কামাল রাহমান
সুদীর্ঘ এক জীবনের তিরাশিটা বছর অতিক্রম করে হামযা আবু তাহের অভাবনীয় এক পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়ে অতীতের সবকিছুর খেই হারিয়ে ফেলে। এমন একটা বয়সে পৌঁছে বেঁচে থাকার আরো ইচ্ছা থাকলেও কারণ বিশেষ কিছুই থাকে না। অনেকটা প্রথাসিদ্ধ জীবন যাপনের ফলে কিছু কিছু কাজ এমনভাবে অভ্যাসের সঙ্গে মিশে গেছে যে ওসবের জন্য সামান্যতমও ভাবতে হয় না ওকে। যেমন ঘর থেকে বেরোনোর সময় বাম পা আগে ফেলা, ঘরে ফিরে দরজা খোলার জন্য একটু বিরতি দিয়ে দু বার ডাকা, অথবা টোকা দেয়া। দরজা খোলার সময়ও দু বার শোনা, বাইরে বেরিয়ে কারো সঙ্গে হাত মেলালে দু হাত মেলানো, বাম হাত দিয়ে অপরজনের হাতের কনিষ্ঠায় চাপ দেয়া, ইত্যাদি ইত্যাদি। এসব প্রতিটা কাজেরই ব্যাখ্যা আছে, হয়তো এর সবই অর্থহীন।
প্রথমটায় সে বুঝতে পারে নি কোনো ব্যতিক্রম কিছু হয়েছে কিনা, হয়তো কারো অপেক্ষার ঘোরে উৎকণ্ঠ ছিল, এখন অবশ্য মনেও করতে পারে না কার অপেক্ষায় ছিল! দরজায় টোকা পড়তেই লাফিয়ে এসে দরজা খুলে দাঁড়িয়ে থাকে ক মুহূর্ত, সামনে যে দাঁড়িয়ে রয়েছে সে অবিকল দেখতে একই রকম, হামযার মতো! সরাসরি তাকায় সে ওর চোখের দিকে, এর আগে এভাবে কোনো মানুষের চোখের দিকে কখনো তাকায় নি, তাকানো হয়তো যায়ও না। এক ধরনের মিশ্র প্রতিক্রিয়া হয় ওর ভেতর, যেনো কিছু দেখার চেষ্টা করে ওর চোখের গভীরে, কিন্তু সেখানে কিছুই উদ্ধার করতে পারে না।
‘ভেতরে আসবো?’ জিজ্ঞেস করে সে। একটু ভয় পেয়ে যায় হামযা, বলে
‘বাইরে আসি আমি?’
‘খুব ঠাণ্ডা পড়েছে বাইরে।’
ওকে ছাড়িয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখে সাদা তুষারে ঢেকে আছে বাড়িঘর, রাস্তাঘাট ও গাছপালা। দু একজন মানুষের ত্রস্ত-পায়ে আসা যাওয়া। অন্যান্য বছরের মতো একই রকম নির্বিকারভাবে এগিয়ে চলেছে পৃথিবীর এ সময়ের শীত ঋতুটা। শুধু হামযার ভেতরই যেনো এ মুহূর্তে বয়ে চলেছে কেমন এক অব্যাখ্যাত কোনো পরিবর্তন।
‘ঘরেও তেমন উষ্ণতা নেই।’ ওর চোখের দিকে তাকিয়েই কথা কটা বলে।
‘আমাকে যে আসতেই হবে, আপনার দুয়ারে আমিই টোকা দিয়েছি।’
‘আসুন।’ বলে সরে দাঁড়ায়।
ঘরে ঢুকে দাঁড়িয়ে থাকে সে। বসার ঘরে যেয়ে বসে হামযা, ওকেও বসতে বলে।
‘জানতে পারি কার সঙ্গে পরিচিত হচ্ছি।’
‘এটা খুব জরুরী না।’
‘পরিচয় না জেনে কিভাবে পরস্পরে কথা বলা যায়?’
‘জীবনে যে সব মানুষের সঙ্গে কথা বলেছেন আপনি তাদের সবার পরিচয় জানেন?’
একটু দ্বিধায় পড়ে হামযা আবু তাহের।
‘কি নিয়ে কথা বলবো আমরা?’
‘আমার মনে হয় আপনি আমাকে ডেকেছেন।’
‘আমি?’
