পাবলো শাহি
কথাটা সেই প্রথম স্পষ্ট করেছে, আমাদের মস্তিষ্কে চিন্তাটা মিথ হয়ে উঠবার আগে– সেই বলেছে ‘কনসেপ্ট’ এক ভয়ঙ্কর জটিল শব্দ আর মানুষ এই অভ্যস্থতার মধ্যে ঢুকে শব্দের দাস হয়ে ওঠে। এই প্রসঙ্গ ধরে সে আমকে বলে– ধরো আমি নিয়াণ্ডারথাল নারী, আর তুমি পৃথিবীর ফুল হাতে দাঁড়িয়ে থাকা আদি পুরুষ; কবিতার জন্ম দিতে গিয়ে, মাথায় ফুল গুঁজতে গিয়ে, ফুলের বদলে তুমি চাঁদ গুঁজে দিয়েছিলে। এইভাবে ভালোবাসার জন্ম হওয়ার দিন থেকে মানুষের মন এমন ইন্দ্রিয়জটিল হয়ে উঠল যে, যখন ইতিহাস শব্দটি চিন্তার সাথে যুক্ত করলাম আমরা; তখন স্বভাবতই মিথ ও উপখ্যান এই ভাবনার সুড়ঙ্গপথ ধরে তা ঢুকে পড়লো আমাদের ‘মনে’। এইসব হচ্ছে শিল্পচর্চার ইতিহাসের ডানায় শব্দের কাঠামোগত অবস্থান, যা এত ভয়ঙ্কর যে ‘মন’, ‘ভাবনা’, ‘মিথ’– এই শব্দগুলি সৃষ্টিশীল তাত্ত্বিকের মত বিশ্লেষণ করতে থাকি আমরা। করতে থাকি মানে– এই প্রচেষ্টা আমাদের মধ্যে প্রপিতামহের কাল থেকে অব্যাহত আছে।
‘সে বলে– জাভার F-ম্যান বোধকরি এমন মস্তিষ্কের জটিল আবর্তনে পড়েছিলো?’
‘হয়তো বা, তা না হলে মানুষ চিন্তা ও মনের চংক্রমণ শিখলো কোথা থেকে?’
‘তারপর আমি বলি– তোমার বুকটা চম্বুক যা আমাকে টানে।’
‘সে বলে, আমি তো কাজল রেখা, সোনারকাঠি মাথার পাশে রাখলে জেগে উঠি, আর রূপোর কাঠিতে চিরনিদ্রায়।’
‘তা ঠিক; সাতসমূদ্রের তলে– ভ্রমরার পেটে থাকে রাক্ষসের জান? সেই রাক্ষস আমি হলে, তুমি সেই প্রাণ ভ্রমরা।’
এভাবে নির্মিত হতে থাকে আমাদের কিস্সা কাহিনী, বিশ্লেষণের অধীন একটা নির্দিষ্ট গল্পের কাঠামো। এর মধ্যে আমার স্ত্রী অসংখ্য ব্যাখ্যা প্রত্যাখ্যান করেছেন। তারপরও গণিত, সংগীত এবং ভাষা– যার মধ্যে তিনি খুঁজে পেয়েছেন মানুষের মনোজাগতিক প্রক্রিয়া, নিজেকে পুণর্ব্যক্ত করার বচন। ফলে, মনের রাজনীতির থেকে জোর দিয়েছেন নৈতিকতায়। আজকাল তিনি ব্যস্ত থাকেন নৃবিজ্ঞান ও পুরাণ চর্চায়। মানববিদ্যার এই শাখা নিয়ে তিনি ছড়িয়ে যান– ইতিহাস ভাষা, ভূগোল ও দু’জনের নির্মিত পরিবেশ বিজ্ঞানের মধ্যে। এই চর্চা দেখে আমাদের মেয়ে ভীষণ আগ্রহি ‘চুমু পুড়িয়ে খাওয়া পৃথিবী’ কবে লিখবো– তা নিয়ে।
আমি তাকে বলি পিএইচ ডি শেষ হলে?
