পর্ব-১।। পর্ব-২।। পর্ব-৩।। পর্ব-৪ ।। পর্ব-৫
গাজী তানজিয়া
এগার
মহৎ কর্মযজ্ঞের ভেতরেই মানুষের জীবনের সার্থকতা লুকিয়ে থাকে। তবে এই মুহূর্তে জীবন সার্থক কি ব্যর্থ সেই চিন্তা ছফার নেই। তার এখন একটাই ভাবনা সাহিত্যের জন্য কিছু একটা করা দরকার। সেজন্য সাহিত্য-সভা করাটা ভীষণ জরুরী। বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতির বিকাশের সাথে আড্ডার একটি অঙ্গাঙ্গী সম্পর্ক আছে। আড্ডার সাথে সম্পর্কহীন যে সাহিত্য সৃষ্টি হয় তাকে সাহিত্য না বলে গ্রন্থপণ্য বলাই ভাল। কাপ্তানবাজারের হোটেল নাইল ভ্যালিতে শুরু হলো সাহিত্য সভা। আবুল হাসান, শশাংক পাল, নির্মলেন্দু গুণ, আবুল কাশেম, কায়েস আহমেদ, মোহাম্মদ শাহজাহান, সানাউল হক খান এরা নিয়মিত এসে সভা গরম করে তোলেন। কিন্তু কবি সাহিত্যিকদের একটানা চেয়ার টেবিল আটকে আড্ডা দেয়ার কারণে নাইল ভ্যালির ব্যবসা লাটে ওঠার জোগাড় হলো। তাই কিছুদিনের মধ্যে ওখানকার আড্ডা গোটাতে হলো। নতুন ঘাটি বসল ফরাসগঞ্জের লালকুঠিতে। মিউনিসিপ্যালিটির কর্মচারী ছিলেন সদরুদ্দীন মুন্সী। ভদ্রলোক পাগলাভোলা মানুষ। মাসে-ছমাসে একবার উম্মাদ হয়ে যান তখন তার শরীরে বস্ত্রের লেশমাত্র থাকে না। সেই সদরুদ্দীন মুন্সী আবার এইসব লেখকদের খুব সমাদর করেন। লালকুঠিতে একটা ছোট্ট লাইব্রেরীতে তিনি এঁদেরকে বসতে দিলেন। আর মাঝে মাঝে বৃষ্টি বাদলার দিনে, এই তরুণ জ্ঞান ভিক্ষুকদের জন্যে লাইব্রেরিটি উম্মুক্ত করে দিয়ে বই ধার দিতেন। সবই ছিল তার খেয়ালের ওপর।
তবে লালকুঠিতে রোজ নয়, ওখানে সপ্তাহে একদিন একটা আসর বসতে লাগল। লালকুঠির সাহিত্য সভায় বড়দের মধ্যেও অনেকেই আসতে লাগলেন। শামসুর রহমান, শিল্পী হারাধন বর্মন। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই লালকুঠির পাটও উঠে গেল।
কারণ ফরাসগঞ্জের মাওলা সর্দার সাহেব ওখানে দেশ বিরোধী ষড়যন্ত্রের গন্ধ খুঁজে পেল। এখানে যারা আসে তারা আইয়ুব খান বিরোধী আন্দোলনের মতো ষড়যন্ত্রে শরীক। সুতরাং এদেরকে এখানে আড্ডা দিতে দেয়া যায় না। সর্দার মওলা ফরাসগঞ্জের ওই এলাকার চেয়ারম্যান। সুতরাং তার ওপরে মহৎ দায়িত্ব অর্পিত হলো এঁদেরকে ওখান থেকে উৎখাত করার। লালকুঠি থেকে উৎখাত হয়ে আড্ডাটি ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল। এখন আড্ডা বসে ছাড়া-ছাড়া ভাবে। কখনো রফিক সেরনিয়াবাতের বোনের বাড়ি। আবার বারিন্দার গৌড়ীর মাঠের উল্টোদিকে রফিকের বাড়ির চিলেকোঠা তো আছেই। ছন্নছাড়া কবি, লেখক, গায়ক, শিল্পী, রাজনৈতিক কর্মী যে যখন ইচ্ছা ঘুমিয়ে থাকতে, আড্ডা দিতে আবার নির্বিবাদে ঝগড়াঝাটি করে যেতে পারে। তবে সেখানে কবি জসিমউদ্দীন সাহেবের আনাগোনা ছিল বেশি। তরুণ কবিরা তাকে যথাসম্ভব এড়িয়ে যেতে চাইত। তবে সেটা ভিন্ন কারণে। তিনি যে বয়স্ক কবি ছিলেন সে কারণে না। আবার তিনি আধুনিক কবিতার প্রতি বিরূপ ছিলেন সে কারণেও না। কারণটা ছিল অন্যখানে। তিনি সুদর্শন কিশোরদের প্রতি একটু বেশি দুর্বল ছিলেন। হতে পারে এটা তাঁর লেখার উপকরণ খোঁজার প্রয়োজনে, তবে তাঁর এই দুর্বলতা অন্যদের বিরক্তির কারণ হয়ে উঠত কখনো কখনো।
