মহানগরে পথচর বদল্যার

মলয় রায়চৌধুরী

কী এক ইশারা যেন মনে রেখে একা-একা শহরের পথ থেকে পথে
অনেক হেঁটেছি আমি; অনেক দেখেছি আমি ট্রাম বাস সব ঠিক চলে
তারপর পথ ছেড়ে শান্ত হয়ে চলে যায় তাহাদের ঘুমের জগতে
সারারাত গ্যাসলাইট আপনার কাজ বুঝে ভালো করে জ্বলে ।
কেউ ভুল করেনাকো – ইঁট বাড়ি সাইনবোর্ড জানালা কপাট ছাদ সব
চুপ হয়ে ঘুমাবার প্রয়োজন বোধ করে আকাশের তলে ।
একা একা পথ হেঁটে এদের গভীর শান্তি হৃদয়ে করেছি অনুভব;
তখন অনেক রাত– তখন অনেক তারা মনুমেন্ট মিনারের মাথা
নির্জনে ঘিরেছে এসে; মনে হয় কোনোদিন এর চেয়ে সহজ সম্ভব
আর দেখেছি কি: একরাশ তারা আর মনুমেন্ট ভরা কলকাতা ?
চোখ নিচে নেমে যায়–  চুরুট নীরবে জ্বলে – বাতাসে অনেক ধুলো
খড়;
চোখ বুজে একপাশে সরে যাই – গাছ থেকে অনেক বাদামি জীর্ণ পাতা
উড়ে গেছে; বেবিলনে একা একা এমনই হেঁটেছি আমি রাতের ভিতর
কেন যেন; আজো আমি জানিনাকো হাজার হাজার ব্যস্ত বছরের পর ।
( “পথ হাঁটা”– জীবনানন্দ দাশ )

আমি একজন রেকলুজ, একা থাকতে ভালোবাসি, একা-একা শহরের রাস্তায় ঘুরে বেড়াতে ভালোবাসি। ভারতের এবং পৃথিবীর অন্যান্য যে শহরেই কিছুকাল থেকেছি, কুড়ি বছর হোক বা কুড়ি দিন, রাস্তায়-রাস্তায় ঘুরে বেড়িয়েছি, একা-একা টহল দিয়ে চারিদিকে চোখ বোলাতে-বোলাতে ,কান পেতে, গন্ধ নিতে-নিতে, হেঁটেছি, স্রেফ হেঁটেছি, কোথাও বা ফাঁকা ফুটপাত বেয়ে শোকেস দেখতে-দেখতে আর কোথাও বা ভিড়ে গাদাগাদি মানুষ-মানুষীর মাংসময়তার ভেতরে-ভেতরে । শহরবাসীর ভাষায় দখল থাকলে যে অভিজ্ঞতা হয়, তার থেকে ভিন্ন অভিজ্ঞতা হয়েছে অজানা ভাষাভাষিদের চলমান জমায়েতে। অফিসের কাজে পশ্চিমবাংলার গ্রামাঞ্চলে সমীক্ষা করতে গিয়ে টের পেতুম যে রাজনৈতিক ভয়ে অনেকে সঠিক উত্তর দিচ্ছেন না; তখন আমার হিন্দি-উর্দু প্রয়োগ করে, যেহেতু দাড়ি-গোঁফ ছিল, আর সহকারীরা আমার পরিচয় এম আর চৌধরী বলে  দিত, অবাঙালি রূপে ভেতরের কথা টেনে বের করা সহজ হয়ে যেত। আমার ‘অপ্রকাশিত ছোটগল্প’ বইতে ব্যাপারটা নিয়ে ‘মিহিকার জন্মদিন’ শিরোনামে একটা গল্প লিখেছিলুম। ইনকগনিটো থাকার অভিজ্ঞতা।  যেমন অভিজ্ঞতাই হোক না কেন, তা বেশ আহ্লাদময়।

উনিশ শতকের প্যারিস মহানগরের পথে-পথে  টহলক্রিয়াকে চিহ্ণিত করে শার্ল বদল্যার একটি ভাবকল্প তৈরি করে দিয়ে গেছেন। ক্রিয়াটিকে তিনি বলেছেন ‘ফ্ল্যানেরি’ এবং ওই পথচর দর্শককে বলেছেন ‘ফ্লনিয়র’।