কিন্তু তাকে বলতে পারিনা, ভাষার যে ‘প্রেম’ আমার উপন্যাস লেখার প্রেরণা হয়ে উঠবে– তা এখনও পেয়ে উঠিনি আমি। ফলে, আমাদের সম্পর্কের অতিশয়োক্তি বাদ দিলে আর যা থাকে– আমার স্ত্রীর আগ্রহ সে বিষয়ে। এই ঘোর তিনি কাটিয়ে উঠতে পারেন নি কোনদিন। হয়তো এই ঘোর নিয়েই তিনি আমার চিঠি ও সাহিত্য পাঠ করেন। তাই সাধারণ ও পরিচিত শোনাতে পারে এমন কথাও তার মনে ঝাঁকুনি মারে। কার্যত, আমাদের ভালোবাসায় বিশ্ববিদ্যালয়ের রপ্ত করা বিদ্যার সংযোগ ক্ষীণ। ফলত, আমাদের মধ্যে সর্বাধিক আলোচিত ব্যক্তিত্ব তিনি হওয়া সত্ত্বেও, তা নিয়ে আমরা কখনো বৈজ্ঞানিক ভাবে প্রমাণ যোগ্য বিস্ময়কর সাদৃশ্য খুঁজতে তৎপর হয়নি। কাজেই যা হবার, সমস্ত আত্মত্যাগ সত্ত্বেও অক্ষরহীন সম্প্রদায়ের মতো আমরা একে অপরকে ভালোবাসি। এইসব মহাকালীক চিন্তায় আমরা কখনো কখনো ফিরে যায় অতীতে, অতীত মানে ইতিহাসে নয়, কেননা ইতিহাস মানে মতাদর্শ বা তত্ত্ব– আমাদের ভাবনা এইসব দৃষ্টিভঙ্গির বাইরে। কেননা, এই তত্ত্ব দর্শনের মতো বিমূর্ত– যা বিরক্তিকর আমাদের জন্য? বরং আমাদের মানসপ্রবণতা জুড়ে থাকে একে অপরের নজরে পড়া, নানা টুকরো মন্তব্যের মধ্যে বেঁচে থাকা।
‘সে আমাকে বলে– আমরা কি ধূসর কথার ফাঁদে বন্দী হয়ে উঠছি।’
‘আমি বলি– হয়তো তাই, বস্তু, চিন্তা, বিষয়, প্রবঞ্চ ও ঘটনার আবর্তে আমরা ঘুরপাক খাচ্ছি।’
‘সে বলে– তুমি যাকে আশ্চর্য ও রহস্যময় ভাবছো, সে মুখগুলি আর কারো নয়। আমাদেরই?’
‘হয়তো বা, তোমার কথাই ঠিক, আমাদের নিজেদেরকে মাঝে মাঝে স্মৃতির জলে ভেজা ভেজা চাঁদ মনে হয়?’
ফলত, এইসব কথা দিয়ে আমরা ছটফট করি, খণ্ডের বদলে অখণ্ড আর আমাদের জীবনের পুরাণকাহিনী নিয়ে ভারাক্রান্ত হই। শেষে সিদ্ধান্তে আসি– ‘মানুষ’ এই বিষয়বস্তু পৃথিবীর সমস্ত মানবিক ও সমাজবিদ্যার মূল। কিন্তু আমার স্ত্রীতো কোন বস্তু নয়, যে তাকে অধ্যায়ন ও গবেষণা করা যাবে? কেননা, তিনি বস্তু ও ভাবের আধার। আর বাংলার এই ভাবকথার সঙ্গে যখন যুক্ত হল আধুনিক আইন ও বিজনেস। ইউরোপীয় সভ্যতার এই ক্লিসে ফড়িয়া রূপ আমাদের ভাবকে শুধু নতুন মুনাফার চালাকি ও একঘেয়েমিতে শুধু ভারাক্রান্ত করিনি, করেছে স্বার্থপরও। তারপরও সে (আমার স্ত্রী) আমার নি:শ্বাস দ্বারা আমার কাছে রচিত, প্রণীত ও উদ্ভাসিত। ফলে, তাকে নিয়ে যে গবেষণা ও দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তুলতে চাই আমি– তা তার বিশ্বাসে আটকেপড়া পুর্ণজন্মের পৃথিবী।
‘সে বলে– আমাদের মস্তিষ্ক থেকে উৎসারিত উদ্ভট সব কর্মকাণ্ডই তো টোটেম?’
‘আমি বলি– তা ঠিক তুমি তো ঠাসা, ঘনপিনবদ্ধ অনুভূতির বাক্স।’
‘সে বলে– এ দেশে শিল্প বা ভাবের থেকে বিজনেজ বা কোম্পানির খ্যাতি বেশি?’