এরপর আড্ডা গেল বাংলাবাজারের বিউটি বোর্ডিং-এ, গোবিন্দের চৌরঙ্গীতে। আড্ডা ক্রমাগত ঘুরছে আর উৎখাত হচ্ছে। তাঁরা সপ্তাহে বা পনেরদিন অন্তর বসার নতুন নতুন জায়গা খুঁজে বের করছেন আর বিতাড়িত হচ্ছেন। সে সময়ে ছফার দুটি বই প্রকাশিত হয়ে গেছে। সে সুবাদে লেখক সত্যেন সেনের সাথে তার ঘনিষ্ঠতাও বেড়েছে। তাই সত্যেন সেন একদিন তাদেরকে আজিমপুর ইডেন কলেজের অধ্যাপিকা এবং রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী সানজিদা খাতুনের বাসায় নিয়ে গেলেন। এই বাড়িটা আড্ডাস্থল বা সাহিত্য পাঠের আসর হিসেবে পেয়ে সবাইতো দারুণ খুশি। তরুণদের মধ্যে সানজিদা খাতুন ও তাঁর স্বামী ওয়াহীদুল হকের একটা উজ্জল ভাবমূর্তি আছে। সাহিত্যবাসর এখন সানজীদা খাতুনের বাসায় বসে একথা জানিয়ে কবি শামসুর রহমানকে ওখানে টেনেটুনে জোরাজুরি করে নিয়ে যাওয়া হলো। সত্যেন’দা তো থাকতেনই রোজ। তিনি স্যাণ্ডেল জোড়া খুলে ডিভানের ওপর পা তুলে বসতেন। একদিন ওই আসরে সানজিদা খাতুনের ছোট বোন ফাহমিদা খাতুন এলেন। তিনিও রবীন্দ্রসঙ্গীতের শিল্পী। কবি আবুল কাশেম আবার সেদিন একটা নতুন কবিতা লিখেছে। সে সেটা পড়ে শোনাবে। কিন্তু সেদিকে সেদিন কারো বিশেষ মন নেই। তারা সবাই ফাহমিদা খাতুনের গান শোনার জন্য উদগ্রীব। এভাবে একটু আধটু অনুরোধের পর ফাহমিদা গাইতে শুরু করলেন।
“আহা তোমার সঙ্গে প্রাণের খেলা, প্রিয় আমার ওগো প্রিয়
বড়ো উতলা আজ পরান আমার, খেলাতে হার মানবে কি ও।”
ফাহমিদার কিন্নর কণ্ঠ ছড়িয়ে গেল ঘরময়। ওয়াহীদুল ভাই এসে এর মধ্যে ঘরের আলো নিভিয়ে দিলেন। এই আলো আধাঁরি আর মায়াবী কণ্ঠস্বরের মিশেলে ঘরের ভেতরে যে স্পিরিচুয়াল অ্যাটমোস্ফিয়ার সৃষ্টি করেছিল তাতে অন্য কেউ না হলেও কবি শামসুর রহমান খেলাতে হার মেনেই বসেছিলেন।
পরদিনই তিনি ফাহমিদার গান ও সেই অলৌকিক পরিবেশ নিয়ে একটা অসাধারণ কবিতা লিখলেন। যে কবিতাটা ফাহমিদা বেশ পছন্দ করেছিলেন।
কিন্তু সানজিদা খাতুনের বাসায় আড্ডাটা ঠিক ওভাবে জমানো গেল না। কেমন একটা রাবীন্দ্রিক ঠাঁট ওখানে, যেখানে ঠিক প্রাণখুলে আড্ডা দেয়া বা ঝগড়া করা যায় না। তাই ওই আস্তানা ছাড়তে হলো।
ততদিনে বেশ কয়েকমাস কেটে গেছে। শেষ পর্যন্ত আড্ডার একটা স্থায়ী জায়গা পাওয়া গেল। ড. আহমদ শরীফ সাদরে তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়ের কোয়ার্টারের ড্রইংরুমে বৈঠক করার অনুমতি দিলেন। ড. আহমদ শরীফের মতো উদার অতিথিপরায়ণ ও দিলদরিয়া মানুষ সহসা দেখা যায় না। তার বাড়িতে আসরটা বিশেষ করে জমে উঠেছিল সে কারণেই। তিনি সবাইকে খাওয়াতেন। যাদের টিফিন খাওয়ার পয়সা জোটে না, তাদের অনেকেই সংস্কৃতি ভক্ষণের উদ্দেশ্যে নীলক্ষেতের সাঁইত্রিশের সি কোয়ার্টারে চলে আসতো। শরীফ সাহেব গুড়ুক গুড়ুক হুঁকো টানছেন আর বড় বড় আওয়াজ করে ডাক দিচ্ছেন। আনা চা দাও, নাস্তা দাও। ড. শরীফ সাহেবের বাড়ির আড্ডায় নিয়মিত হাজির হওয়া তরুণদের মধ্যে ফরহাদ মাজহার, হুমায়ুন কবীর, মুনতাসির মামুন, মুহাম্মদ নুরুল হুদা, রফিক কায়সার, রফিক নওশাদ, হেলাল হাফিজ, আবরার চৌধুরী, মাশুকুর রহমান চৌধুরী, শাহনুর খান, বেবী মওদুদ এবং আরো অনেকে ছিলেন। বড়দের মধ্যে ড. মমতাজুর রহমান তরফদার, ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, বোরহানউদ্দীন খান জাহাঙ্গীর, অধ্যাপক আহসানুল হক, কবীর চৌধুরী, হিরণ্ময় সেনগুপ্ত, ড. অজয় রায়, ড. মফিজ চৌধুরী প্রমুখ।
