস্কৃতি সাধনা’।
সংকলন গ্রন্থটা প্রকাশিত হওয়ার পর ছফার মাথায় পত্রিকা প্রকাশের ভূত চেপে গেল। তখন উনিশশো উনসত্তর সাল। আইয়ুব খাঁর দুঃশাসনের বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠেছে মানুষ। চারিদিকে আন্দোলনের কেমন একটা সাজ সাজ রব পড়ে গেছে। এমন সময় ছফা একদিন রণেশ গুপ্তকে বলল, রণেশদা একটা সাহিত্য পত্রিকা বের করব ভাবছি। আর পত্রিকার একটা নামও ভেবে ফেলেছি- ‘স্বদেশ’।
বাহ্ ব্রিলিয়ান্ট নাম তো! স্বদেশ নিয়ে এমনিতেই তো আমরা একটা বিরাট আইডেনটিটি ক্রাইসিসে পড়ে গেছি।
হ্যাঁ, তাইতো এই নামটাই মনে এলো।
ঠিক আছে করো, আর কে কে থাকবে?
আর থাকবেন, সত্যেনদা , ড. মফিজ চৌধুরী, সন্তোষ’দা….. আর কাকে নেয়া যায়?
আর আলীম সাহেব, সরদার ফজলুল করীম।
উপদেষ্টা হিসেবে ড. আহমদ শরীফ স্যারকে নেব ভেবেছি। স্যারের সাথে কথাও বলেছি। তিনি রাজি হয়েছেন।
সম্পাদক কে থাকবে?
এখনো ঠিক করিনি।
তুমি থাক।
আমি?
কেন না? তুমিই থাকবে।
মুনতাসীর মামুন আর অসীম সাহাও থাকতে চাচ্ছে।
ওরাতো তোমার জুনিয়র, ওরা সহকারী সম্পাদক হিসেবে থাকবে।
ইন্দিরা রোডে ড. মফিজ চৌধুরীর বাড়িতে মিটিং বসেছে। মিটিং-এ সিদ্ধান্ত নেয়া হলো বিজ্ঞাপন সংগ্রহের দায়িত্বও ছফার। ও ছাড়া এই কাজ আর কারো পক্ষে করা সম্ভব নয়। এই সব বাঘা বাঘা ব্যক্তিরা সবচেয়ে দুরূহ কাজটা যে তার ওপরে চাপিয়ে দেবেন এটা ছফা আগেই বুঝতে পেরেছিল। সেদিন থেকে শুরু হলো তার ‘স্বদেশ’ প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম।
ইউনাইটেড ব্যাংকের কাছ থেকে ভালো এ্যামাউন্টের বিজ্ঞাপন পাওয়া যেতে পারে তাই ওই ব্যাংকের পিআরও সাইয়িদ আতিকুল্লা সাহেবের সাথে দেখা করতে গেল ছফা।
দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষার পর দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই ছোটখাট ভদ্রলোকটি তার চোখের দিকে তাকিয়ে খুব কড়া এবং খাড়া স্বরে জানতে চাইলেন, কি চাই?
তার প্রশ্নের ধরন দেখে ছফা থতমত খেয়ে গেল। বসতে সাহস হলো না। আমতা আমতা করে বলল, বিজ্ঞাপন চাইতে এসেছি।
বিজ্ঞাপন চাইতে এসেছেন? এই প্রশ্ন করে মিনিটখানেক চুপচাপ থাকলেন তিনি। তারপর চোখেমুখে যথেষ্ট বিরক্তি ছড়িয়ে বললেন, কিসের বিজ্ঞাপন?
আমরা একটা সাহিত্য পত্রিকা বের করছি। সেই পত্রিকার জন্য বিজ্ঞাপন।
পত্রিকার সম্পাদক কে?
আমি।
এবার ছফার পা থেকে মাথা পর্যন্ত চোখ বোলালেন তিনি। তারপর হাতের কলমটা ঠোঁটে ঠেকিয়ে বললেন, লেখাপড়া কতটুকু করছেন?
