মতিন বৈরাগীর একগুচ্ছ কবিতা

একটা পাখির মুক্তি সংগ্রাম

পাখিটা সারা দিন উড়িবার আকাঙ্খায় খাঁচার ভেতরে পাখা ঝাপটায়
বাহির দেখে খাঁচা দেখে এবং আমাকেও দেখে জানালার এপাশে
এইভাবে নিত্য তার অভিজ্ঞতায় শানিত করে প্রয়োগ
আবার দেখে চারিপাশ, ফোকর-ফাঁক যতোটুকু উদোম আকাশ
আমিও দেখি শুয়ে শুয়ে বই পড়ি তার ফাঁকে কখনো নিবিড় ভাবি
আমার ভেতরেও কী একটা পাখি সারাটা দুপুর পাখা ঝাপটায়!
কখনো বা পাখির মতোন উড়ে যেতে চায় অই আকাশে !
কতোকাল আছি অদৃশ্য এই খাঁচার ভেতরে খাঁচার মায়ায়!

মাঝে মাঝে আমিও তার কাছে যাই খাঁচায় হাত রাখি
কথা বলি সোহাগ দেখাই
পাখি তার স্বভাবে খাঁচার এদিক-সেদিক ঘোরে সুযোগ পেলে
কামড়ে দিয়ে হাত
চিৎকার করে  ফাঁকে-ফাঁকে দরোজা খোলা-বন্ধের কৌশল দেখে
এভাবেই একদিন পাখিটা যৌবন পেলো খাঁচার ভেতরে
অথচ আমি হারিয়ে ফেলেছি জীবনের প্রচণ্ড সময়
এখন তার পায়ের লাল হয়েছে গাঢ়ো, গায়ের সবুজে সোনালী আভা
দুই চোখে স্বপ্নের কেবল ওড়াউড়ি–
যেনো আগামীটা অই চোখে পড়ে নেয়া যায় ।

তার পর এক দিন ভয়ানক ভয়ানক উত্তেজিত পাখিটা দোলাচ্ছে খাঁচা
প্রবল ভূমিকম্পে ওলট-পালট হওয়া নগরের মতো
যেনো শাসকের নুলা-হাত দুই-পাশে দুলছে–
ঠোঁটে কামড়াচ্ছে দরোজার হুক এবং তারপর দরোজা গলিয়ে
উঠে বসল খাঁচার উপরে,
তারস্বরের চিৎকার, টি-টি-আওয়াজ যেনো হাওয়ায় ধরেছে আগুন
মেঘেরা ফেঁটে গিয়ে গল-গল করে ঝরিয়ে দিলো রোদ
আমার মনে হলো সে চিৎকার করে বলছে
’মুক্তি-মুক্তি-ইনকিলাব জিন্দাবাদ’।

২৯.০৭.১২.

ভ্রমণ ০১

মনটা কোথায় পড়ে ছিলো কোথায় যেনো নড়ে ছিলো
তাল-পুকুরের জল
দুপুর বেলা দুপুর বেলা প্রাণ পুড়ছে রৌদ্র-জ্বালা
ঘুম পুড়ছে মন পুড়ছে ঠিক তখনই
হাওয়া এসে নাড়ায় দৃশ্য-কল

কে হারলো কী হারালো নদীর গতি শ্রাবণ রতি
মুখ বাড়ালো হরিণ-চিতা গলা
হায়রে আমার শূণ্য থালা উদোম আকাশ চেয়ে আছে
জুটছে না-তো নুন-মরিচও নেইতো মাছের নলা–

কী খেয়েছি কী নিয়েছি কী-ই-বা আছে জীর্ণ-খুপড়ি ঘরে
দাওনা তোমার গতরখানা রাজ্য-রাজার তরে
কেউ বলে না সত্য কথা কেউ বোঝে না কবির ব্যথা
কৃষ্ণ হরে রাম দেবতা সরলো কী সব করে

শুয়ে আছি শুয়ে আছি মন ফিরছে সোনাগাছি
কোন নদীতে নড়ছে একটু জল
দিন চলেছে রাতের দিকে
আঁধার কেবল লেপ্টে থাকে রাজা নড়ে রাজা মরে
উলুঝুলু বাও-বাতাসে নাড়ায় ধর্ম-কল

১৪.০৭.১২

 

ভ্রমণ ০২

ঈশ্বর আছেন অই পাড়াতে রোজ
এই পাড়াতে মিলবে না তার খোঁজ
তবু মানুষ ভাবে, ঈশ্বরকে
কেমন করে পাবে–!