কিন্তু শুধু সাহিত্যসভা করে বেড়ালে তো চলবে না। ছফার পকেট তখন গড়ের মাঠ। এক বেলা খাবার জোটাতে পারে তো দু’বেলা টান পড়ে। দেশের যা রাজনৈতিক পরিস্থিতি টুকটাক কোনো চাকরী-বাকরি জোটানোও সম্ভব হচ্ছিল না। এমন সময় বাংলা একাডেমী তিন বছরের ফেলোশিপ প্রোগ্রামে প্রার্থীদের কাছ থেকে আবেদনপত্র আহ্বান করে একটা বিজ্ঞাপন প্রকাশ করল পত্রিকায়।
ছফার বন্ধুদের অনেকেই তাকে বললেন, তুমি ওই প্রোগ্রামে একটা দরখাস্ত ঠুকে দাও। যদি বৃত্তিটা পেয়ে যাও তাহলে তিন বছরের নিরাপদ জীবিকা। আর কোনো চিন্তা নেই।
প্রস্তাবটা ভালো, ছফার মনেও বেশ ধরল। কিন্তু গোল বাধল আসল জায়গায়। তখনও তার এম এ পরীক্ষা শেষ হয়নি। ফার্ষ্ট পার্ট হয়েছে সেকেন্ড পার্ট পরীক্ষা ছাত্রদের দাবীর মুখে পেছাচ্ছে, পেছাচ্ছে। এদিকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনও গতিবেগ সঞ্চয় করে ক্রমাগত ফুঁসে উঠছে। পরীক্ষা কবে শেষ হবে তার কোনো ঠিক নেই। ছফা যদি এ সময়ে পরীক্ষার ফলাফলের অপেক্ষায় বসে থাকেন তবে দরখাস্ত করার সময় পেরিয়ে যাবে। এখন কী করা যায়! গবেষণা হয়ত হবে, না হলেও ক্ষতি নেই তবে ফেলোশিপটা পেয়ে গেলে বিশেষ উপকার হয়।
রাতভর ভাবলেন ছফা। কবীর চৌধুরী তখন বাংলা একাডেমীর পরিচালক। কবির ভাইর সঙ্গে দেখা করে তাকে বুঝিয়ে বললে একটা সুরাহা হতে পারে।
কবীর চৌধুরীর সাথে দেখা করে তাঁকে কি কি বলতে হবে দীর্ঘক্ষণ ধরে তার প্রাকটিস করতে লাগলেন তিনি। ‘কবির ভাই যদিও আমার এখনো এমএ পাশ করা হয়নি, তারপরও পাশ করাটা পরীক্ষার ফল বের হতে যা বাকি। পাশ তো আমি করবই, কিন্তু এই সুযোগ তো বার বার আসবে না। তাই আমার দিকে চেয়ে আপনি যদি অন্তত দরখাস্তটা গ্রহণ করতে অমত না করেন..!’ একটু কি বেশি তেল মারা হয়ে গেল! না কি ওভার কনফিডেন্স দেখানো হচ্ছে? যা-ই হোক একটা কিছু বলে তাঁকে ম্যানেজ করতেই হবে।
পরদিন কবীর চৌধুরীর সাথে দেখা করে তাঁকে সব বুঝিয়ে বললেন ছফা।
কবীর চৌধুরী সাহেব একটু চিন্তা করে বললেন, ঠিক আছে, তুমি দরখাস্ত কর। অন্যান্য প্রার্থীর আবেদনপত্রের সঙ্গে তোমারটাও আমি বোর্ডে তুলব। বোর্ডের সদস্যবৃন্দ তারপর দেখে শুনে যাকে ইচ্ছে নির্বাচন করবেন।
এ ধরনের একটা আশ্বাস পেয়ে ছফা এম.এ. পাশ না করেও বাংলা একাডেমীর পি.এইচ.ডি. ফেলোশিপ প্রোগ্রামে দরখাস্ত করে বসলেন।
এবং একদিন অন্যান্য প্রার্থীদের সাথে তিনিও ইন্টারভু্য কার্ড পেলেন। ইন্টারভু্য কার্ড পাওয়ার পর তিনি ছুটলেন ড. মুনীর চৌধুরীর কাছে। উদ্দেশ্য তাঁকে অনুরোধ করা যেন তার বাংলা একাডেমীর বৃত্তিটার জন্য তিনি বোর্ডে সুপারিশ করেন।
ছফার কথা শুনে মুনীর চৌধুরী বললেন, ‘সব তো বুঝলাম ছফা, তুমি যথেষ্ট ব্রিলিয়ান্ট সন্দেহ নেই, কিন্তু তোমার যেহেতু এখনো এম.এ.টা কমপ্লিট হয়নি, একাডেমী তোমার আবেদন বিবেচনা নাও করতে পারে। তার চেয়ে তুমি বরং একটা কাজ কর। তুমি যদি রাজি থাক তাহলে আমি তোমাকে একটা স্কলারশিপ দিয়ে অষ্ট্রেলিয়া পাঠিয়ে দিতে পারি। ভাষাতত্ত্বের ওপর পি.এইচ.ডি. করতে হলে শুধু গ্রাজুয়েশন থাকলেও ওরা আপত্তি করবে না।’