উনিশ শতকের ইউরোপে শহরগুলো দ্রুত  অভূতপূর্ব বিশাল আকারে এমন ভাবে বেড়ে উঠছিল যে শহরবাসীর অভিজ্ঞতায় সুদূরপ্রসারী প্রভাবের নকশা গড়ে দিচ্ছিল তারা । বদল্যারের ফ্লনিয়র জন্মেছিল এই নকশাটি থেকে, আধুনিকতাবাদের প্রথম চারিত্র্যবৈশিষ্ট্যের অন্যতম। গ্রামাঞ্চল থেকে এসে বিশাল মহানগরের ভুলভুলাইয়ায় নিজেকে হারিয়ে ফেলছিল ব্যক্তিমানুষ। গ্রামাঞ্চলে সে ছিল কৌমের অংশ, সবুজ ভূখণ্ডের অংশ। মহানগরের জটিল ও সর্পিল পথসমষ্টির বিভ্রান্তিকর রাস্তা, পথ, গলি, তস্যগলির ভুলভুলাইয়ায় তার কৌমপ্রতিস্ব ক্রমশ আবছা হয়ে জন্মাচ্ছিল ব্যক্তিএককের আধুনিক প্রতিস্ব। ভুলভুলাইয়াগুলোতে গড়ে উঠছিল গোপন ও নিষিদ্ধ পরিসর, যা একযোগে ভয়ের এবং আনন্দলাভের এলাকা ; সেই পরিসরে বক্তিমানুষ , অবশ্যই পুরুষ-ব্যক্তি, এলাকাটির অংশ  হয়েও আক্রান্ত হচ্ছিল পারস্পরিক দূরত্বে, অসম্বদ্ধতায়, অপসৃতির বোধে। আধুনিকতা দেশে-দেশে গড়ে তুলছিল মহানগর, এবং সেই মহানগরগুলোয়, আধুনিকতার অবদানরূপে দেখা দিচ্ছিল আলোকময়তার পরিসর ও অন্ধকারাচ্ছন্নতার পরিসর; বৈভবশালীর এলাকা ও ভিখারি জুয়াড়ি নেশাখোর যৌনকর্মী অপরাধী ও শ্রমিকদের এলাকা। যুগ্মবৈপরীত্যের বিভাজন।

গ্রিক পুরাণে আছে যে ক্রিট দ্বীপে ছিল এক সর্পিল জটিল বিভ্রান্তিকর ভুলভুলাইয়া, আর সেই ভুলভুলাইয়ায় থাকত মাইন্যটর নামের বৃষাসুর, যার দেহ মানুষের মতন কিন্তু মাথাটা ষাঁড়ের । জার্মান ভাবুক ওয়াল্টার বেনিয়ামিন ভুলভুলাইয়ার এই গ্রিক রূপকটির তুলনা করেছেন নতুন গড়ে ওঠা উনিশ শতকের ইউরোপীয় মহানগরের সঙ্গে । পথ, গলি , তস্যগলি, ইত্যাদির গোলকধাঁধায় তৈরি ভয়ের ও আনন্দের চিত্তাকর্ষক পরিসরকে তুলনা করেছেন মাইন্যটর দানবটির সঙ্গে। মহানগরের ভেতরে একটি এলাকা মানব দেহের আরেকটি ষাঁড়ের মাথার। বেনিয়ামিন ও বদল্যারসহ ইউরোপীয় ইমপ্রেশানিস্ট চিত্রকরদের অনেকেই  ভয়ের ও বাসনার যে মনোহর মেট্রপলিটান এলাকাটিতে আকর্ষিত হতেন তা যৌনকর্মী, লুম্পেন, ভবঘুরে, ছন্নছাড়া, মাতাল, নেশাড়ু, জুয়াড়ি, অপরাধী অধ্যুষিত।

১৮৬৩ সালে, যে-সময়ে  প্যারিস শহরকে পুঁজিবাদের চিত্তাকর্ষক কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলছেন তৃতীয় নেপোলিয়ান ও ব্যারন হাউসমান, সে-সময়ে, চারিদিকের ঝিকমিকে ঝিলমিলে দোকান-পশার ও তা উপভোগের জন্য উপচে-পড়া জনসমুদায়কে বিশ্লেষণ করে, নিজেকেও সেই  আয়নায় প্রতিফলিত দেখে, ‘লে ফিগারো’ পত্রিকায় শার্ল বদল্যার একটি প্রবন্ধ লেখেন, যার শিরোনাম ছিল ‘আধুনিক জীবনের চিত্রকর’ । রচনাটিতে তিনি ‘ফ্লনিয়র’  (Flaneur ) শব্দটি প্রয়োগ করেন । বদল্যারের আলোচকরা বলেছেন ফ্লনিয়র শব্দটির প্রতিশব্দ অন্যান্য ইউরোপীয় ভাষায় নেই । অনেকে অবশ্য ইংরেজি Stroller  ও Saunterer শব্দগুলো ব্যবহার করেছন । যে লোকটি পথে-পথে  গন্তব্যহীন অলস পায়ে চারিদিকে তাকাতে তাকাতে বেড়িয়ে বেড়ায়, তাকে তিনি বলেছেন ফ্লনিয়র । লোকটাকে ভবঘুরে   (Vagabond, Badaud, Gawker ) বলা যাবে না । সে কোনো-কিছুর ক্রেতা নয়, কেননা সে শপিং করতে বেরোয়নি। বদল্যার নিজেই রাস্তায়-রাস্তায় ঘুরে বেড়াতেন, একা-একা, অনেক সময়ে ভোর রাত পর্যন্ত , অপাড়া-বেপাড়া সর্বত্র। পৃথিবীর সব ভাষাতেই শব্দটি যেভাবে ব্যবহৃত ও উচ্চারিত হচ্ছে, আমি সেভাবেই তাকে বাংলায় ব্যবহার করছি। আরও অনেকে, যেমন জীবনানন্দ দাশ, ফালগুনী রায়, অসকার ওয়াইল্ড, জ্যাক কেরুয়াক পথে-পথে হেঁটে বেড়াতেন। তবে, নিষিদ্ধ পরিসরগুলো জীবনানন্দের ক্ষেত্রে কিয়দংশে নিষিদ্ধ ছিল বলেই অনুমান করি ।

