সৈকত আরেফিন
আমাদের মফঃস্বল বদলে যায়। ছোট শহরটা দ্রুত তার ভূগোল পাল্টে ফেলে। এই ভৌগোলিক পরিবর্তনের প্রায় সবটাই হয় আমাদের শৈশব ও কৈশোর জুড়ে, উদ্দাম ও স্বপ্নরঙিন অতীতকালে; প্রজাপতির পেছনে ছুটে বেড়িয়ে, সারাদিনমান ঘুড়ি উড়াতে উড়াতে আমরা দেখি যে, আমাদের আকাশ ঢাকা পড়ে যায়, গোলাছুট খেলার মাঠও তখন বহুতল শপিং সেন্টারের নিচে সমাহিত; নিজেদের ঘরের চারদেয়ালে ক্রমে বন্দি হয়ে পড়ে আমরা বুঝি একটা বর্ধিষ্ণু শহুরে খাঁচা আমাদের ধীরে ঘিরে ফেলছে; কিন্তু খাঁচার এই ঘিরে আসা আমাদের তেমন করে আতঙ্কিত করে না। হয়তো তখন আমরা দ্বিধাহীনভাবেই শহরকে আকাঙা করি; এভাবে আমরা একটা গুবরে পোকা, কয়েকটি জোনাকি, প্রজাপতি, খোলা আকাশে আমাদের কয়েকটি শাদা কালো ঘুড়ির কথা বেমালুম ভুলে যাই। কিন্তু তখনও হয়তো এরকম অনেকে থাকে যারা গ্রামীণ সবুজকে আবার ফিরে পেতে চায়; তখনও কেউ কেউ কাশীনাথপুরকে শহর বলতে দ্বিধা করবে, বা বলবে যে, এটা মূলত গ্রামই; কেননা তখনও অদূরে, আশেপাশে সবুজ হারায় না, সেখানে ফসলের মাঠ, ধানখেত বা সরষে ফুলে প্রান্তর হলুদ হয়ে থাকে। তবু জেলা শহর থেকে অনেক দূরে, দালান কোঠায় ভরে ওঠা এলাকাটিকে আমরা শহর বলতেই ভালোবাসি। এসব হয়তো শ্লাঘা, তবে লজ্জিত বা কুণ্ঠিত হবার ব্যাপারটিও আর থাকে না; এজন্যে যে, তখন পর্যন্ত সত্যি সত্যি শহর সম্পর্কে আমাদের কারোরই ধারণা স্পষ্ট নয় বা আমরা প্রচলিত শহরধারণাকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিই, তখন পক্ষপাতদুষ্ট হয়ে ভাবি, শহর হিসেবে কাশীনাথপুরের একটা পরিচিতি হোক; এই প্রত্যাশার বিপরীত ভাবনা যে আমরা একেবারে ভাবি না তা নয়; তবুও চারদিক থেকে হাইওয়ে এসে এখানে বিশাল গোলচত্বর সৃষ্টি করলে টেলিভিশনে বা সিনেমায় দেখা ঢাকার বড় বড় রাস্তার কথা আমাদের মনে পড়ে; আরও পরে গোলচত্বরে মোবাইল কোম্পানিগুলো যে বিশাল বিশাল বিলবোর্ডে দিগন্ত অবলেপন করে তাতে শহরের আবহ প্রযোজিত হয়। আমরা সেইসব বিশালাকৃতির বিলবোর্ডের মেয়েদের দিকে হা করে তাকিয়ে দেখি আর মনে মনে আমাদের শহরের এই বিস্তৃতি উপভোগ করি। তাছাড়া এ অঞ্চলে বৃষ্টিপাত বা ভূমির উর্বরতার কারণে যে পরিমাণ ফসল উৎপাদিত হয়, বিশেষ করে পাট, পেঁয়াজ বা মরিচের মত ফসল তাতে বাণিজ্যিকভাবেও কাশীনাথপুর গুরুত্ব পেতে শুরু করে।
কিন্তু নুতন শহরে একদিন আমাদের ব্যক্তিজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়বে তা আমরা ঘুর্ণাক্ষরেও ভাবি নি। বজলুর রহমান অলি এভাবে ব্যবসাপত্র গুটিয়ে সৌদি আরব চলে যাবে তা-ই বা কে ভাবতে পেরেছিল! বজলুর রহমান অলির উপর আমাদের রাগ হয়–আরে বাবা কাশীনাথপুর যেভাবে ফুলে ফেঁপে উঠছে, এখানে ব্যবসা করলেই তো তোমার টাকার অভাব হয় না; কে তোমাকে নুতন বিয়ে করা