মুনীর চৌধুরী স্যারের কথাটা শোনামাত্র ছফা ভেতরে ভেতরে উল্লসিত হয়ে উঠল। কিন্তু পরক্ষণেই নিজের ভেতর থেকে একটা সূক্ষ্ম আপত্তি জেগে উঠল। ছফা মাথা নিচু করে রইল কিছুক্ষণ এবং মেঝের দিকে তাকিয়েই বলল, দু’একদিন ভেবে আপনাকে বলব স্যার।
মুনীর চৌধুরী স্যারের প্রস্তাবটা গ্রহণ করবে কি না এ নিয়ে খুঁটিয়ে চিন্তা করতে গিয়ে ছফার চোখে পানি এসে গেল। সেই সময়ে দেশের বাইরে যাওয়ার এমন একটা স্কলারশিপ পেলে সে বর্তে যায়। আর তেমন একটা সুযোগ এমন স্বেচ্ছায় এসে ধরা দিয়েছে। তার তো নিজেকে ভাগ্যবান মনে করা উচিৎ কিন্তু সে পারছে না কেন? পারছে না কারণ পুরনো দিনের তাবৎ জমানো অভিমান ওই সময়ে তাঁর সামনে এসে ধরা দিয়েছে। তারা একের পর এক কৈফিয়ত চাইছে তাঁর কাছে। কেন, কেন ছফা তুমি, এখন তুমি তাঁদের অনুগ্রহ নেবে? তুমি বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে ভর্তি হয়েছিল, তিন বছর সেখানে পড়েছ, মাতৃস্তনে শিশুর যেমন অধিকার, শিক্ষকদের স্নেহের ওপরও ছাত্রদের সে রকম অধিকার থাকা উচিৎ। সেই স্নেহ তুমি শিক্ষকদের কাছ থেকে পাওনি। যার পরিণতিতে তুমি বাঙলা বিভাগ ছেড়ে দিলে, প্রাইভেটে বি.এ. পরীক্ষা দিলে। এখন আবার বাংলা ছেড়ে রাষ্ট্র বিজ্ঞানে প্রাইভেটে এম.এ. দিচ্ছ কেন ছফা? শিক্ষকদের কাছ থেকে সামান্য উৎসাহ, অনুপ্রেরণা যখন তোমার ভীষণভাবে প্রয়োজন ছিল, সেই সময়ে কেউ তোমার দিকে মুখ তুলে তাকাননি। আর যখন তুমি নিজের চেষ্টায় উঠে আসতে শুরু করেছ, তখন সবাই তোমাকে অনুগ্রহ বিতরণ করে কৃতজ্ঞতাপাশে বাঁধতে চাইছেন। নিও না ছফা, এ অনুগ্রহ তুমি গ্রহণ করো না। যে বস্তু প্রয়োজনের সময় হাজার কামনা করে পাও নি, সেই বিশেষ সময়টি চলে যাওয়ার পর তার ক্ষতিপূরণ যদি তোমার কাছে সেধে এসে ধরাও দেয়, তাই কি তুমি গ্রহণ করবে?’ -না, কিছুতেই না। এ দান, এ অনুগ্রহ গ্রহণ করা তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়। আবার নিজের গোয়ার্তুমির কাছে নিজের আত্মঅহংকারের কাছে এভাবে নিজেকে হেরে যেতে দেখে ছফার ভেতরের আরেক ছফা কেঁদে উঠল। এভাবেই রাতভর চলল নিজের সাথে নিজের লড়াই।
এরই মধ্যে একদিন ছফা ড. মুনীর চৌধুরীর অফিসে গিয়ে বললেন। স্যার, ভাষাতত্ত্ব বিষয়টার প্রতি আমি আকর্ষণ অনুভব করি না। আপনি প্লিজ স্কলারশিপটার জন্য অন্য কাউকে বেছে নেন।
মুনীর চৌধুরী সাহেব কিছুই বললেন না। তিনি তর্জনীটা গালে ঠেকিয়ে কিছুক্ষণ তাঁর এই একরোখা, অভিমানী ছাত্রের দিকে তাকিয়ে রইলেন।
বারো
নির্দিষ্ট দিনে দুরুদুরু বুকে একাডেমীর ইন্টারভিউ বোর্ডের সামনে হাজির হলেন ছফা। ইন্টারভিউ বোর্ডে যথারীতি উপস্থিত আছেন ড. এনামুল হক, ড.আহমদ শরীফ প্রফেসর মুনীর চৌধুরী। ড. এনামুল হক ছাড়া বাকী দুজন তাঁর পরিচিত। তাঁর শিক্ষক কিন্তু এক ড. এনামুল হকই তার পা কাঁপিয়ে দিল। কারণ ড. এনামুল হক ভীষণ রাশভারী মানুষ। পারত পক্ষে জুনিয়র কলিগরাও তাঁর কাছে ঘেঁষতে সাহস পান না। ঘিয়ে রঙের সু্যট এবং কালো টাই পরা ড. হককে একটা আস্ত বুড়ো বাঘের মতো দেখাচ্ছে। চোখের ভুরু থেকে মাথার চুল একেবারে পাকা। মাথার মাঝখানে সযত্নে সিঁথি করা। ছফার অবস্থা তখন ক্ষুধার্ত বুড়ো বাঘের সামনে কচি নধর গো-বৎসের মতো। এই বুঝি লাফিয়ে পড়ে তার মুণ্ডুটা চিবিয়ে খাবেন। কিন্তু ছফার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় তখন কাজ করল।
