তেরই ডিসেম্বর খবরের আর্কাইভ থেকে কী যেন খোঁজার সময়, গিল স্কট হেরনের মৃত্যুসংবাদ দেখলাম। বেশ পুরানো খবর। ২৭শে মে’ ২০১১। ঠিক দুঃখ নয়, একটা শূন্যতাবোধ, জলের ফোঁটার মত অবধারিত ব্যপ্তিতে, ছড়িয়ে পড়ল। কিছু কিছু মানুষ এতখানি মিশে যায় যাপনে, চর্চায়, যে তারা সশরীরে রইল কি রইল না, সেটা একটা সময়ের পর আর প্রভাব ফেলে না। কেননা একজন চূড়ান্ত সৃষ্টিশীল মানুষ, একজন লড়াকু মানুষ, জীবনের উপান্তে আসার আগেই তার জীবনের শ্রেষ্ঠ লড়াইয়ে সামিল ; কাঁধে কাঁধ ফেলে লড়তে শেখা তার কাছেই। তার কাছেই জেনে নেয়া, চোখ তুলে সোজা তাকালে অনেক দূর অবধি রাস্তা দেখা যায়।
১৯৬১ সাল। আইভি লিগের প্রিপারেটরি স্কুল, ফিল্ডস্টন। ব্রংক্স, নিউ ইয়র্ক।
-সাবওয়ে থেকে চড়াই ধরে হেঁটে স্কুলে যাওয়ার সময় যদি তোমার কোন বন্ধুকে লিম্যুজিনে চড়ে স্কুলে যেতে দ্যাখো, তোমার কেমন লাগবে ?
– ঠিক আপনার যেমন লাগবে। সবাই তো লিম্যুজিনের খরচ কুলিয়ে উঠতে পারেনা। আপনার কেমন লাগে?
ভর্তির ইন্টারভিউতে, অন্য স্কুল থেকে বদলি নিয়ে আসা ১২ বছর বয়সী ছেলেটির সপাট উত্তর। পূর্ণাঙ্গ স্কলারশিপ নিয়ে যে ফিল্ডস্টনে ভর্তি হবে। কৃষ্ণাঙ্গ প্রধান অঞ্চল ব্রংক্সে, তাকে নিয়ে ফিল্ডস্টনে কৃষ্ণাঙ্গ ছাত্রের সংখ্যা হল পাঁচ জন। লড়াইটা সহজ ছিল না। কিন্তু লড়তে হবে, সেটা জানা ছিল। তাই আজীবন লড়াই। ভাঙতে চাওয়া সেই সমস্ত ঔদ্ধত্যকে, যা মানুষকে মানুষ হিসেবেই স্বীকৃতি দেয় না।
গিল স্কট হেরন। ব্লুজ, জ্যাজ এবং হার্লেমের রেনেসাঁ কাব্যধারার মিশ্রণে গান তৈরি হল তার গান। নিজের পরিচয় দিলেন, ‘ব্লুসোলজিস্ট’ (Blusologist)। সারা জীবন, সমসাময়িক শিল্পীদের থেকে আলাদা। অনেক দূরের। একা। কবিতায়, গানে, সমসাময়িক সামাজিক – রাজনৈতিক বিষয়বস্তু নিয়ে আগুন জ্বালানো বক্তৃতায় মন্তব্যে পালটে দিলেন র্যাপ-এর চেহারা। চার্লি প্যাটন থেকে কার্টিস মে’ফিল্ড – সম্পূর্ণ কৃষ্ণাঙ্গ উত্তরাধিকার, হেরন জড়ো করলেন নিজের মন্দ্র স্বরে। আর রইল, বুদ্ধিদীপ্ত, সূক্ষ্ণ, রসবোধ। চূড়ান্ত বর্ণবিদ্বেষগ্রস্ত টেনেসি ও দ্বিধাদ্বন্দের কালো ধোঁয়ায় হারিয়ে যেতে থাকা নিউ ইয়র্ক। সেখানেই শৈশব থেকে বয়ঃসন্ধি হেরনের। ১৯৭১ থেকে ১৯৮৪ – অ্যামেরিকার নরমপন্থী এবং তীব্র দক্ষিণপন্থী – এই দু’মুখো সমাজকে ভেঙে চুরমার করে দিলেন নিজের জীবনের তিক্ত অভিজ্ঞতা সমৃদ্ধ একের পর এক গানে। সেইসব গান – যা কখনো মিউজিক চার্টে এক নম্বর নয়; যা কখনো তাকে কোটিপতি হওয়ার পথ দেখায়নি। কিন্তু দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে দক্ষিণ ক্যারোলাইনা – এই বিস্তীর্ণ পরিসরের আতঙ্কগ্রস্ত, রক্তাক্ত, ও দুর্দশায় ভোগা মানুষদের টেনে এনে শামিল করেছে মানববন্ধনে।
ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারিতে অভিযুক্ত নিক্সনকে রাষ্ট্রপতি ফোর্ড-এর ক্ষমা প্রদর্শনের বিরূদ্ধে -‘পার্ড্ন আওয়ার অ্যানালিসিস’ নামের বক্তৃতায়, অ্যামেরিকা, যা চিরকাল দুই বর্ণে ভাগ হয়ে রইল, তাকে বললেন, “যে ক্ষমা তুমি দিলে, তা দেয়ার কোন অধিকার তোমার ছিল না।”
“We beg your pardon America, we beg your pardon once again
Because we found out that seven out of every ten black men behind jail, and most of the men behind jail are black