ফ্ল্যানেরি, তাকিয়ে-তাকিয়ে বেড়িয়ে বেড়াবার ক্রিয়াটি, মডার্নিটির আলোচনায় বেশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে ।  ফ্লনিয়র লোকটি একা ঘুরে বেড়ায়; বন্ধুবান্ধদের সঙ্গে পথচারণা করে না, নির্দিষ্ট জায়গায় দাঁড়িয়ে গুলতানি করে না, বন্ধু বা বন্ধুনির পাশাপাশি হাঁটছেনা, কাউকে দেখে মন্তব্য করে না। বস্তুত ফ্লনিয়র লোকটি নিজে একজন অজ্ঞাত সত্তা । আধুনিকতাবাদের গর্ভ থেকে পয়দা হওয়া পুরুষালি প্যাশনের মহানাগরিক নমুনা । নগ্নিকার ছবি আঁকেন চিত্রকর, কিন্তু নগ্নিকার দিকে তাকিয়ে-থাকা একজন সাধারণ পুরুষ যে আ্হ্লাদ লাভ করে  তা স্কোপোফিলিয়া নামের চারিত্র্যবৈশিষ্ট্য । আমি আমার  ‘অরূপ তোমার এঁটোকাঁটা’ উপন্যাসে এই বৈশিষ্ট্যযুক্ত একটি চরিত্রকে উপস্হাপন করেছি, তার পুরুষালি চাউনির মাধ্যমে দখল করে নেবার প্রক্রিয়াটি কী ভাবে কাজ করে তা বিশ্লেষণের জন্যে । ফ্ল্যানেরি ও স্কোপোফিলিয়া দুটি ভিন্ন প্যাশন । স্কোপোফিলিয়া নারীর ক্ষেত্রেও ঘটতে পারে বটে, ( তরুনীরা যেমন  নগ্ন উর্ধ্বাঙ্গের হৃতিক রোশন বা  সালমান খান দেখতে ভালোবাসেন ) তবে নারীর পক্ষে ফ্লনিয়র হওয়া কঠিন বলে স্বীকার করে নেয়া যায় । মহানগরের গোপন পরিসরগুলো নারীর কাছে প্রায় অগম্য। ভিড়ের গাদাগাদির ভেতরে সেঁদিয়ে মাংসের মহাসমুদ্রের অংশ হয়ে হাঁটা সম্ভব নয় নারীর পক্ষে । উনিশ শতকের লেখিকাদের কেউ-কেউ অবশ্য তাঁদের পাঠবস্তুতে ফ্লনিয়র-নারী চরিত্র উপস্হাপন করে গেছেন, যেমন চার্লট ব্রন্টে, ক্যাথারিন ম্যান্সফিল্ড, জিন রাইস, ভার্জিনিয়া উলফ প্রমুখ । বিপজ্জনক এলাকায় প্রবেশ ও সেই পরিসরের জীবনযাত্রার দিকে তাকিয়ে গড়ে ওঠে তাঁদের উপস্হাপিত নারী-চরিত্রগুলো । নিজেদের ও শহরের মাঝের দূরত্বকে তারা কল্পনা প্রয়োগ করে মিটিয়ে ফেলতে সক্ষম হয়।

আধুনিক কবি ও চিত্রকরকে চিহ্ণিত করার জন্য বদল্যারের তৈরি ফ্লনিয়র ভাবকল্পটি, এখন ব্যবহার করা হচ্ছে ‘পোস্টমডার্ন গেজ’ বা উত্তরাধুনিক  চাউনি বিনির্মাণ করার কাজে। পুরুষের চাউনির চাপে সংস্কৃতিতে পরিবর্তন ঘটতে থাকে; বহু মহিলা নিজেদের ওই চাউনির উপযুক্ত করে তোলার জন্য আকর্ষক পোশাক পরেন, সাজগোজ করেন। পুরুষের চাউনির কথা মাথায় রেখে পণ্যবস্তু বিজ্ঞাপিত হয়, এবং সেখানেও নারীকে উপস্হাপন করা হয় টোপ হিসেবে । মিশেল ফুকো বলেছেন যে এমন নয় যে চাউনি ব্যাপারটা কারোর থাকে বা সে প্রয়োগ করে; এটি একটি সম্পর্কক্ষেত্র যেখানে কেউ প্রবেশ করে ।  দর্শক যখন কোনো বস্তুর দিকে তাকায় তখন সে ওই বস্তুটিই কেবল দেখছে না । দর্শক আসলে দেখছে সেই বস্তুটি ও নিজের সম্পর্কের দিকে । কোনো-কোনো বস্তু কেবল তাকাবার খাতিরেই তৈরি হয় , যেমন চিত্রকরদের পেইনটিঙ । এখন সাইবার জগতে একা-একা বা কয়েকজন মিলে ভারচুয়াল জগতের দিকে তাকিয়ে কোনো বস্তু বা জীবের সঙ্গে পোস্টমডার্ন সম্পর্ক গড়ে তোলে । ইনটারনেট পরনোগ্রাফিক চলচ্চিত্র বা নগ্ন নারী-পুরুষ দেখে যে দর্শক সে একজন স্কোপোফিলিক চরিত্রবৈশিষ্ট্য মানুষ । সে ফ্লনিয়র নয় ।