প্রশ্নটা যথেষ্ট অপমানকর। তারপরও পত্রিকা বের করতে গেলে এমন দু’একটু অপমান হজম করে নিতেই হবে। তাই বলল, এম.এ পরীক্ষা দেব।
পিআরও সাহেব এবার চেয়ারে হেলান দিয়ে বেশ আয়েসি ভঙ্গিতে বললেন, এসব বনের মোষ তাড়ানো বাদ দিয়ে লেখাপড়াটা ভালোভাবে করলেই পারেন।
এবার তার কথা শুনে ছফার শরীর জ্বলতে শুরু করল। ভাবল বিজ্ঞাপন না হয় না-ই পেলাম। কিন্তু এই ঠোঁটকাটা দাম্ভিক ভদ্রলোকটির কথাবার্তার একটা জবাব দেয়া প্রয়োজন। সে তার সব সঙ্কোচ ঝেড়ে ফেলে সামনে রাখা চেয়ার টেনে বসে পড়ল এবং বলল, লেখাপড়া শেষ করে জীবিকা অর্জনের জন্য একটা চাকরি নেয়ার মধ্যেই বুঝি মানুষের সব দায়িত্ব শেষ হয়ে যায়?
মানে! ঘটনার আকস্মিকতায় অপ্রস্তুত হয়ে পড়লেন পিআরও সাহেব।
শুধু জীবিকা অর্জনের জন্য যদি শিক্ষা হয় তাহলে এতদূর পড়বার দরকারই বা কি? আপনি হয়ত বদরুদ্দিন উমরের নাম শোনেন নি, তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতার চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন। কেন বলতে পারেন?
কেন?
সেকথা আপনার মতো ছাপোষা লোক বুঝবে না। জীবিকা অর্জনই যার জীবনের একমাত্র ও শেষ উদ্দেশ্য।
কি বলতে চান আপনি? হাউ ডেয়ার ইউ!
চেঁচাবেন না। লেট মি ফিনিশ। সাহিত্যের মধ্যে সমাজ চেতনা ভ্রূণের মতো লুকিয়ে থাকে। সে কথা হয়ত আপনি জানেন না। জানার কথাও না। মানুষ কেন মানুষ জানেন? কারণ তার জীবিকার বাইরে অন্যকে দেবার মতো আরো কিছু আছে। মানুষ সব কিছুর সংজ্ঞা আবিস্কার করে, কিন্তু সে নিজে সংজ্ঞার অতীত একটা সত্ত্বা। মানুষের হাত থেকে বেরিয়ে এসেছে কৃৎকৌশল, মগজ থেকে বিজ্ঞান, অন্তর থেকে শিল্পকলা, দর্শন এবং ধর্ম। মানুষ ধর্মের কল্পনা করেছে, কিন্তু ধর্মের অনুশাসন যখন প্রাণের প্রকাশপথ রোধ করে দাঁড়ায় মানুষ তার বিরোধিতা করারও ক্ষমতা রাখে।
কথাগুলো এক শ্বাসে বলে ছফা বেরিয়ে আসছিল এমন সময় সাইয়িদ আতিকুল্লা বললেন, চলে যাচ্ছেন যে! এই চেয়ারে বসে থাকা ভদ্রলোক মানুষ নন সেটা প্রমাণ করে দিয়ে আপনি বিজয়ী হতে চান?
মানে?
কেন, আপনি আপনার পত্রিকার জন্য বিজ্ঞাপন চান না?