Seven out of every ten black men never went to the ninth grade
Didn’t have 50 dollars and hadn’t had 100 for a month when they went to jail
So the poor and the ignorant go to jail while the rich go to San Clemente
We beg your pardon America because we understand now much more deeply than we understood before
But we don’t want to take the pardon back, we want to issue some more
Pardon brother Frank Willis, the Watergate security guard, he was only doing his job
Pardon H. Rap Brown, it was only burglary
Pardon Robert Vesco, it was only embezzlement
Pardon Charles Manson, it was only mass murder
And pardon us while we get sick
Because they pardoned William Calley, 22 dead, and America in shock…
We beg your pardon America because we have an understanding of karma
What goes around, comes around
And we beg your pardon for all of the lies and all of the people who’ve been ruined and who look forward to next year because they can’t stand to look at this one
We beg your pardon America because the pardon you gave this time was not yours to give”
১৯৭১ – ‘পিসেজ অব আ ম্যান’ অ্যালবামের ‘হোম ইজ হোয়্যার দ্য হেট্রেড ইজ’, ‘রেভল্যুশন উইল নট বি টেলিভাইজ্ড’ ; ১৯৭৩-‘উইন্টার ইন অ্যামেরিকা’ অ্যালবামে রাসায়নিক নেশার বিরূদ্ধে ‘দ্য বট্ল’; ১৯৭৫-‘ফ্রম সাউথ অ্যাফ্রিকা টু সাউথ ক্যারোলাইনা’য় বর্ণবিদ্বেষ নিয়ে ‘জোহানেসবার্গ’; ’৭৮-এ, আবারও নেশার বিরূদ্ধে ‘অ্যাঞ্জেল ডাস্ট’। ১৯৮০-তে পারমাণবিক যুদ্ধাস্ত্রের আগ্রাসন নিয়ে ‘শাট দেম ডাউন’ বারেবারেই মানুষের সঙ্গ থেকে চূড়ান্ত ভাবে বিচ্ছিন্ন এই গায়ককে ফিরিয়ে এনেছে মানুষের নিকটতম বোধের কাছে।
এই ফিরে আসার পথটি হারিয়ে গেল এক সময়। কৃষ্ণাঙ্গ সমাজের বিবেক হয়ে ওঠা মানুষটিকে, তৎকালীন অ্যামেরিকান সমাজের,সঙ্গীতের অন্যতম শক্তিশালী কন্ঠস্বরটিকে তার ভিতরের অন্ধকার ক্রমশ গ্রাস করে নিচ্ছিল। বারংবার নেশার বিরূদ্ধে গান লেখা সত্ত্বেও, নেশার কবলে পড়লেন তিনি। সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলেন গানের জগত থেকে। নেশাজনিত অপরাধের জন্য জেলেও ছিলেন কিছুদিন। ১৯৮৪ থেকে ২০১০ অবধি উল্লেখযোগ্য অ্যালবাম মাত্র দু’টি। ৯৪ সালের ‘স্পিরিট্স’; ২০১০-এ ‘আই অ্যাম নিউ হিয়ার’।
১৯ বছর বয়সে প্রথম উপন্যাস ‘দ্য ভালচার’ লেখার পরে গানের দুনিয়ার হালচাল আমূল পালটে দেয়া ছেলেটির পরের উপন্যাস – ‘দ্য নিগার ফ্যাক্টরি’। মৃত্যুর আগে চার বছর ধরে লিখলেন আত্মজীবনীমূলক ‘দ্য লাস্ট হলিডে’। তার মৃত্যুর সাত মাস পরে, ২০১২-র জানুয়ারিতে, বইটি বার হয়। এমন অনেক গানও রয়ে গেছে গিল স্কট-এর, যা কোনদিন বিক্রির লেবেলই পায়নি।
‘আই অ্যাম নিউ হিয়ার’-এ হেরনের প্রাণশক্তি, ইচ্ছেশক্তি, অন্তরাত্মা – সব মিলেমিশে এক হয়ে গেছে মনে হয়। নিজেকে নিংড়ে দিয়ে এই অ্যালবামের জ্যাকেটে তিনি লিখেছিলেন, “turn off your cell phone, turn off everything that beeps, rattles or whistles.” যদি না বন্ধ করতে পার, অন্ধকার অ্যাপার্টমেন্টে পর্দা টেনে নিজেকে নিস্তরঙ্গ করে না ফেলতে পার একেবারে, আমার গান শুনো না।