ফ্লনিয়রকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বদল্যার বলেছিলেন, ভিড় হল এই মানুষটির অপরিহার্য অংশ বা নিদান, পাখির যেমন আকাশ এবং মাছের যেমন জল । তার প্যাশান ও তার বৃত্তি হল জনসমুদায় নামক বিশাল মাংসল সমুদ্রের মাংসাংশ হয়ে ওঠা। একজন নিখুঁত ফ্লনিয়রের, একজন আবেগোচ্ছাসিত দর্শকের, মহানন্দ ঘটে জনসমুদায়ের হৃদয়ে নিবাসস্হান গড়ে নেবার দরুন, জনস্রোতের ঢেউগুলোর গতির ওঠা-নামার লয়ের সাথে-সাথে মিশ খাবার কারণে । সে ওই  অনন্তময় ও আশ্রয়প্রার্থী  গায়ে-গা ভিড়ের ভেতরে নিজের জন্য এমনই এক বোধে আহ্লাদিত হয় যেন সে বাড়ি থেকে বহুদূরে চলে গেছে অথচ চারিদিকেই তার বাড়ি, সমাজ-সংসার থেকে লুকিয়ে পৃথিবীকে পর্যবেক্ষণ করছে, ওই পৃথিবীটিরই অংশ হিসেবে । ওই দর্শক-কবি হল রূপকথার সেই রাজপুত্র যে সাধারণ মানুষের পোশাকে নিজেকে লুকিয়ে জনগণের কাজ-কারবার দেখার আনন্দে মজে আছে । সে হল জীবনের এমনই এক প্রেমিক যে সমগ্র জগত-সংসারকে নিজের পরিবারের অন্তর্ভূক্ত করে নিয়েছে ; কিংবা সুন্দরীদের প্রতি আকর্ষিত সেই যুবকের মতো যে ওই না-পাওয়া সুন্দরীদের নিয়ে নিজের পরিবার গড়ে তুলেছে ; কিংবা পেইনটিঙের  সেই আঁকিয়ের মতন, যার নিবাস স্বপ্ন দিয়ে বোনা এক ম্যাজি নগরীতে ,যা সে ক্যানভাসে মেলে ধরে। অর্থাৎ সার্বজনীন জীবনের প্রেমিক মানুষটি ভিড়ের ভেতরে এমনভাবে সেঁদিয়ে যায় যেন তা বৈদ্যুতিক তেজোময়তার অপরিমেয় আধার । অথবা আমরা তাকে জনসমুদায়ের মাপের সমান একটা আয়নার সঙ্গে তুলনা করতে পারি , কিংবা তুলনা করতে পারি এমনই এক ক্যালাইডোস্কোপের সঙ্গে যা নিজের চেতনার সাহায্যে প্রতিটি বিচলনে সাড়া দেয়, আর জীবনের বহুত্বময়তাকে তার উপাদানগুলোর ঝিলমিলে মাধুর্যসহ পুনরুৎপাদন করে চলে ।

তাঁর ‘প্যারিস সপ্লিন’ গ্রন্হে ফ্ল্যানেরি ক্রিয়াটিকে বদল্যার গ্রহণ করেছেন পাঠবস্তু গঠনের কৌশল রূপে, বিশেষ করে ‘ভিড়’ শিরোনামের গদ্যকবিতায় । একজন ফ্লনিয়র ঠিক কী-কী করে,তাকে উপলব্ধি করার বনেদ হয়ে উঠেছে পাঠবস্তুটি । ফ্লনিয়র চরিত্র-বিশিষ্ট কবির ব্যক্তিসত্তাটি একজন পুরুষের, যে কিনা চেয়ে-দেখা প্রাণী বা বস্তুটির দিকে তাকিয়ে-তাকিয়ে তাতে নান্দনিক মর্মার্থ সঞ্চার করে দিতে পারে ,  এবং নিজেকে ঘিরে গড়ে ফেলতে পারে, ভিড়ের সাহায্যে, আস্তিত্বিক নিরাপত্তার বলয়। তাঁর ফ্লনিয়র একজন পুরুষ কবি, যে তার ব্যক্তিগত একাকীত্ব থেকে আত্মবিতাড়িত অবস্হায় নিজের জীবনের অর্থ খুঁজে চলেছে, জনসমুদায়ের সমুদ্রে, পণ্যবাজারের মনোহারি শোভায়, নিষিদ্ধ পরিসরের গোপন খাঁজখোদরে । তার দিনের বেলাকার মেট্রপলিটান পরিবেশ হল ভিড় এবং দোকানপাট । সে ভিড়ের মানুষ ; ভিড়ের মধ্যেকার একজন মানুষ নয় । জনসমুদায়ের সাহায্যে যে শৃঙ্খলা সে নির্মাণ করছে, সে অবিস্হিত তার কেন্দ্রস্হলে , যদিও ভিড়ের অন্যান্য মানুষের কাছে সে, অর্থাৎ ফ্লনিয়র-কবি, মেট্রপলিসের নিরন্তর প্রবহমান জনসমুদায়েরই অংশ। তার আস্তিতিক বোধ তাকে ফ্লনিয়র করে তুলছে, পার্থক্য গড়ে দিচ্ছে অন্যান্যদের থেকে।