বউকে একা ফেলে সৌদি আরব যেতে বলেছে! আমরা এর কোন কিনারা করতে পারি না, রহস্যের ঘুর্ণাবর্তে পড়ে হাবুডুবু খেতে খেতে আমাদের মনে হয়, অলি সত্যি সত্যি অলি আউলিয়া হতে চায় কি না! না কি দু একবার হজ্জ্ব করে তার মধ্যে নিষ্পাপ হবার মোহ জাগ্রত হয়! না হলে সে এভাবে আমাদের বিপর্যস্ত অস্থিরতার মধ্যে নিপতিত করে কেন সৌদি আরবই চলে যায়। তখন আমাদের মনোজগৎ বিচলিত। মনোজাগতিক এই বিচলতার পেছনে কী কী কারণ থাকতে পারে, যখন এগুলো নিয়ে আমরা ভাবতে বসি বা ভাবার জন্য বসতে হয় না, ভাবনাগুলোই কখনো মন ছেড়ে যায় না, তখন দেখি, নুরুন্নাহার সাথীও আমাদেরকে ভাবায়; হয়তো তার স্ফূরিত যৌবন, বিষ্ফারিত রূপ আমাদের অস্তর্গত পৌরুষে ঢেউ দেয়, তখন মাঝ নদীতে একাকী তরঙ্গ বিক্ষোভে আমরা উথাল পাথাল হই। কিন্তু অলির সাথে নুরুন্নাহারের বিয়ের সাত মাসে আমরা একবারও তাদের অবনিবনার খবর পাই না। তাহলে নুরুন্নাহারকে বিহ্বল সময়গ্রন্থির মধ্যে ভাসিয়ে দিয়ে বজলুর রহমান কী করে উটের রাখাল হতে সৌদি আরব গমন করে! তখন আমরা ভাবি, হয়তো তার এ দেশান্তর নুরুন্নাহারেরই জন্য; তাকে সুখে রাখবার জন্য প্রত্যয় নিয়েই হয়তো আমাদের অনেকদিনের বন্ধু বজলুর রহমান অলি একদিন এমিরেটসের শাদাকালো উড়োজাহাজে আল্লাহর নাম নিয়ে চড়ে বসে। কিন্তু এ ভেবে আমাদের মনে স্বস্তি ফিরে আসে না; বজলুর রহমানের জন্য, অংশত নুরুন্নাহারের জন্যেও বুকের মধ্যে একটুখানি জায়গা ফাঁকা হয়ে যায়। তখনও কাশীনাথপুর তার বিস্তার অব্যাহত রাখে; বজলুর রহমানের ফেলে যাওয়া কাগজ বিতানে অন্যরা এসে ফার্মেসি বানায়; আমরা সেই ওষুধ ঘর সজ্ঞানে এড়িয়ে চলি, সেই ফার্মেসির পাশ দিয়ে যেতে যেতে প্রতিবারই বন্ধুর মুখ মনে পড়ে। তখন বুঝি কখনো কখনো এক দুকাপ চা, মাঝে মাঝে সিঙাড়া বা অন্তত চীনেবাদাম নিয়ে আমাদের যাপিত আনন্দের দিন পেরিয়ে গেছে; তখন অহেতু কর্মহীন দুপুরগুলো কেমন লম্বা ও বিধুর হয়ে যায়।
তবে আমরাও স্বপ্ন দেখতাম; ভেতরে একটি কলকল নদীকে আমরা অবাধে বইতে দিয়েছি। সে নদী কখনো পাড় ভেঙেছে, কখনো গড়েছে, স্বপ্নজলের প্রপঞ্চে পড়ে বিভ্রান্ত হয়েছে আমাদের আকাঙ্খা ও ইচ্ছের সীমানা। আমরা বুঝি নি, আমাদের কী হবে, কী করব; কিন্তু স্বপ্নের লাগামটা তার ইচ্ছের ঘোড়া ছুটিয়েছে; এক লক্ষ্মীমন্ত মেয়ের গোলগাল মুখের আদলে তার মৃদু বা উষ্ণ বাহুবাঁধনে, বুকের কাঁঠালীচাঁপার গন্ধে হারিয়ে গিয়ে খুঁজেছে তুমুল আনন্দ।