মনে মনে ভাবলেন, এই বুড়োর সামনে যদি রুখে দাঁড়াতে না পারি তাহলে তিনি তার নাকের পানি চোখের পানি এক করে ছাড়বেন।
তাঁর আশঙ্কা অনুযায়ী ড. এনামুল হকই তাকে প্রশ্ন করলেন, তিনি দরখাস্তের ওপরে চোখ বুলিয়ে ছফার দিকে তাকিয়ে গুরু গম্ভীর স্বরে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার সাহস তো কম নয় যে, এম.এ. পরীক্ষা না দিয়েই একেবারে পি এইচ.ডি. করার দরখাস্ত করে বসেছো।
ছফা মনে মনে এই যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত, তাই সরাসরি তাঁর কড়া পাওয়ারের চশমার কাচের ওপর চোখ রেখেই বললেন, চারুচন্দ্র বন্দোপাধ্যায় এম.এ. পাশ না করেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভাগীয় প্রধানের দায়িত্ব পালন করেছেন। মোহিত লাল মজুমদারও এম.এ. পাশ ছিলেন না, তথাপি এখানে শিক্ষকতা করছেন। আমি তো এম.এ. পাশ করবোই। দু-চার মাস এদিক ওদিকের ব্যাপার সে ক্ষেত্রে দরখাস্ত করাটা খুব অন্যায় হয়েছে বলে আমার মনে হয় না। উত্তর শুনে ড. এনামুল হক কড়ে আঙ্গুলটা মুখের ভেতর পুরে দিয়ে ছফার দরখাস্তের সাথে দাখিল করা থিসিসের পরিকল্পনার শিটগুলোর ওপর চোখ বোলাতে বোলাতে প্রশ্ন করলেন, তুমি কোন বিষয়ের ওপরে কাজ করবে? কণ্ঠস্বর শুনে মনে হলো ঝাঁঝ অনেকটা কমে এসেছে।
ছফা তখন বিনীতভাবে জবাব দিলেন, ‘আঠারোশো থেকে আঠারোশো আটান্ন সাল পর্যন্ত বাংলায় মধ্যবিত্ত শ্রেণীর উদ্ভব, বিকাশ এবং বাংলার সাহিত্য সংস্কৃতি এবং রাজনীতিতে তার প্রভাব।’
তুমি মধ্যবিত্ত বলতে কী বোঝো, সে বিষয়ে কিছু বল।
ছফা তখন হ্যারল্ডলাস্কি, বি.বি. মিশ্রের ইংরেজি বই থেকে যে সব রচনামৃত বিনিন্দ্র রজনীর শ্রমে মুখস্থ করেছিলেন গড় গড় করে উগরে দিতে লাগলেন।
ড. এনামুল হক ব্যাকরণের মানুষ। সমাজ বিজ্ঞানের কচকচির ওপর তার কোনো আগ্রহ নেই। তিনি চেয়ারটাতে হেলান দিয়ে মুনীর চৌধুরী সাহেবের দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনাদের প্রশ্ন থাকলে করেন।
মুনীর চৌধুরী স্যার কোনো প্রশ্ন না করে বরং তাঁর এই অভিমানী ছাত্রের সম্পর্কে ড. হকের মনে একটা ভালো ধারণা সৃষ্টি করার জন্য বললেন, ছেলেটার লেখার হাত ভাল এবং তরুণদের ওপরও যথেষ্ট প্রভাব আছে।
এরপর আর কেউ কোনো প্রশ্ন করলেন না। কবীর চৌধুরী সাহেব বললেন, ঠিক আছে, তুমি যাও।
সেইদিনই ঘণ্টা দুই পরে জানা গেল তাকে বিশেষ বিবেচনায় বাংলা একাডেমীর গবেষণা বৃত্তির জন্য মনোনয়ন দেয়া হয়েছে।
তাঁর বুকের ওপর থেকে যেন পাথর নেমে গেল। পরের দিন মুনীর চৌধুরী স্যারকে কৃতজ্ঞতা জানাতে গেল ছফা।
ছফাকে দেখেই তিনি জিজ্ঞেস করলেন, তুমি তো এম.এ. করছো পলিটিক্যাল সায়েন্সে?
জি্ব হঁ্যা।
কিন্তু তোমার থিসিসটা বিশ্ববিদ্যালয়ে রেজিষ্ট্রেশন করার সময় বাংলা বিভাগ থেকেই করতে হবে। তিনি তখন বাংলা বিভাগের বিভাগীয় প্রধান।
কিন্তু কেন স্যার?