‘ভিড়’ গদ্যকবিতায় বদল্যার বলেছেন, জনতার ভেতরে নিজেকে চুবিয়ে জনতা দিয়ে স্নান করার ক্ষমতা সকলের থাকে না ; জনতা ও একাকীত্ব, এ-দুটি  হল অভিন্নরূপ যমজ অভিধা। তাদের পরস্পরকে পালটাপালটি করার ক্ষমতা রাখে ফ্লনিয়র কবি । যে মানুষ তার একাকীত্বকে জনতাপূর্ণ করতে অক্ষম, সে গাদাগাদি ভিড়েও একা থাকতে অক্ষম । আসলে  ফ্লনিয়র তো সেই রাজপুত্র যে পোশাক পালটে প্রজাদের কেন্দ্রস্হলে গোপনে প্রবেশ করেছে ; এই রাজসিক নামহীনতা, বদল্যারের মতে, ফ্লনিয়র-কবির কাছে স্পষ্ট করে মেলে ধরছে মহানাগরিক পরিসরের মর্মার্থ । সতত  অপসৃয়মান ওই প্রবাহের অন্তস্হলে যে অনন্তকাল তাকে টের পান কেবল একজন ফ্লনিয়র-কবি ।

জীবদ্দশায় বদল্যার স্বীকৃতি পাননি, তাঁর কবিতা প্রকাশ করার আগ্রহ দেখাতেন না  পত্রিকা-সম্পাদকরা, তাঁর বন্ধুবান্ধব বিশেষ ছিল না, বন্ধুনিরা তাঁকে এড়িয়ে যেতেন, চাকরি-বাকরি ছিল না, অন্যের দানের ওপর নির্ভর করতে হত তাঁকে, উদ্যমের পরিবর্তে যন্ত্রণা ভুগতে ছিলেন আগ্রহী, সংসার বলতে যা বোঝায় তা তাঁর ছিল না , থাকতেন একটি ভাড়ার বাসায়, ছিলেন মহানগরের পথচর, তাঁর কবিতায় চলে আসে জঞ্জালকুড়ুনিয়া আর ভিখারি। একাকীত্বের সেই জীবনযাত্রায় বদল্যার একা-একা পথে-পথে হাঁটতেন,নিরাময়ের উপায় হিসেবে। প্রায় মিলে যায় জীবনানন্দ দাশ ও ফালগুনী রায়ের জীবনের সঙ্গে । জীবনানন্দের থেকে পার্থক্য এই যে বদল্যার ও ফালগুনী রায় দুজনেই ছিলেন হ্যাশিশের ভক্ত ।

ওয়াল্টার বেনিয়ামিন সর্বপ্রথম বদল্যারের ফ্লনিয়র ভাবকল্পটি পুঁজিবাদের উন্মেষের প্রেক্ষিতে একটি সর্বৈব ‘মহানাগরিক অভিজ্ঞতা’ হিসেবে বিশ্লেষণ করার পুর্বে আরও অনেকে চর্চা করেছিলেন বিষয়টি । স্যঁৎ ব্যোভ বলেছিলেন যে ভাবকল্পটিকে ‘কোনও কিছু না করার’ সঙ্গে গুলিয়ে ফেলা ভুল হবে। বালজাক বলেছিলেন, ফ্লনিয়র লোকটির কাজ হল ‘চোখের মাধ্যমে ভুরিভোজ’। অ্যানাইস বাজিন বলেছিলেন যে ‘প্যারিসের সার্বভৌম কর্তা হল ফ্লনিয়র’। ভিকটর ফুরনেল বলেছিলেন, ‘ফ্লনিয়র লোকটির কাজের সঙ্গে আলস্যের কোনো সম্পর্ক নেই; তার কাজটি হল বিশেষ এক ধরনের আর্ট বা শিল্প কেননা সে মহানগরের ঐশ্বর্যময় ভূদৃশ্যের বৈভিন্ন্যেকে বোঝার ক্ষমতা রাখে।’ যাঁরা তাঁদের জীবন মহানগরের বাইরে গ্রামঞ্চলে বা উপনগরে কাটিয়েছেন, তাঁদের পক্ষে ভিড়ে গাদাগাদি রাজপথে হাঁটার এই মেট্রপলিটান অভিজ্ঞতার বিষয়টি  ঠাহর করতে অসুবিধা হবে।