কাশীনাথপুরও আরও লাগামহীন হয়; ডানে, বামে, পুবে, পশ্চিমে নির্লজ্জভাবে বাড়তেই থাকে। তখন দেশে টেলিভিশনের সংখ্যা আশাতীত বেড়ে যায়। আমাদের নুতন শহরে, এর আশেপাশের গ্রামগুলোতে আকাশে মাথা তুলে দেয় টেলিভিশন এ্যান্টেনা, কেবল লাইনও ইলেট্রিক লাইনের সমান্তরালে বিস্তৃত হয়। এসবই টেলিভিশন নির্মাতা কোম্পানি ও সম্প্রচার কর্তৃপক্ষের কর্মদক্ষতা ও ব্যবসায়িক সাফল্যের ইঙ্গিত করে; রাষ্ট্রীয় উন্নয়নও এর সাথে জড়িত হয়। কিন্তু সব উন্নয়নের বুকের মধ্যে যে বেদনার পটভূমি লুকিয়ে থাকে, সেসব আমরা ধীরে ধীরে জানতে পারি। তখন আমরা যেন একেকটা গৃহপালিত কপোত; সন্ধ্যার মধ্যে ঘরে ফিরে খাঁচার মধ্যে বাকুম বাকুম করা ছাড়া আমাদের আর কোন কাজ নেই; বড়জোর টেলিভিশনের সংবাদে মন দিতে হয়। এভাবে ক্রমে একটা রঙিন বাক্সের মধ্যে আমাদের স্বপ্ন ও আকাক্সাকে গুটিয়ে এনে একটা মৃত মথের মত গুটির মধ্যে লুকিয়ে থাকি, যে মথটা আর কখনো গুটি কেটে সুতো বুনতে পারবে না। ‘পৃথিবীটা নাকি ছোট হতে হতে/ স্যাটেলাইট আর কেবলের হাতে, ড্রয়িং রুমে রাখা বোকা বাক্সতে বন্দি/ আহা হা হা হা’ –মহীনের ঘোড়াগুলির এই গান শুনে আমাদের মনে হয়, ছোট হতে থাকা পৃথিবীতে আমরাও কীভাবে একটা শুয়োপোকার জীবনে অভ্যস্ত হয়ে যাই!
চৌরাস্তার মোড়ের মহীর পাগলার কথা মনে পড়ে, মোড়ের ঝাঁকড়া বটগাছের নিচে দাঁড়িয়ে মহীর পাগলা তার ময়লা হয়ে যাওয়া লাল পিরান বাতাসে উড়িয়ে চিৎকার করত-‘হেই পৃথিবীর আদমগণ/ শুনে নে এখন…হুশিয়ার, সাবধান/ আনন্দ কম কর।’ মহীর পাগলার সেই লাল জামাটা আমাদের চোখে লেগে থাকে; হুশিয়ার বাণী সাবধান করতে না পারলেও তার জামার লাল রং-এ আমরা এক ধরনের সচেতনার জলবায়ুতে পরিভ্রমণ করি; মহীর পাগলার কথা মনে হলেই অবধারিতভাবে তার লাল জামাটির কথা আমাদের মনে হয়। একদিন শহরে লাল মিছিল করেছিলাম, সেদিনও আমাদের বুকের মধ্যে ঐ লাল জামাটির স্মৃতি লেগেছিল। সেই মিছিলটি আমাদের শিখিয়েছিল কীভাবে স্রোতের উজানে যেতে হয়; সময় প্রতিকূল জেনেও সুসময়ের জন্য অপেক্ষা করতে শিখেছিলাম সেই মিছিলে পা মিলিয়ে, শ্লোগানে গলা ছেড়ে। অনাগত দিনে যত ঝড় হবে, বৃষ্টি হবে, পথে যত বাধা আসবে, দেয়াল উঠবে, কাদায় পিচ্ছিল হবে, সব একে একে পেরিয়ে যাবার মন্ত্রটা আমরা শিখে নিই সেই মিছিলের সম্মিলিত আহ্বানে। সেই মন্ত্রশক্তির জোরে অনেকদিন ধরে আমরা মানুষ হয়ে মানুষের পাশে দাঁড়ানোর পথে ছিলাম, তবে পরে সব স্তিমিত হয়ে যায়, যেমন হাবীবুর রহমানের পাটের গুদামের আগুনও একসময় স্তিমিত হয়ে গিয়েছিল। শীতের এক সন্ধ্যায় হাবীবুর রহমানের সাধের গোল্ডেন ফাইবারে আগুন জ্বলে ওঠে। সেই সন্ধ্যায় আগুনের রঙ দেখে আমরা আবার লাল রঙের প্রেমে পড়ে যাই। কিন্তু তখন হাতে হাতে জলের পাত্র নিয়ে আমরা সেই লালের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ি; আরও কিছু পরে জল ও ছাই মিলে জায়গাটা কালো রঙে ঢেকে যায়। এর পরের ইতিহাস শুধূই কালো রঙের, আমরা জানতে পারি পাটের দাম নেমে যাওয়ায় হাবীবুর রহমান নিজেই তার পাটের গুদামে আগুন ধরিয়ে দূরে বসে সিগারেট টানে। কালো রাতে আমাদের ঘুম আসে না; লক্ষ্মীমন্ত গোলগাল একটি মুখের যে স্বপ্ন বুকের মধ্যে জমা করে রেখে আমরা বাঁচতে শিখেছিলাম, ঘুমহীন তন্দ্রাচ্ছন্ন রাতে সেই মুখও বিষণ্ন হয়ে যায় বা একদিন রাসায়নিক বিক্রিয়ায় হেরে যাওয়া সে মুখ আর চেনা যায় না।