‘তাই তো মনে হয়।’
‘কীভাবে? আপনিই তো আমার দরজায় টোকা দিয়েছেন।’
‘বাহ্যত তাই মনে হয়। হয়তো আমিও আপনাকে ডেকেছি। অথবা দু জনেই দু জনকে ডেকেছি।’
‘হেঁয়ালি হচ্ছে মনে হয়।’
‘জীবনটাই তো এক হেঁয়ালি হামযা আবু তাহের।’
‘এখন তো তাই মনে হচ্ছে।’
জানালার পর্দাটা সরিয়ে দিতে উঠে দাঁড়ায় হামযা। লোকটাও উঠে দাঁড়ায়, সামনাসামনি দেখে ওকে জানালা পর্যন্ত যেতে, পর্দা সরাতে, আবার এসে বসতে, পুরো সময়টাই সে মুখোমুখি, একটু অবাক হয় হামযা!
বাইরে তুমুল তুষারপাত হচ্ছে, পেঁজা তুলোর মতো তুষারে ঢেকে যাচ্ছে সবকিছু, এতো সাদা সবকিছু, পৃথিবীর এতো আলো, এতো রং সবই যেনো পরিবর্তিত হয়ে চলেছে এক অনন্ত সাদায়!
‘আমরা কি নিয়ে কথা বলবো?’
‘কথা বলার মতো কিছু নেই আর।’
‘কি বোঝাতে চান?’
‘কখনো নিজের মুখোমুখি হয়েছেন হামযা আবু তাহের?’
‘বুঝতে পারছি না।’
‘প্রত্যেককে একবার নিজের জীবনের মুখোমুখি হতে হয়।’
‘এখন তা চাই না আমি।’
‘না চাইলেও হতে হবে। এই একবারই।’
চমকে উঠে হামযা আবু তাহের, এখানেই কি সকল দৈন্যের অবসান!
‘একটু ভাবেন, আপনার পূর্বসূরিরা জীবনের অবসান সম্পর্কে কি বলেছেন?’
‘ফেরেশতা আসবেন একজন।’
‘কোন ফেরেশতা?’
নামটা অবশ্যই মনে আছে হামযার, কিন্তু এই মুহূর্তে ভয়ে উচ্চারণ করতে চাইছে না।
‘আচ্ছা বলুন তো তাকে দেখাবে কেমন?’
‘বর্ণনা করতে চাই না।’
‘ঠিক আছে, আপনার আরো কয়েক পূর্ব-পুরুষ আগে, যখন আপনার বর্তমান বিশ্বাসটা ছিল না, তখন তাদের আত্মার গতি কি হতো?’
‘দেবতা এসে নিয়ে যেতো।’
‘কোন দেবতা?’
‘এটাও বলতে চাই না।’
‘তাহলে তারও আগে, যখন এসব বিশ্বাসের জন্ম হয় নি।’
‘জানি না।’
‘জানতে চান?’
‘বলুন।’
‘স্ব-রূপ।’
ঘরের ভেতর যেনো বাজ পড়ে আকাশ থেকে। ঘেমে ভিজে উঠে হামযা, তীব্র এই শীতের ভেতরও মনে হয় চৈত্রের দহন, কি করবে বুঝে উঠতে পারে না।
‘আপনি কি ভয় পাচ্ছেন হামযা আবু তাহের?’
‘না।’
‘হয়তো ঠিক, অথবা ঠিক না। এরকম সময় মানুষের বিবেচনা-বোধ থাকে না, এক ধরনের নিষ্ক্রিয়তা গ্রাস করে।’
‘দয়া করে এখন যান, আর কথা বলতে চাই না আমি।’
‘যাওয়ার জন্য আসি না আমি।’
‘আপনাকে আমি চিনি না।’
‘তাই হয়। জীবন শূন্য থেকে শুরু হয়ে আবার শূন্যে মিলিয়ে যায়। জীবনের শুরুতে চিনতেন নিজেকে?’