ওয়াল্টার বেনিয়ামিনের বদল্যার বিশ্লেষণ বদল্যারকে উপস্হাপন করেছে আধুনিকতা ও আধুনিকতাবাদ সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান ও উপলব্ধির সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি পরিপ্রেক্ষিতে । বেনিয়ামিন মানতে চাননি যে বদল্যার ছিলেন রোমান্টিক স্বপ্নময় জগতের লিরিক কবি। তিনি বলেছেন যে বদল্যার এমনই একজন আধুনিক কবি যিনি ১৮৫০ এর দশকের পর উদ্ভূত মহানাগরিক পণ্য পুঁজিবাদের হাঙরদাঁতের মাঝে ফেঁসে গিয়ে জীবন-মৃত্যুর লড়াই লড়ছেন ; তাঁর কবিতা ও গদ্য থেকে যে বদল্যার আমাদের সামনে আসেন তিনি একজন ফ্লনিয়র, যিনি বাণিজ্যে ভাসমান প্যারিস মহানগরের রাস্তায়-রাস্তায় পদচারণা করতে-করতে তুলে নিচ্ছেন একের পর এক চলমান ছবি; তিনি পুঁজিবাদী ব্যবস্হার জঞ্জাল-কুড়ুনিয়া , যিনি কবিতায় পালটে ফেলার জন্য জড়ো করে চলেছেন শহুরে সংঘর্ষে উৎপন্ন  সামাজিক জঞ্জালের নুড়িপাথর; বদল্যার একজন আধুনিক নায়ক যিনি আধুনিক মহানাগরিক জীবনের পরস্পরবিরোধিতা ও অসম্ভাব্যতার জাঁতাকলে আত্মসমর্পণ করে সেই দুর্ভোগকে দিয়েছেন কাব্যিক অনুভববেদ্যতা । তিনিই প্রথম আধুনিক কবি-শিল্পী যিনি নিজের সৃজনকর্মকে একটি ব্র্যাণ্ড দিতে চেয়েছেন যাতে তা সাহিত্যিক পণ্যতোরণ শোভিত পথের দুধারের রঙিন শোকেসের উপযুক্ত হয়ে ওঠে। বদল্যার বুঝতে পেরে গিয়েছিলেন যে মহানাগরিক আধুনিকতার মসনদে তাঁর সাহিত্যকর্মকে কী ভাবে অধিষ্ঠিত করলে তা কালক্রমে গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠবে । একজন ফ্লনিয়র হিসাবে তিনি বাজারে ঘুরলেন, বাজারে যে মালগুলো নামছে সেগুলো দেখলেন, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে  তিনি অপেক্ষা করলেন সেই ক্রেতাদের জন্যে যারা আধুনিকতার হাতে মার খেয়ে তাঁর কবিতা ও গদ্য তুলে নিতে আসবে । সে-অর্থে বদল্যার ছিলেন একজন সামাজিক কবি, বলেছেন বেনিয়ামিন।

১৮৫০ এবং ১৮৬০-র দশকে লেখা তাঁর কবিতা ও গদ্যে বদল্যার বর্ণনা করেছেন মহানগরের পথে-পথে হেঁটে বেড়ানোর উত্তেজক অ্যাডভেঞ্চারগুলো, যা যে-কোনও নাটকের চেয়ে বেশি নাটুকে, যে-কোনও গ্রন্হে আলোচিত আইডিয়ার চেয়ে গভীর ও চিন্তা-উদ্রেককারী । ফ্লনিয়রের সঙ্গে অন্যান্য পথচারীর পার্থক্য হল যে অন্যেরা, তারা অলস পায়ে হাঁটলেও, কোনো একটা কাজে বেরিয়েছে, তাদের হাঁটার উদ্দেশ্য আছে, তাদের নির্দিষ্ট গন্তব্য আছে, যে পথে তারা হাঁটবে তা পূর্ব-নির্ধারিত, যে পথে ফিরবে হয়তো তাও পূর্ব-নির্ধারিত । ফ্লনিয়র কোথাও যাবার জন্য হাঁটছে না, তার কোনো গন্তব্য নেই, উদ্দেশ্য নেই, কেনাকাটা করার নেই । পুঁজিবাদী সমাজের দুটি প্রধান অনুজ্ঞাকে সে অবহেলা ও অস্বীকার করছে : প্রথমত তার তাড়া নেই, এবং দ্বিতীয়ত তার কিছু কেনার নেই, এমনকী সে দরদস্তুরেরও প্রয়োজন বোধ করে না । বদল্যারের ফ্লনিয়র ভাবকল্পটিকে আদর্শে রুপান্তরিত করে কোনো-কোনো অনুজ কবি কাছিমের গলায় বাহারি ফিতে বেঁধে প্যারিসের বাজারে হাঁটতে বেরোতেন, যখন কিনা ব্যস্ত লোকেরা কুকুরের বেল্ট ধরে কুকুরের পেছন-পেছন দৌড়োতেন।