কারণ তোমাকে আমরা তিন বছর পড়িয়েছি। মাঝখান থেকে তুমি হুট করে পলিটিক্যাল সায়েন্সে পরীক্ষা দিয়ে বসলে। বুঝেছি, তুমি আমাদের ছাড়তে চাও। কিন্তু তোমাকে আমরা ছাড়ব কেন? তুমি বাংলা বিভাগের অধীনে কাজ করতে রাজি না হলে বিশ্ববিদ্যালয়ে থিসিস রেজিষ্ট্রেশন করতেই দেব না।
ছফা তার এই শিক্ষকের মনোভাব বুঝতে পারলেন। স্যার অত্যন্ত সংবেদনশীল মানুষ এবং তাঁর বোধশক্তি অত্যন্ত তীক্ষ্ণ। তিনি তাঁর ছাত্রের অকথিত অভিযোগটি আঁচ করতে পেরেছেন তাই ছফাকে বাংলা বিভাগের অধীনে রেজিষ্ট্রেশন করতে বলছেন।
ছফাও তেমনি তার সিদ্ধান্তে অনড় রইলেন। কিন্তু সে কথা স্যারের কাছে ওই মুহূর্তে প্রকাশ করল না।
পি.এইচ.ডি. প্রোগ্রামে সিলেক্ট হবার পর ছফা বেশ চিন্তিত হয়ে পড়লেন কাকে থিসিসের পরামর্শক হিসেবে বেছে নেয়া যেতে পারে, কারণ বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি বাংলা বিভাগের ছাত্র ছিলেন, আর পলিটিক্যাল সায়েন্সে এম.এ. পরীক্ষাটা প্রাইভেটে দিয়েছিলেন। তাই বাংলা বিভাগ ছাড়া অন্য কোনো ডিপার্টমেন্টের শিক্ষকদের সাথে তার বিশেষ পরিচয় নেই। দু’এক জনের নাম জানেন রাষ্ট্রবিজ্ঞানের এই যা। তার মধ্যে ছফার মনে হলো প্রফেসর মোজাফফর আহমদ চৌধুরী হলে কেমন হয়? ম্যাক নামে পরিচিত এই ভদ্রলোককে তিনি দূর থেকে দেখেছেন, বেশ গুরুগম্ভীর লোক। রাশভারী চেহারা। তিনি কি রাজি হবেন? ছফার ভেতরে সংশয় দূর হয় না। এই নিয়ে নিজে কোনো উপায়ান্তর বের করতে না পেরে শেষ পর্যন্ত পলিটিক্যাল সায়েন্সে পড়ে এমন সব বন্ধু-বান্ধবদের শরণাপন্ন হলেন, একজন জ্ঞানী শিক্ষকের নাম জানার জন্য। যিনি তার পরামর্শক হবেন।
বন্ধুরা সবাই একবাক্যে আব্দুর রাজ্জাক স্যারের নাম বলল। তবে সাথে এই কথাও বলল যে, রাজ্জাক স্যার ভীষণ নাক উঁচু স্বভাবের মানুষ। বাঘা বাঘা লোকেরাও তাঁর কাছে ঘেঁষতে ভীষণ ভয় পায়। সুতরাং কথাবার্তা সাবধানে বলবে। যদি তাঁর অপছন্দ হয়, পত্রপাঠ বিদায় করে দেবেন।
এঁর বর্ণনা শুনে ছফার তো মনে ভয় ধরে গেল। তারপরও তিনি মনে মনে ভাবলেন যে, পরামর্শক কাউকে নিতে হলে রাজ্জাক স্যারকেই নেবেন। তিনি মনে মনে ঠিক করলেন যে, একদিন রাজ্জাক স্যারের বাড়িতে গিয়ে তার থিসিসের সুপারভাইজার হওয়ার অনুরোধটা করবেন।
কিন্তু একদিন দু’দিন যায় সাহস করে ওদিকে যাওয়াই হয় না। কিন্তু একজন সুপারভাইজার তো লাগবে। এবং তাঁর জ্ঞানের গভীরতার প্রতি তাঁর আস্থাও থাকতে হবে সুতরাং একদিন বিকেল বেলা অনেক দ্বিধা, অনেক শঙ্কা এবং সঙ্কোচ নিয়ে প্রফেসর রাজ্জাকের বাড়িতে গেলেন তিনি।
শহীদ মিনারের উল্টোদিকে শিক্ষকদের কোয়ার্টারে থাকেন প্রফেসর রাজ্জাক। ছফা দুরুদুরু বুকে দরজায় কড়া নাড়তে যাবেন এমন সময় দেখলেন দরজা বন্ধ না, আধভেজানো। তিনি তখন ইতস্তত করতে লাগলেন, দরজায় নক্ করবেন, না কি দরজা ঠেলে সোজা ঢুকে পড়বেন! শেষে যদি আবার কোনো বেয়াদবি হয়! মনে তো একটা শঙ্কা আছেই। কিছুক্ষণ দরজার কড়াটা ধরে ঠুকঠাক করলেন তবে ঠিক নাড়ালেন না। তারপরও কারো কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলেন তিনি। ঘরটা খুব বড় নয় চারদিকে বই পুস্তকে ঠাঁসা। ঘরটাতে একটা মাত্র চৌকি। সামনে একটা ছোটো টেবিল। চৌকিটার আবার একটা পায়া নেই। সেই জায়গায় বইয়ের ওপর বই রেখে ফাঁকটুকু ভরাট করা হয়েছে। চমৎকার ব্যবস্থা। পুরনো বই পত্রের আলাদা একটা গন্ধ আছে। সেই অপার্থিব গন্ধে ভরে আছে ঘরটা। ঘরে ঢুকে প্রথমে তিনি কাউকে দেখতে পেলেন না। এই বইপত্রের স্তূপের মধ্যে কিছুক্ষণ হতবিহ্বল হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন তিনি।
হঠাৎ খেয়াল করলেন সেই ভাঙা চৌকিটার ওপরে একজন মানুষ ঘুমিয়ে আছেন। একখানা পাতলা কাঁথা সেই মানুষটার নাক অবধি টেনে দেওয়া। চোখ দুটি বোজা। মাথার চুল কাঁচাপাকা। অনুমানে বুঝে নিলেন, ইনিই হয়ত প্রফেসর রাজ্জাক।
ঘরে দ্বিতীয় একজন মানুষের আবির্ভাব ঘটেছে এটা কি করে যেন বুঝে ফেললেন ভদ্রলোক। তিনি চোখ খুলে মুখের উপর থেকে কাঁথটি সরিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কেডা?