ঈশ্বর সেতো হেসে কুটি কুটি
কেউ নেই তার ধরবে চেপে টুটি
তথাগত বুদ্ধ হাঁটেন ধীরে
ভাবেন, মুক্তি ওদের মিলবে কী আর
হৃদপিন্ড ছিড়ে?
কোন যোনিতে জন্ম হলে পর
জ্বরায় খরায় ভাঙবে নাতো
জীর্ণ-পাঁজর হাড়!

যিশু এসে চেয়ে দেখেন ঠায়
পুত্র-কন্যা সবাই যে তার
উপোসী গীত গায়
ডাকে, ঈশ্বর–ও’ ঈশ্বর–
আকার এবং নিরাকারের পায়

তবু ঈশ্বর থাকেন অই পাড়াতে রোজ
কি কি খায় কী-ই-বা নেয়, দিন চলে যায়,
এই পাড়াতে মিলবে না তার খোঁজ।

১৫.০৭.১২

 

ভ্রমণ ০৩

মনটা এবার ছুটছে ভীষণ জোরে কোথাও যেনো
নামবে না সে আর
আকাশ পাতাল অরণ্য-চাঁদ ঘুরে
মাখবে গায়ে মাটির অহংকার

ঘুরলো আনেক, অনেক সে দেশ আলোর গতি বেগে
থামছে না সে কোথাও ফিরে আর
পাহাড় কিংবা নদীর কোনো তীরে উড়ছে কেবল একা
দেখছে ফিরে এদিক ওদিক দিগন্ত লাল রেখা

যতোই বলি থামো একটু খানি এইখানেতে নামো
জীবন দেখো, জীবন থেমে আছে
বাড়াও না হাত অই জীবনের কাছে

তখন আকাশ এসে নামলো পাখির কাছে
বনের কাছে গাছের কাছে ভরলো উঠোন খানি
ফুটলো চাঁদ অমল হয়ে আকাশটা ফুলদানি

নিঝুম রাতি বললো এসে এবার আগে বাড়ো–

১৬.০৭.১২

 

ভ্রমণ ০৪

মনটা খুব অস্থির হয়েছে, ছুটছে ছটফট করছে–

মনেরই ভুলে সূর্য ওঠেনি হয়নি প্রভাত লাল
স্বপ্নরা সব হয়নিতো আজ হয়ে গেছে শুধু কাল
মনেরই ভুলে যায়নি কেউ উদ্যানে তুলতে ফুল
কাঁদছে মন বিজন ব্যথায় বাড়ছে কেবল ভুল

ভুলের জন্যে দিবস হয়েছে রজনীর মতো কালো
নেই স্থিরতা, শুশ্রুষা নেই শঙ্কাবিদ্ধ আলো
মনেরই ভুলে তোমার উঠনে পড়ছে শ্বাপদ পা’
ভুলের শুমারে স্বপ্ন ডুবেছে উজার হয়েছে গা’

ভুলগুলো আজ প্রতিটি দ্বারে এঁটেছে শক্ত খিল
ভাঙছে সকল প্রিয় ঠিকানা উদ্বাস্তু আজ এই নিখিল

মনটা খুব অস্থির হয়েছে, ছুটছে ছটফট করছে–

১৭.০৭.১২

 

ভ্রমণ ০৫

আমার আজ লাগছে খালি খালি
সকল দিকে বাজনা বাজে মেঘের ফাঁকে সূরয হাসে
দূর-আকাশ আনন্দে দেয় তালি–

হাসির হাসি ডাগর দু’টি চোখে, রসুই ঘরে
তেল রসুনে বাগাড় রাঁধে আগুন আঁচে
স্মৃতিরা সব যাচ্ছে বেভুল পথে
আসাতে যার ইচ্ছে ছিলো আসবেনা সে
লেজ উঁচিয়ে বললো হুলো
চৈতি দিনের উদাস বায়ূ যায় উড়িয়ে ধুলো

মনটা আজ লাগছে খালি খালি, কেউ হাসে না–
কেউ আসে না নেই কোথাও ওঠা-ছোটার ডাক
বনের পাখি নেইতো বনে হরিণরা যে শূণ্য-বনে
বাঘেরা দেয় বেজায় বড় হাক
প্রিয় মানুষ হৃদয় থেকে হয়েছে আজ পর
কে যেনো হায় বলছে কথাঃ হাসি! না-কি চাপার কণ্ঠস্বর!