ভিড়ের দরুন ফ্লনিয়র বিরক্ত হয় না; জনসমুদায়কে চলার পথে বাধা মনে করে না সে। জনসমুদায়ের মাঝে সে নিজেকে চুপচাপ খুলে ধরতে পারে যাতে সে আশপাশের সবকিছু সেই খোলা হাঁ-মুখে ফেলে-ফেলে কবিতার জন্য সঞ্চয় করতে পারে । ছবি আঁকার জন্য সঞ্চয় করতে পারে। জনসমুদায়ই তার ন্যারেটিভের উৎস । বদল্যারের সমসাময়িক সাহিত্যিকরা আগ্রহান্বিত ছিলেন ধ্রুপদি  শিল্পবস্তুর সৌন্দর্যে । বদল্যার আগ্রহান্বিত হলেন পথে-পথে পাওয়া  জীবনযাত্রার আধুনিকতায় । মহানগর যেমন নিজের প্রতি আকর্ষন করে অজস্র মানুষকে, কিন্তু এমনই তার আত্মবিরোধিতা যে একজন ব্যক্তিএককের সঙ্গে আরেকজনের অমিল ঘটাতে ওস্তাদ । ‘অমিল’ হল আধুনিকতাবাদের মহানাগরিক বীজ । অসম্ভব হলেও ফ্লনিয়র ফিরে পেতে চায় মিলগুলোকে, ফিরে পেতে চায় গোষ্ঠীসমাজের সংবেদনকে, যাকে বদল্যার বলেছিলেন, “বাড়ির বাইরে গিয়েও নিজের চারিধারে বাড়ি গড়ে নেওয়া” । স্বাধীন ও নামহীন  ফ্লনিয়র, এর দরুন, ঘটনার সঙ্গে আত্মতা গড়ে নিয়ে আহত, বিষণ্ণ, দুঃখিত, ক্ষুব্ধ ও উত্তেজিত হয়ে পড়তে পারে, এমনকী দর্শকরূপে একতরফা প্রেমেও পড়তে পারে । যে বস্তু বা যাদের  বদল্যার দেখছেন-শুনছেন তা তাঁর কাছে টেক্সটরূপে দেখা দিচ্ছে । নিজের চতুর্দিক থেকে সূক্ষ্ম অনুসন্ধান-সূত্র এবং ইশারা সংগ্রহ করেছেন বদল্যার, যা সাধারণ পথচারীদের দৃষ্টি এড়িয়ে গেছে । ভিড়ের অংশ হয়ে, যে ভিড় ছেয়ে ফেলেছে রাস্তার দুধার, ফ্লনিয়র তার টেক্সটে দৈহিকভাবে উপস্হিত । শীতল ও কৌতুহলী চাউনি মেলে, ক্ষণকালীন ও একান্ত দূরত্ব বজায় রেখে, পরিবর্তনরত প্রদর্শনীর মিছিলকে অবিরাম অধ্যয়ন করতে থাকে ফ্লনিয়র । তার অস্তিত্বে রয়েছে সক্রিয় বুদ্ধিপ্রক্রিয়া । এই নবতর সাহিত্যিক পরিকল্পনার জনক হিসাবে, সে, চাউনি ফেলে ফেলে নির্মিত সংস্কৃতির সন্দর্ভ-নির্মাতা; ফলে সে একযোগে হয়ে ওঠে প্রট্যাগনিস্ট ও দর্শক । ভিড়ের কোনো ব্যক্তির সঙ্গে তার বিশেষ সম্পর্ক নেই, অথচ যা বা যাকে সে দেখছে তার সঙ্গে সে গড়ে তোলে,সাময়িক হলেও, তার সত্তায় লীন হবার মতন গভীর ও অন্তরঙ্গ সম্পর্ক ।

ওয়াল্টার বেনিয়ামিন বলেছেন, ফ্লনিয়র নিজেকে খেলানোর জন্যে ছেড়ে দেয়, অন্যের সত্তায় লীন হবার মাদক প্রক্রিয়ায়। সে একযোগে উপভোগ করে স্বকীয় আত্মতা এবং ‘আরেকজন’ হয়ে ওঠার মজা, যেন সে দেহের খোঁজে চরে বেড়ানো একটি আত্মা । সে যথেচ্ছ অন্যের দেহে প্রবেশ করে যায় । তার বুদ্ধিবৃত্তির খাবারের খোঁজে সে যেন ভিড়ের দেহে একটি পরভুক প্রাণী। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সে নিজেরই তৈরি করা আশ্চর্যনগরীতে, কখনও এই বিপণি-জানালায়, কখনও সেই বিজ্ঞাপনের দিকে, কখনও ওই ভবঘুরের দিকে, কখনও সেই নারীটির দিকে, তাকিয়ে-তাকিয়ে,তাদের শরীরে পরজীবি হয়ে জীবনরস সংগ্রহের আনন্দ উপভোগ করে । সে নিজেই নিজের চিন্তার আদল নিয়ে চারিদিকের বস্তুজগতে চষে বেড়ায়, হাঁটতে থাকে সাধনা-তাড়িতের একাগ্রতায়,  পর্যবেক্ষণের সতর্কতায়। প্রকৃতপক্ষে তার রয়েছে পর্যবেক্ষণের  বৌদ্ধিক কর্মতাড়না। অথচ তার আছে সত্তাস্বাতন্ত্র্য।  ফ্লনিয়র নিজেই নিজের চেতনাশক্তি। বদল্যার সূত্রপাত ঘটিয়েছেন মহানগরের আধুনিক দর্শকের, মহানগরগুলোয় সে অপরিহার্য চরিত্র, একজন অ্যামেচার ডিটেকটিভ বা শহরের তদন্তকারী ।