ছফা চৌকির একেবারে পাশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে বললেন, আসসালামু আলাইকুম, আমার নাম আহমদ ছফা।
আইছেন ক্যান হেইডা কন। ঘুম জড়ানো গলায় জানতে চাইলেন তিনি।
স্যার বাংলা একাডেমী থেকে আমাকে পি.এইচ.ডি. করার জন্য একটা বৃত্তি দিয়েছে। সেজন্য আমি আপনার কাছে এসেছি একটা বিশেষ অনুরোধ নিয়ে।
অনুরোধটা কি?
আপনি যদি আমার গবেষণার পরামর্শক হতে রাজি হতেন …!
কথাটা শেষ না হতেই তিনি উল্টোদিকে পাশ ফিরে পুনরায় কাঁথাটা নাকমুখ অবধি টেনে দিলেন।
তাঁর এমন আচরণে ছফা বেশ অপমানিত বোধ করতে লাগলেন, আর সাথে বিস্মিতও হলেন, এমন বিনীত অনুরোধ কোনো মানুষ এতো নীরবে প্রত্যাখ্যান করতে পারে! কেমন মানুষ এই রাজ্জাক সাহেব! হোন না তিনি মহা পণ্ডিত। একজন মানুষ তাঁর কাছে একটা অনুরোধ করল আর এটা শুনেই তিনি মুখ ঘুরিয়ে নেবেন কিছু না বলে! যে মানুষটা তাঁকে অনুরোধ করছে সেও তো কোনো ফালতু মানুষ না। অন্যের কাছে না থাক ছফার নিজের কাছে তো তার নিজের একটা গুরুত্ব আছে। এরই মধ্যে তার দুটো বই প্রকাশিত হয়েছে সংবাদ পত্রগুলোতে নিয়মিত লেখেন আর ….। ভাবতে পারেন না ছফা। এর একটা বিহিত করতেই হবে। তিনি ঘুরে চৌকির উল্টোদিকটাতে গিয়ে আবার বললেন, আপনাকে আমার থিসিসের সুপারভাইজার হওয়ার জন্য অনুরোধ করতে এসেছি, শুনতে পাচ্ছেন স্যার?
একথা দ্বিতীয়বার শুনে রাজ্জাক সাহেব আবার উল্টোদিকে পাশ ফিরলেন।
এতো মহা যন্ত্রণা। ছফার ভীষণ রাগ ধরে গেল। কেমন মানুষ ইনি! তার কাছে একজন মানুষ একটা অনুরোধ করছে আর তিনি ভাল-মন্দ কিছু না বলে নীরবে তাকে প্রত্যাখ্যান করতে চান! কিন্তু এইভাবে অপমানিত হয়ে চলে যাওয়ার মানুষ ছফা নন। এভাবে যদি তাকে চলে যেতে হয় তাহলে নিজের কাছেই নিজে ছোট হয়ে যাবন তিনি। তাই তিনি ঘুরে দাঁড়ালেন। কি করা যায়! কিছু একটা করতে হবে। তাঁর বইয়ের গুদামে যদি আগুন লাগিয়ে দেয়া যেত তাহলে বেশ হতো। মনের ঝাল কিছুটা হলেও মিটত। কিন্তু সেটাতো সম্ভব না। তাহলে! মুহূর্তে ছফা দুহাত দিয়ে রাজ্জাক সাহেবের শরীরের ওপর থেকে কাঁথাটা টেনে নিয়ে দলা পাকাতে পাকাতে বললেন, আমার মতো একজন আগ্রহী যুবককে আপনি একটি কথাও না বলে তাড়িয়ে দিতে পারেন, এতো বিদ্যা নিয়ে আপনি কী করবেন? কাকে বিলি করতে চান?