‘জানি না।’
‘প্রতিবিম্ব প্রতিক্রিয়ার বিষয়টা তো জানেন, মিরর এফেক্ট। একটা শিশু আয়নায় ওর হাত দেখে ওটা ধরার জন্য হাত বাড়ায়, পা দেখে ওটা ধরার জন্য হাত বাড়ায়, মুখটা ধরার জন্য হাত বাড়ায়, পরিণত বয়সে আপনি কি আপনার পা চুলকানোর জন্য আয়নায় দেখা পায়ের দিকে হাত বাড়ান? অনেক পড়ে শিশুটা বুঝতে পারে যে ঐ হাত পা মুখ শরীর সব ওর নিজের, এবং ওটা ওর প্রতিবিম্ব। তখন সে ভালোবাসে ওর প্রতিবিম্বের মুখোমুখি হতে। কিন্তু নিজের মুখোমুখি সে একবারই হয়।’
‘দয়া করে যান আপনি, নিজের মুখোমুখি হতে চাই না এখন আমি।’
‘কেউই হতে চায় না। জন্মটা স্মৃতিতে থাকে না বলে মৃত্যুর মুখোমুখি হতে চায় না। মৃত্যু-মুহূর্তে সব স্মৃতি ফিরে আসে মানুষের।’
চিৎকার করে উঠতে চায় হামযা আবু তাহের। কিন্তু কিছুই করতে পারে না। চুপচাপ বসে থাকে নিজের মুখোমুখি, এক ধরনের নির্লিপ্ততায় অনেকটা একান্ত হয়ে।
‘আপনি যখন মায়ের শরীর থেকে বেরিয়ে এই আলো হাওয়ার পৃথিবীতে আসেন, বলেন তখন আপনার জন্ম, তাই না? আবার জীবনের শেষ, তা সে যেভাবেই হোক, বলেন সেটা মৃত্যু। শরীরে বয়ে চলেছেন জীবনের অপার রহস্য, জিন! আপনার পূর্ব-পুরুষের বংশগতি, আবার ওটাই রেখে যাবেন উত্তর পুরুষের শরীরে। তাহলে বংশানুক্রমে এটা থেকে যাচ্ছে, এভাবে তো ধরে নেয়া যায় যে আপনার জন্মের রসায়ন বা সূত্র, অথবা জেনেটিক কোড, যাই বলেন, আপনার জন্মের অনেক আগে থেকেই এ পৃথিবীতে অস্তিত্বশীল ছিল, এবং আপনার জীবন অবসানের পরও এটা থেকে যাবে। আপনার শরীরের প্রাণহীন হয়ে যাওয়াটাকে বলছেন মৃত্যু, আসলে কি জন্ম বা মৃত্যু বলে কিছু আছে?’
‘এসব কিছু তো ভাবতে চাই না আমি।’
‘এটা হয়তো ঠিক না, অবচেতনে হলেও এ প্রশ্নটা আপনার ভেতর দেখা দিয়েছে, না হলে বলতে পারতাম না আমি। আপনারা যাকে বলেন জীবন, এটা তো আর কিছুই না, মানুষের বংশ পরম্পরা অভিজ্ঞতা, যা ধারাবাহিকভাবে একজন থেকে আরেকজন বহন করে চলেছে, যে যতটুকু ধরতে পারছে, অথবা জানতে পারছে, জীবনের ততটুকুই সে পাচ্ছে। আপনার অভিজ্ঞতার বাইরে যা নেই, ওটার জ্ঞানও আপনার নেই। জ্ঞানটা প্রত্য হওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই, জানাটা বংশ পরম্পরা, তাহলে আপনার জীবন তো একটা চলমান স্রোতের অংশ। ভয় পাচ্ছেন কেন, আপনার শরীরটা না থাকলেও আপনার ঐ জিন, যাকে ব্যাখ্যা করছেন বংশগতি বলে, ওটা থাকছে। তার মানে আপনার জন্ম ও মৃত্যু দুটোই আপেক্ষিক, একটা সময়স্রোতের অংশ।’
‘এসব জটিলতার ভেতর যেতে চাই না, এুক্ষুণি বেরিয়ে যান আপনি।’
‘যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই যে আমার। আমি তো আপনি! আর আপনিই আমি।’
‘আমাকে বিভ্রান্ত করছেন কেন, দু জন মানুষ তো এক হতে পারে না।’
‘তা বলছি না। আপনারই মুখোমুখি হয়েছেন আপনি।’
‘আপনাকে বিশ্বাস করতে চাই না আমি।’
‘কীভাবে বিশ্বাস করাবো আপনাকে। নিজেকে চেনেন? পোশাক খুলে শরীরটা বের করি, নিজেকে চিনবেন তো?’