বদল্যারের ফ্ল্যানেরি ক্রিয়া ও ফ্লনিয়র কবিসত্তা ভাবকল্পটির বিশ্লেষণ, তাঁর আলোচকদের মতে, অসম্পূর্ণ থেকে যায় তাঁর ‘ক্লেদজ কুসুম’ গ্রন্হের ‘ট্যাবলো প্যারিসিয়েন’ এর অন্তর্গত ‘পাশ দিয়ে যাওয়া পথচারিণী’ কবিতাটির উল্লেখ ব্যতিরেকে (A Une Passante)। ফ্লনিয়রের প্যাশনকে উপস্হাপনের একটি নিখুঁত দৃষ্টান্ত এই কবিতাটি । ফ্লনিয়রের ভূমিকায় অবতীর্ণ বদল্যার যাঁকে উদ্দেশ করে কবিতাটি লিখছেন, তাঁর পোশাক দেখে তিনি অনুমান করছেন যে যুবতীটি বিধবা ; যুবতীটি এক মুহূর্তের জন্য তাঁর চোখের সামনে আসেন আর অপসৃয়মান ভিড়ে মিশে যান। ওই মুহূর্তটি গড়ে তোলে অনন্তকাল। প্যারিসের মতন বিশাল শহরে একজনকে  দেখার সুযোগ বারবার ঘটার সম্ভাবনা কম। যুবতীটির চকিত চাউনির সঙ্গে কবির চাউনির আদানপ্রদানে  লুকিয়ে থাকে ক্ষণস্হায়ীত্বের অনন্তকালীন উপাদান। সেই উপাদান দর্শককে মৃত্যুর হুঁশিয়ারি দেয় এবং জীবন সম্পর্কে মুগ্ধতার ইশারাও দিয়ে যায় । যুবতীটিকে দেখে কবির অস্তিত্বে প্রেমের আভাস সৃষ্টি হয়, সে প্রেম ‘প্রথম দর্শনে প্রেম’ নয়, সে প্রেম ‘শেষ দর্শনে প্রেম’।

কবিতাটিতে ওই বিধবা যুবতীটি পথচারী ব্যক্তি-এককদের দ্বারা নির্মিত জনসমুদায়ের কথা  ঝলকের জন্য কবিকে জানিয়ে উধাও হয়ে যায়। যুবতীটি পূর্বাভাসদায়ক সম্ভাবনা ও কার্যকরিতার প্রতিমূর্তি হয়ে দেখা দেয় কবির জীবনে – আশ্চর্য নয় যে সেগুলো ভবিষ্যমুখী বৈশিষ্ট্য; অর্থাৎ কবির জন্যে ওই অচেনা মহিলা তাঁর সৃজনকর্মের সাধিত্র। অন্য যে কোনও প্রেরণাসুত্রের প্রতি  তাঁর যে আকর্ষণ সেই একই প্রেরণাসূত্র কবি পেয়ে যান যুবতীটির ক্ষণিক ঝলকে । লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, এই সনেটটি ফ্লনিয়রের বহুবিধ বিচার্য বিষয়কে মেলে ধরছে। প্রথমত, শহরের পশ্চাতপটে কান ঝালাপালা-করা আওয়াজ, যা ভিড়ের ভেতরে অকস্মাত চয়নিত বিষয়বস্তুর সঙ্গে কবির সম্পর্ককে ক্ষণিক ও আচমকা করেই শেষ হয় না; দ্বিতীয়ত, ফ্লনিয়রের পাশ দিয়ে চলে যাওয়া যুবতীটির সঙ্গে প্রা্য় ভ্যামপায়ারের আদলে জীবনরস ছেঁচে তোলার সম্পর্ক গড়ে ফেলেন কবি; যুবতীটির চোখ তাঁর কাছে পানপাত্র । ফ্লনিয়র উন্মাদের মতন কাঁপে, রোমাঞ্চিত হয় । তৃতীয়ত, তাঁদের দুজনের সম্পর্ক, যা হয়তো গড়ে উঠতে পারতো, সেই সম্ভাবনা যাচাই করার সুযোগ ঘটে না ।  পারস্পরিক চাউনি-বদল  দুজন মানুষের অস্তিত্বে নৈকট্যের অনুভূমিক মুহূর্ত তৈরি করে দেয়; চাউনি হয়ে ওঠে , ফ্লনিয়রের কাছে, এমনই এক কাল্পনিক সাধিত্র, যার সাহায্যে কবি ওই মেয়েটির শোক দুঃখ কষ্ট ও অন্যান্য ঝড়ঝাপটের অভিজ্ঞতা নিজে অনুভব করতে পারেন ,একদা বাংলায় যাকে বলা হতো “হৃদয় দিয়ে হৃদয় অনুভব”করার শক্তি । চতুর্থত, সতত অপসৃয়মান নৈর্বক্তিক রাস্তা ফ্লনিয়রকে দিচ্ছে ব্যক্তিক হাল-হকিকত অনুমানের দক্ষতা ।কবিতাটি অনেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন । আমি এখানে ১৯৫২ সালে রয় ক্যাম্পবেল কৃত অনুবাদটি তুলে দিচ্ছি:
The deafening street roared on. Full, slim, and grand
In mourning and majestic grief, passed down
A woman, lifting with a stately hand
And swaying the black borders of her gown ;
Noble and swift, her leg with statue’s matching,
I drank, convulsed, out of her pensive eye
A livid sky where hurricanes were hatching,
Sweetness that charms, and joy that makes one die.
A lightning flash –then darkness! Fleeting chance
Whose look was my rebirth – a single glance !
Through endless time shall I not meet with you ?
Far off ! too late ! or never ! – I not knowing
Who you may be, nor you where I am going–
You, whom I might have loved, who know it too.
 (রচনাকাল: ফেব্রুয়ারি-মার্চ, ২০১৩ )

 

Facebook Comments

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top