ঘটনার আকস্মিকতায় ভদ্রলোক হতচকিত হয়ে পড়লেন। তিনি বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো চৌকির ওপর উঠে বসলেন। পরনের সাদা আধময়লা লুঙ্গিটা টেনে গিটটু দিলেন। তারপর চশমাটা টেবিল থেকে তুলে নিয়ে কাঁচ ঘষে নাকের ওপর চড়ালেন, এবং এই উদ্ধত যুবকের পা থেকে মাথা পর্যন্ত একবার দৃষ্টি বুলিয়ে নিলেন।
ছফা সেই মুহূর্তে তাঁর দৃষ্টিশক্তির তীব্রতা অনুভব করলেন। কোনো মানুষের চোখের দৃষ্টি এতো প্রখর হতে পারে তাঁর কোনো ধারণাই ছিল না।
রাজ্জাক সাহেব এবার একটা আধভাঙ্গা চেয়ার দেখিয়ে দিয়ে বললেন, ওইহানে বয়েন।
ছফা বসলে তিনি ভেতরে চলে গেলেন। একটু পরে মুখে পানি দিয়ে ফিরে এলেন।
ছফা লক্ষ্য করলেন তাঁর পরনের গেঞ্জিটাতে বড় বড় দুটো ফুটো যেন তার দিকে তাকিয়ে আছে।
চৌকিটাতে আরাম করে বসে খদ্দরের চাদরটা গায়ের ওপর মেলে দিতে দিতে বললেন, তারপর কী কইবার চান কন।
স্যার আমি বাংলা একাডেমী থেকে পি.এইচ.ডি. করার একটা ফেলোশিপ পেয়েছি। আমার খুব শখ আপনার অধীনে কাজটা করি।
গবেষণা করবেন হেইডা তো ভাল কথা। কিন্তু আমি তো আপনার সুপারভাইজার থাকবার পারুম না।
না, বললেও তাঁর কণ্ঠস্বর বেশ তরল শোনাল। তার মানে তিনি ছফার সাথে এখন হয়ত কিছু কথাবার্তা বলবেন।
কিন্তু কেন স্যার?
এতো কিছু জানেন, আর এইডা জানেন না? অফিসিয়ালি থিসিস সুপারভাইজ করনের লাইগ্যা মিনিমাম রীডার অওন লাগে। আমি তো মোটে লেকচারার। সুতরাং আপনার শখ পূরণ অওনের কোনো সম্ভাবনা নাই।
তাহলে স্যার, অন্য কারো অধীনে থিসিসটা রেজিষ্ট্রেশন না হয় করলাম। কিন্তু আপনার পরামর্শ ও নির্দেশনা নিয়েই আমি কাজটা করতে চাই।
তা আপনার টপিকটা কি?
দ্যা গ্রোথ অব মিডল ক্লাস ইন বেঙ্গল অ্যাজ ইট ইনফ্লুয়েন্সড ইটস লিটারেচার, সোসাইটি এ্যান্ড ইকনমিক্স ফ্রম এইটিনথ ফিফটি এইট।
এক্কেরে তো সাগর সেঁচার কাম। কার বুদ্ধিতে এই গন্ধমাদন মাথায় লইছেন?
কারো বুদ্ধিতে না। নিজেই বিষয়টা বেছে নিয়েছি।
রাজ্জাক সাহেব কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। এরই মধ্যে কাজের ছেলেটা কল্কিতে তামাক দিয়ে গেলে তিনি চোখ বন্ধ করে টানতে শুরু করলেন।
ছফা অবাক হয়ে দেখছেন অক্সফোর্ডে-পড়া এই ভদ্রলোক কল্কিতে হুক্কা টানেন, ছেঁড়া গেঞ্জি-আধময়লা লুঙ্গি পরে ভাঙ্গা চৌকিতে কাঁথা মুড়ি দিয়ে ঘুমান, ঢাকাইয়া আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলেন, অথচ তার মুখে এই ভাষাও শুদ্ধের মতো শোনায়। সব কিছু কেমন যেন অদ্ভুত!
কল্কিতে কয়েকটা টান দিয়ে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বললেন, তো রেজিষ্ট্রেশন ফর্ম রেডি করছেন?
এখনো রেডি করি নাই।
তাহলে?
স্যার এর মধ্যে একটা কথা আছে।
এর মইধ্যে আবার কী কথা?
আমাকে বৃত্তিটা দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। তবে সেটা কার্যকর হবে এম.এ.’র রেজাল্টের পর। আমার এম.এ.’র রেজাল্ট এখনো হয় নাই পরীক্ষা চলছে।
ঘটনাতো ইন্টারেস্টিং ঠেকতাছে। তাহলে আগে পরীক্ষা দিয়া লন। যখন রেজাল্ট বাইর অইব তখন আয়েন।
ছফা উঠে দাঁড়ালেন, ঠিক আছে আমি তাহলে এখন আসি?
একটু বইয়েন, এক পেয়ালা চা খাইয়া যান। দীপ্তি …. ও দীপ্তি।
গোলগাল ফর্সা একটা মেয়ে ছুটে এলো ডাক শুনে।
কী যেন নাম বলছিলেন আপনার?
আহমদ ছফা।
হঁ্যা, মৌলবী আহমদ ছফাকে এক পেয়ালা চা দে তো মা।
ছফা বুঝতে পারলেন না তাকে মৌলবী বিশেষণ কেন দিলেন ভদ্রলোক। এটা কি আদর নাকি অবজ্ঞা বুঝবার অগম্যই রইল তাঁর তখনকার হাবভাবে।