‘আমি বলি– হয়তো বা, আমরা ক্ষমতা ও রাজনীতির বিবরে বন্দি দাস।’
‘সে বলে– তারপরও তো তুমি গল্প লেখ, কাব্য করে ইতিহাসকে আক্রমণ করো।’
‘আমি বলি– হ্যা ইতিহাসের যে অংশ কংক্রিট তাকে আক্রমণ করি; কিন্তু গণিত, জ্যামিতি, দর্শন– এই অ্যাবস্ট্রাক্ট নিয়ে আমার রাজনীতি– পেণ্ডুলাম, ত্রিভূজ আর থার্মোমিটার…
‘অর্থাৎ বৃত্তের ধারণা যা তুমি বক্ষ জ্যামিতি থেকে পাও,’
‘গোলাকার বস্তু– যা এক স্বতন্ত্র বস্তু, যা আমার প্রেরণা; যাকে কবি হলে বলবে শব্দ বা ধ্বনির ধ্যানভঙ্গ,’
‘পৃথিবীর বেশির ভাগ লোক, থাকে এই গোলাকার বৃত্তে যা ঢাকায় শেরাটন কিংবা আমাজানের জঙ্গলে–’
‘কেউই বিমূর্ত জ্যামিতি, দর্শন গণিত নিয়ে ভাবেনা বরং ভাবে বৃত্তের গায়ে রক্ত মাখা কিনা?’
‘ঠিক, তারা ভাবে সত্য মিথ্য বা লাভ-লোকসান কিংবা সুন্দর কুৎসিত নিয়ে…,’
‘হয়তো, বাল্মীকি এই বোধরে বিরোধী চিন্তা করে ছিল– ক্রৌঞ্চের জন্য ক্রৌঞ্চির রক্ত গড়িয়ে পড়া আর্তনাদে,’
‘তুমি ঠিক মিথিক আখ্যানের রূপ ও রূপান্তর নিয়ে কথা বলছো,’
‘ঠিক তাই– সেই জন্য তো চিৎকার করে ভালোবাসতে চাই। তবে তোমার বা আমার প্রভুত্ব এই ক্ষেত্রে অবৈধ।’
এভাবে আমরা উদ্বেগের সঙ্গে নানা টুকরো টুকরো কথা দিয়ে ভরে ফেলি, তবু আপ্তবাব্যগুলো আমাদের মন থেকে কখনো মুছে যায়না। কেবল শৈশবের ভূত চেতনার মতো ছায়া হয়ে আমাদের ঘিরে থাকে। উহ্যত, আমরা খুব ভালো করেই জানি যে, ফুলকে ভালোবাসা একরকম বিকৃতি। পঞ্চাশ পার্সেন্ট বিকৃতি নিয়ে মানুষ সুস্থ স্বাভাবিক জীবন যাপন করে। সম্ভবত একান্ন পার্সেন্ট থেকে তার মধ্যে সংযোগহীনতার বিশৃংখল মন জেগে ওঠে। কিন্তু ফুল আর কাঁটা, ভাষা আর দেহকে মানুষের উপেক্ষা করা অন্যায় হবে? যদিও একথা না ভেবেও প্রাচীন হিব্র“ ভাষায় স্বর্গীয় ভাবে এখনও মানুষ প্রেম নিবেদন করে চলেছে। কেননা, মানুষ ভাবে প্রেমিক আত্মা মৃত্যুর পরও বেঁচে থাকে।
‘আমার স্ত্রী বলেন– বাস্তবিক এই সত্যকে তুমি কি অনুভব কর পাবলো;’
‘আমি বলি– ইমরুল কায়েস ও ওনাইজা হয়তো তার সাক্ষী হয়ে আছে।’
‘সে বলে– এই কথার অর্থ দাঁড়ায় যে, ভালোবাসা হোক আর সাম্রাজ্যবাদী কর্তৃত্ব হোক, মূলত ভাষা মানুষকে দাস বানায়?’