হয়ত ফিরতেই চেয়েছিলেন হেরন। কি চেয়েছিলেন, জানা যায়না। হেরন তার ব্যক্তিগত বিষয়ে মুখ খোলেননি কোনদিন। তাকে গ্রাস করেছিল শিল্পী জীবনের অবিচ্ছেদ্য অভিশাপ, নিঃসঙ্গতা। নিজের লড়াইয়ের কাছে, নিজের ঔদ্ধত্যের কাছে হেরে গেলেন ক্লান্ত হেরন। কিন্তু তিনি নিজেও হয়ত জানেন না যে তিনি নেই। আসলে তো এই চলে যাওয়া, না থাকার বোধটাই নশ্বর। এতটা প্রাপ্তি অগ্রাহ্য করে একজন মানুষের না থাকা-কে গুরুত্ব দেয়া যায় না।
“Dusk arrives. My mother waters the plants. The sound of the table fan next to me together with the gurgling water from the garden hose mingle with the cries of the cockatoos that are flying across our garden. Orangish skyline. The antenna on top of the house facing ours stands alone – lonely and vulnerable. The birds left long ago. Black treetops behind the fence sway with the wind… all I can think of is death…” (লুনা রুশদী)
ভাতের গরাস মুখে তুলছি, আর এক এক মুঠি মাটি পড়ছে আমার কফিনের উপর ! আবার ভাত মুখে তুলতে গেলাম, আরও মাটি – মুঠো ভর্তি হয়ে ফুলের মতো ছড়িয়ে পড়ছে আমার কোলে গলায় মুখে। খেতে চাইছি, শ্বাস নিতে চাইছি – শিমুল তুলোর মতো ভাতের দানাগুলি, গলে যাচ্ছে আঙুলের ফাঁক দিয়ে। উইলো গাছ থেকে অজস্র সাদা পায়রা, গির্জার দিকে উড়ে গেল। আমার বাড়ি থেকে চার্চ একটু দূরে। মোটামুটি ভাবে আধ ঘন্টার রাস্তা। অথচ, আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি পুরো পথটা। আমার দৃষ্টিশক্তি পাখির মতো তীক্ষ্ণ হয়ে গেল কী করে। অল্প দূরে মেপ্ল গাছের লাল পাতাগুলো তিরতির কাঁপছে জলের মতো। যেন এখনই উপচে পড়বে ঠোঁট বেয়ে। কারুর নরম ঠোঁট মনে পড়ছে আমার। আমি কি নরম ছিলাম কখনো, এ’রকম মৃদু ? নীরব এতখানি ?
গোলাপ গাছ পুঁতছে আমার ছোট্ট মেয়ে, শে’(Chey)। লাল গোলাপের গাছ। আরেকটা গাছ হাতে নিয়ে পাশে দাঁড়িয়ে আছে তার ভাই রুমেল, বোন জিয়া। ওদের হাতেও গোলাপ গাছ। নীল গোলাপ। ওরা কী জানে, আমি গোলাপ ফুল পছন্দ করি না ? গোলাপ মানে একটা পালিশ করা সান্ত্বনা। মোমের প্রলেপ দিয়ে রক্তের তোড় আটকে দেয়ার অপচেষ্টা। গোলাপের গাছ বরং আমার ভাল লাগে। কাঁটার অন্তত কোন মুখোশ থাকে না।
তবু অনেক নীল গোলাপে আমার বিছানা ঢেকে গেলে ভালই লাগবে মনে হয়। পাখি আসবে অনেক। আমার যাওয়ার পথ উজ্জ্বল হোক – মওলা আমার সমস্ত পাপ মার্জনা করুন – এই দোয়া করছে ওরা। পাখিরা আমার উজ্জ্বলতার সঙ্গী হবে। আমি জানি, এখন অনেকদিন এইভাবে দোয়া করে যাবে ওরা। আর আমি কী দোয়া করি ? আমার স্মৃতির মায়া থেকে ওরা মুক্তি পাক। আমাকে নিয়ে না কথা বলে আমার সংগ্রামের সঙ্গী হোক। আমার লড়াই, আমার কাজ যে এখনও শেষ হয়নি। বরং এই তো শুরু।
“The revolution will not be right back after a message ’bout a
white tornado, white lightning or white people.
You will not have to worry about a dove in your bedroom, a
tiger in your tank or the giant in your toilet bowl. The
revolution will not go better with Coke.
The revolution will not fight germs that may cause bad
breath.
The revolution will put you in the driver’s seat.” (The Revolution will not be televised)
ইয়া আলি ! সংগ্রামের জয় হোক !
(উৎসর্গ ~ প্রিয় ব্লগার ইমন জুবায়েরকে )