উঠে দাঁড়ায় হামযা, লোকটার পোশাকের দিকে তাকিয়ে দেখে, ওর মতো একই রকম পোশাক পরে আছে সে! অবাক হয়, ভাবতে চেষ্টা করে, এবং দ্বিধায় পড়ে যায়।
‘ঠিক আছে।’
বলার সঙ্গে সঙ্গে লোকটা পোশাক খুলতে শুরু করে, এবং হামযাও তাই করে। পুরোপুরি নগ্ন হয়ে লোকটা ওর হাত বাড়িয়ে দেয়।
‘এই দেখুন আপনার হাত, এই দেখুন আপনার পা, এখনো এগুলো আপনার বলে বুঝতে পারছেন। মনে করুন একবার আপনার শিশুকালের কথা যখন আপনার পুরো শরীরটাকে নিজের বলে বুঝতে পারতেন না। খুব শীঘ্র ঐ অবস্থায় ফিরে যাবেন আপনি।’
হামযার শিরদাঁড়া বেয়ে শিরশিরে অনুভূতি নেমে যায়, ভয়ে বিবর্ণ হয়ে পড়ে, রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে হৃৎপিণ্ড থেমে যাওয়ার অবস্থা হয়, একটা শব্দও উচ্চারণ করতে পারে না সে।
‘তাকিয়ে দেখুন, আপনার শরীরের সামনের সবকিছুই দেখতে পাচ্ছেন, ঘুরে দেখুন, পায়ের গোড়ালি দেখতে পাচ্ছেন, আরেকটু চেষ্টা করে উরুর কিছুটা অংশ, কাঁধ ঘুরিয়ে ঘাড়ের সামান্য অংশও দেখতে পাচ্ছেন, কিন্তু পেছনটা পুরোপুরি দেখতে পাচ্ছেন না।’
কিছুটা অন্যমনস্ক হয়ে পড়ে হামযা, একটু ভেবে বলেন
‘পেছনটাই দেখতে চাই আমি।’
‘একটু অপেক্ষা করুন, আর ক মুহূর্ত, মানুষ তার পেছনটা একবারই দেখতে পায়। ওটা দেখার পর আর বাকি থাকে না কিছু।’
‘এক্ষুণি, এই মুহূর্তে ওটা দেখতে চাই।’ চিৎকার করে উঠে হামযা আবু তাহের, আর ধরে রাখতে পারে না নিজেকে।
‘এখন পর্যন্ত ওটাই আপনার অতীত, যে মুহূর্তে দেখে ফেলবেন, তখনই ‘তামাম শুদ’! এর পর থেকে কালের একটা অতি ক্ষুদ্র অংশ আপনি।’
প্রাণপণে আবার চিৎকার দিয়ে উঠে সে। দোতলার শোবার ঘর থেকে দৌড়ে নেমে আসে ওর স্ত্রী। নিচে নেমে দিশে হারিয়ে ফেলে। অর্ধেক খোলা দরজার সামনে মুখ থুবড়ে পড়ে রয়েছে অশীতিপর বৃদ্ধ হামযা আবু তাহের। সাদা চুল, দাড়ি, চোখের ভ্রু ও গায়ের লোমের সঙ্গে সাদা বরফেও ঢাকা পড়েছে নিথর শরীরের অনেকটা। মায়ের চিৎকার শুনে ছেলে-মেয়েরা নেমে এসে ধরাধরি করে ঘরে নিয়ে আসে ওকে, বিস্ফারিত চোখ দুটো বন্ধ করে উত্তর শিথানে শুইয়ে দেয়, আর কখনো কারো মুখোমুখি হবে না হামযা আবু তাহের!
গল্পটি পড়লাম। ভালোই লাগল। তবে বয়সের বিষয়টা ধাঁধার ভিতর রাখলে আরও হয়ত ঘোর তৈরি হতো। তা একান্তই আমার কথা। যেমন, প্রথম প্যারাটার স্থলে ‘তিনি তার বয়সের নানান বাকেঁর ভিতর কোথায় আছেন তা তিনি বা আমরা জানি না। তিনি হয়ত নিজেকেই দেখছেন!’_ হতে পারত। হয়ত তাও আমারই ভুল।
অনেক ধন্যবাদ, কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর, খুব ভালো বলেছেন ! এমনিতেই কিছুটা বদলেছি গল্পটা, চূড়ান্ত খসড়ায় নিশ্চয় আপনার পাঠ-প্রতিক্রিয়া মনে রাখবো।