কী জানি আজ বলছে ওরা আসছে কারা জাগবে কারা
দেখবে কারা উদোম নদী-দিনের সরোবর ।

১৮.০৭.১২.

 

ভ্রমণ ০৬

ঘুম চাইছি ঘুম চাইছি আয় ঘুম আয়
পাহাড় গুনি পাথর গুনি–গুনি মেষের পাল
তবুও মন ফিরছে নাতো ঘরে
ছুটছে সে-যে হাওয়ার বেগে তিতিয়ে আছে ভীষণ রেগে
হাওর-নদী পেরিয়ে শুধু যাচ্ছে ছুটে খালি
মেঘের ঘরে বাজনা বাজে আকাশ বুকে চাঁদের খেলা
তারারা আজ বাজায় করতালি–

ফিরলো যখন নানা পথের শেষে
দেখলো ঘরে কেউ ওখানে ঘুম-অঘুমে পড়ে আছে
অবাক হলো খানিক চেয়ে চেয়ে
আকাশ তখন গাইছে গান বরষা ভাঙা সুর
কোথায় যেনো বাজছে কেবল পায়ের নূপুর
ভাবলো সে-যে ক্ষণিক বোজা চোখে–

যে ছিলো আজ গোপন হয়ে
আঁধার হয়ে–আড়ালে–
ছোঁয়া-কী যায় না তারে
দু’বাহু বাড়ালে !

২২.০৭.১২

 

ভ্রমণ ০৭

বুকের ভেতর ময়ুর ডাকে তিতির ডাকে পাখির ডাক
রক্তে নেচে ওঠে, মনটা যে আজ এদিক-সেদিক ছোটে–

মনের ভেতর কতো আশা বুকের ভেতর জাগছে ভাষা
সিয়াম হবে শুদ্ধ হবে পঙ্কিলতার কালো
মনের ভেতর জ্বলবে এবার শুদ্ধতম আলো
কিন্তু তবু নড়ণ-চরণ দেখছি কেবল সাগর-দানো আসছে তেড়ে
মানুষগুলোর দিকে–

মনটা যেনো লাফিয়ে ওঠে ছুটতে চায় আরো জোরে
বলতে চায় বুক কাঁপিয়ে থামো
লুটছো সকল খাদ্য-খানা নাড়িয়ে নাচিয়ে তসবী-দানা
বিষ দিচ্ছো ভোরের আলোয় নিচ্ছো শুষে রক্ত-মাংস হাড়
হায়রে তোমার অলৌকিক কারবার–

তার পরেও ঈদ আসবে
কতো রকম কতো কথায় মানুষগুলো হাসবে
না-কী কাঁদবে তারা সারাটা দিন কাঁদবে
কাঁটা-ঝুটা চিবিয়ে কারা ঈদ-আনন্দে ভাসবে!
হাসবে ! না-কী কাঁদবে!

 

ভ্রমণ ০৮

মনটা আমার উড়ছেনা আজ ছুটছে না আর ভাবছে শুধু…

ভালো লাগে একা একা সারাটা দিন বসে থাকা
ভালো লাগে খুব নীরবে স্মৃতির ঝাঁপি খুলে দেখা
হাঁটতে থাকি হাঁটতে থাকি
অধিক চেনা রৌদ্র-পোড়া পথের মাটি সহজ কিংবা
জটিল গ্রীবার বাঁকটি ভেঙে হাঁটতে থাকা একটা পথের

ভালো লাগে হারিয়ে যাওয়া গায়ের মানুষ
ছোট্ট বেলার খেলার সাথী বয়ষ্ক স্বজন
সহজ-সরল মুখগুলো আজ স্মৃতি হয়ে আসছে ফিরে
খুঁটে খুঁটে খুলে মেলে দেখতে বড় ভালো লাগে
ভালোবাসি জোছনা উঠোন ঘরের কোনের বেগুন গাছটি
লাউয়ের মাচা মায়ের হাতের লেপা-মোছা
কিশোর কালের সে ঘরখানি তারই স্মৃতি গায়ে মাখি
উঠেও বসি বসেও ভাবি আমার প্রাণের আনন্দটুক
ভালোই লাগে ভাবতে গিয়ে
তবুও আমি কোথায় যেনো হারিয়ে আছি–

০৭.০৮.১২

 

Facebook Comments

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top