চাই বই কি! কিন্তু সেজন্য ….।
সেজন্য কি? আচ্ছা আসামাত্র বিজ্ঞাপনটা যদি দিয়ে দিতাম, তাহলে কি এই লেকচারটা শোনা হতো? বসুন, চা খান, বিজ্ঞাপন নিয়ে তারপর যাবেন তো।
আতিকুল্লা সাহেবের সাথে সেই থেকে ছফার ভীষণ ভাব হয়ে গেলেও প্রয়োজনীয় বিজ্ঞাপনের অভাবে ‘স্বদেশ’ পত্রিকা তিন সংখ্যা বের হওয়ার পর বন্ধ হয়ে গেল। কিন্তু পরাজয়ে দমে যাওয়ার পাত্র তো ছফা নন, তাই তার মাথায় আর একটা নতুন আইডিয়া খেলে গেল।
আইয়ুব খান প্রেসিডেন্ট হাউসে অস্থির পায়ে পায়চারী করছেন। সকালে মোনায়েন খান দেখা করতে এসে পূর্ব-পাকিস্তানের আইন শৃঙ্খলার যে পরিস্থিতি বয়ান করলেন তাকে খারাপ বললেও কম বলা হয়। বেসামরিক প্রসাশন সম্পূর্ণ অকার্যকর হয়ে গেছে। দুষ্কৃতকারীরা ছাড়াও ভাসানীর উস্কানিতে কমিউনিস্ট ও সন্ত্রাসীর দল থানা অবরোধ করছে। মুসলিমলীগারদের বাড়িঘর ও সম্পত্তিতে হানা দিচ্ছে। মৌলিক গণতন্ত্রকামী চেয়ারম্যান ও মেম্বারদের পদত্যাগ করার জন্য চাপ দিচ্ছে। কোথাও বাধা দেয়া হলে বাধাদানকারীকে হত্যা করা হচ্ছে। ফলে অধিকাংশ বেসামরিক কর্মকর্তা অফিস ও পদ ছেড়ে চলে গেছে। খাজনা আদায়কারীরা পালিয়েছে, বাজারে খাদ্য সামগ্রী আনতে বাধা দেয়া হচ্ছে। বিতরণকারীদের গুদাম থেকে মাল তুলতে দেয়া হচ্ছে না। রেশনের জন্যও বিতরণ করা যাচ্ছে না। উদ্দেশ্য কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে জনগণকে দিয়ে ভুখা মিছিল বের করাবে। আগে আওয়ামীলীগ, বামপন্থী বা কমিউনিষ্ট এরা শুধু শহরকেন্দ্রীক ছিল। গ্রামে খুব একটা প্রভাব বিস্তার করতে পারে নি, এখন এরা গ্রামেও যথেষ্ট প্রভাবশালী। আওয়ামীলীগ বাঙালি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী। পশ্চিম পাকিস্তানের সাথে সম্পর্ক থাকুক এটা তারা চায় না। তাদের চাওয়া প্রদেশটিকে আলাদা করে নিজেদের ইচ্ছা অনুযায়ী শাসন করা। ওদের লাইনে ফিরিয়ে আনতে গোয়েন্দা সংস্থা বেশ কিছু গোয়েন্দা টিপস দিয়েছিল কিন্তু তা প্রয়োগ করে কোনো ফল হয়নি।
এখন ফল পাওয়ার একটাই উপায়। মোনায়েম খাঁর জনপ্রিয়তা যেহেতু শূন্যের কোঠায় এমন কি তার জীবনও ঝুঁকির মুখে তাই তাকে গভর্নর পদ থেকে সরিয়ে দিতে হবে। আর সেখানে আনতে হবে ড.নুরুল হুদাকে। তিনি বুদ্ধিজীবী মানুষ। তাকে এজন্য অত্যন্ত সম্মানের চোখে বিবেচনা করা হয়। একবার গভর্নর হয়ে গেলে তার গ্রহণযোগ্যতা কতটা থাকে তা দেখার বিষয়। কাজ করে জনপ্রিয় থাকা যাবে- বাংলা সে জায়গা নয়। দুই পাকিস্তানেই তাঁর ক্ষমতা ধরে রাখা অসম্ভব হয়ে উঠেছে।
এর সপ্তাহ খানিক পর ২৫মার্চ ১৯৬৯ এক গণ অভ্যুত্থানের মুখে আইয়ুব খানকে সরিয়ে ইয়াহিয়া খান সামরিক শাসন জারি করেন।