নুরুন্নাহার সাথীর সঙ্গে মাঝে মাঝে আমাদের দেখা হয়; সে হয়তো শপিং করে ফেরে, বাবার বাড়ি থেকে শ্বশুর বাড়ি যায় তখন তার সঙ্গে অতর্কিতে দূর থেকে দেখা হয়; আনন্দে নুরুন্নাহারের মুখ ঝলমল করে। তার আনন্দিত মুখ দেখে আমাদের মন ভাল হয়ে যায়-বুঝি, মরুভূমির দেশে অলি তাহলে ভালই আছে, টাকা পয়সাও ঠিকমত পাঠাচ্ছে; ওর সঙ্গে বহুদিন ধরে আমরা যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকি, তাকে না একটা ফোন দিই, না একটা চিঠি লিখি; ভাবি, এবার একটা চিঠি লিখতে হবে; কিন্তু শেষপর্যন্ত চিঠি লেখা বা ফোন করা কোনটাই হয়ে ওঠে না। আমরা নিদারুণ আলস্যের মধ্যে নিজেদেরকে সমর্পণ করে দিনাতিপাত করি। এর মধ্যে একদিন সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে দৈনিক সংবাদপত্রিকা পড়ে আমাদের দুশ্চিন্তা হয়, পাতাজুড়ে বলিউড সুন্দরী হাসে, পত্রিকার পাতা শুঁকে মনীষা কৈরালার চুলের ঘ্রাণ নিতে ইচ্ছে হয়; কিন্তু হেডিং আমাদের উতলা করে-‘বলিউড নায়িকা মনীষা কৈরালাকে অপহরণ প্রচেষ্টা, পুলিশের গুলিতে ৪ জন নিহত।’ তো এভাবে অপহরণ প্রচেষ্টার মানেটা কী? চারজন লোক মারা যায় একথা আমাদের মনেই থাকে না, শুধু মনীষা যে রক্ষা পেয়েছে একথা ভাবতে ভাবতে আবার ঘুমিয়ে যাই, ঘুমিয়ে মনীষা কৈরালাকে স্বপ্নে দেখি; তখন বাস্তবজগতে বাংলাদেশ সরকার একটা ঘোষণায় জানিয়ে দেয় যে, এশিয়ার বৃহত্তম জুটমিল আদমজী ক্রমাগত লোকসানের মুখে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। পুনরায় ঘুম ভেঙে টেলিভিশনের দুপুরবেলার সংবাদে আমরা এই খবর জানতে পেরে ভাবি, মনীষা কৈরালার অপহরণের সঙ্গে এই ঘোষণার কোন দূরবর্তী সম্পর্ক মূলত কোথায়? মনে পড়ে, ছোটবেলায়, রত্না নামের ডলপুতুলের মত দেখতে যে মেয়েটি আমাদের সঙ্গে পড়ত একদিন সে বাড়ি থেকে হারিয়ে যায়, দুদিন পরে তাকে পাওয়া গেছিল গ্রামের পাটখেতে, নিরাবরণ ও মৃত; তখন বহুদিন পর রত্না আমাদের কাঁদায়। কিন্তু তখন অনেকদূরে, সৌদি আরবের কোন এক মহাসড়কে আরও বড় কান্নার উপলক্ষ্য তৈরি হয়; সেই কান্নার জন্য আমাদের সন্ধ্যা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়, টেলিভিশনের সন্ধ্যাবেলার সংবাদে আমরা নিশ্চিত হই, আমাদের কাঁদতে হবে; বজলুর রহমান অলির জন্য কাঁদতে হবে, নুরুন্নাহারের জন্য কাঁদতে হবে; নুতন শহরের রাস্তায় আমরা আমাদের জন্য হাউমাউ করে কাঁদি।
Onek vhalo laglo …ami kashinathpurer manush hisabe gorbo korte pari..