‘ঠিক তাই, কিন্তু মেয়েরা পুরুষের অনুকরণ করেনা, তারা ভালোবাসার নামে কারো নাক কামড়িয়ে মাংস তুলে নিয়া কিংবা দুই আঙুল দিয়ে চোখ গেলে দেওয়া– দুই-ই অপছন্দ করে।’
‘তা ঠিক, তবু একদিন নারীর কর্তৃত্ব ছিল।’
‘তুমি বলতে চাও, আমাদের শহীদ মিনার যা– মা ও ছেলে মেয়ে– এই সত্যে মায়ের কৃর্তৃত্ব দৃশ্যমান।’
‘তা কেন, নারীর শাড়ির আর নদীর পাড়।’
‘নারী গর্ভে সন্তান আর নদী জলে ফসল…’
এইভাবে পাতালপুরীর রূপকথার গল্প বলতে বলতে আমরা বুঝতে পারি। সেই আদিকাল থেকে বাংলার নারীর আত্মা কেবল পুড়ছে চন্দন কাঠের মতো। এই ভাবনা থেকে হঠাৎ আমার স্ত্রীর বক্ষ থেকে ছুটে এলো কামিনী ফুলের রাতে বয়ে যাওয়া গোপন সুগন্ধ। তারপর এই আখ্যায়িকা মাঝে বানিসা, আমার কানাডিয় বান্ধবী ঢুকে পড়ে। তার শারারীক উত্তাপ আমার পছন্দ নয়। আমার স্ত্রীর অপছন্দের মদ ও সিগারেটের মতো তাকে সবসময়ই অগ্রাহ্য করতে পেরেছি আমি। ফলে, এই স্মৃতির জট পাকানো ইতিহাসের মধ্যে বুঝতে পারি প্রাচ্যের নারী অর্থাৎ আমার স্ত্রীর বক্ষ আর ফুল, দুই-ই ফোটে রাতে। বেলি বা গন্ধরাজের কান্না সেখানে থাকে। আসলে ভালোবাসা কি অক্টোপাশের টেনে নেওয়া আগ্নেয় গহ্বর? আমরা দু’জন এই ভালোবাসা নিয়ে শহরের সমস্ত কাহিনীতে ঢুকবো বলে ডুবুরিপোশাক পরি। যতই ভেতরের মানবসমাজে ঢুকি, অন্ধকার দু’পা ফাঁক করে দাঁড়ায় আমাদের গোপন অন্তরের সামনে। যদিও এইসব ভাষা ও বিচ্ছ্বেদ ভেঙে আমার স্ত্রী আমাকে বলেনভালোবাসা মূলত ভূমিকম্পে ছিটকে ওঠা আদম-হাওয়ার কঙ্কাল।
‘আমি বলি– তা হতে পারে হঠাৎ উপলক্ষবিনা উপহার।’
‘হয়তো, সে বলে– আসলে ভালোবাসা চিনামাটির কাকাতুয়া,’
তারপর… তারপর…
এত হৃদয় উত্তাপ নিয়েও আমার স্ত্রী পত্রিকা পড়ে রুমানা মঞ্জুরের কথা তুলে আনেন ব্যথিত কন্ঠে। আর বিকৃত পরিমলকে নিয়ে শাপশাপান্ত করতে থাকেন।
… … …অত:পর আমার স্ত্রী আর আমার মধ্যে ব্যবধান বাড়তে থাকে? তিনি আগুন ও অন্ধকারের ইতিহাস পড়তে পড়তে পুড়ে যান। আর মাঝে মাঝে টেলিফোনে তার আর্তনাদে ভিতু হয়ে উঠতে থাকি আমি। খুবই বিব্রত আর অন্ধসেনাপতি হয়ে ঘোড়া নিয়ে ছুটাছুটি করতে থাকি উত্তর থেকে দক্ষিণ গোলার্ধে– ভাবি তার সাথে ভাগ হয়ে যাওয়া অস্তিত্ব নিয়ে, সকল ঘটনাকে নিয়ে গিয়ে ফেলি দুর্ঘটনার মধ্যে। তিনি যখন ‘পুরষ’ শব্দটি ঘৃণা ভরে উচ্চারণ করেন তখন আমি ভুলে যাই যে, তার বক্ষে ফুলের সত্য গন্ধ ও ছলনা আছে? নিজেকে তার সামনে হাজির করি, মানুষের জন্য দু’মিনিটের চোখে জল ফেলা রোবট হিশাবে। তারপর থেকে আমরা বুঝি– যা আমি ও আমার স্ত্রী চেয়েছিলাম, তার বিপরীত টাই ঘটতে চলেছে। নিজেদের অজান্তে এই বোধ আমাদের মধ্যে জাগ্রত হয়– তা হলে কি একথা ভাবা যায় ‘ভালোবাসা’ একে অপরের উপর একটানা প্রভুত্ব অর্জনের অস্ত্র? আর আমাদের মন দেশলাই কাঠির মাথায় জমে থাকা বারুদের মতো।