তুমি আর আমি

গৌতম চৌধুরী

 

০১.
ধীরে ধীরে একটা আদল কি গড়ে উঠছে লুপ্ত সভ্যতার
এমন প্রশ্নের জবাব কোনও দিনই দিলে না তুমি
বৃষ্টির দেশ থেকে তাই কেবলই চলে গেছি কাঁকরের দেশে
চলে গেছি জাদুঘরে, যেখানে পুস্তকের ভস্ম রাখা আছে
সমস্ত লিপিই হাস্যকর, গম্ভীর, বিপরীতমুখী
তুমি জানালা খুলে দিলে, বললে, তাকিয়ে দেখো
দেখি মুক্তি, দাঁড়িয়ে আছে হাজার হাত কালির মতো
কেবলই বদলে যাচ্ছে হাতের অস্ত্র
মিছিল থেকে ধ্বনি উঠছে – মুক্তি চাই
বস্তার ভিতর ঢুকে যাওয়ার স্বাধীনতা চাইছে এক দল নারী
মুরুব্বিদের ভড়কে দিয়ে কদমছাঁট চুলের বাচ্চাটি
গোঁ ধরেছে, আকাশে ছুঁড়বে হাউই
তুমি বললে, ভিতরে চলো, ঠাণ্ডা লাগবে
ভালোই হ’ল, আমি তো ভিতরেই যেতে চাই

 

০২.
কী কী আমার বলা উচিত ছিল, সেই কথা ভাবি
সেই গুহাজীবন থেকে শুরু করতে হবে, না চাষবাস থেকে
দেখতে গেলে, সত্য কথাই বলতে চেয়েছি তোমায়
সমস্ত কল্পনাই তো সত্য, সমস্ত নির্মাণ
সেতুর উপর দিয়ে আমি কি পৌঁছাতে চাইনি তোমার কাছে
রাষ্ট্র যে আমায় চিনতে পারেনি, সেটাই রক্ষা
হিড়িম্বার সাথে দেখা হবে বলে
আমি তো আর জঙ্গলে জঙ্গলে ঘুরে বেড়াতে পারতাম না
হারিয়ে যাওয়া নদীর গন্ধ এসে লাগে আমার নাকে
বলো, এই কথাও কি আমি লুকিয়েছি
যদি সব কথা পালটে ফেলতাম, একটু এদিক সেদিক করতাম
মহাকাব্যকার কি আমার জন্য একটু পাদটীকা জুড়ে দিতেন
আর হাসিও না, চলো যাই পিচকুড়ির ঢাল

 

০৩.
বাতাসে নানারকম কাহিনি
শুনে, কখনও ফ্যাকাশে হয়ে ওঠে মুখ
কখনও রক্ত চড়ে যায় মাথায়
জীবন শেষ পর্যন্ত কাহিনির বাইরে পড়ে থাকে
এর পরেও তুমি গিয়ে দাঁড়াবে জলের নিথর অন্ধকারে
খুঁজবে একটা অস্পষ্ট চেহারা
আগুনের রেখা কিলবিল ক’রে ছুঁতে চাইবে তোমার আঙুল
এই অবধি আমার জানা, এর পরের নির্বাচন তোমার
তুমি বললে, জানি, শেষ রাত্তিরে আচমকা
পাহাড়ের গা বেয়ে পাথর গড়িয়ে পড়ার শব্দে ঘুম ভেঙে যেতে পারে
অভিযোগলিপি হাতে, উঠে আসতে পারে তক্ষক
ঠিকই জান, তবে, রান্নার বইতে যা যা লেখা থাকে, সব সত্যি নয়
মনে রেখো, পরিমাণ মতো লবণ, একটি বিমূর্ত ধারণা

 

০৪.
দিন শেষ হয়ে এল
তুমি কি এখন স্বীকারোক্তিগুলি আউড়ে যাবে একে একে
দলমা পাহাড় থেকে নেমে আসা হাতির পাল
নাহক খানিকটা ফসল মাড়িয়ে, কএকটা গ্রাম তছনছ ক’রে চলে যাবে
এই কি শব্দের প্রতিপত্তি!
আমি কোনও নিশ্চয়তায় পৌঁছাইনি, কোনও টানাপোড়েনেও না
হাতিদের বিষয়ে তুমি অনেক কার্যকারণ দেখাবে
কিন্তু আমি তো হাতি নিয়ে কথা বলছি না
সকালের মেঘগর্জনগুলি মনে করো
ধারাবাহিক সংঘর্ষের ভিতর দিয়ে গড়ে উঠছিল একটি সকাল
মেঘগুলি ছিল নবীন এবং জলভারানত
বৃষ্টি একাই এখনও সমস্ত পাপের প্রতিবাদ

 

০৫.
অফুরান দিগন্ত অবধি নিষ্পত্র এই দৃশ্যের দিকে তাকিয়ে
আমার তৃষ্ণাও বিলুপ্ত হয়ে আসে
এই নগ্ন ও বিস্তীর্ণ তোমাকে সহ্য করার সাহস আমার নেই
তাই, শূন্যের দিকে ছুঁড়ে দিই সামান্য খড়, আর কথা বলি
যেন ওই খড়ই আমার শুশ্রূষা, আমার অন্তিম ফাল্গুন
যদি বল, সমস্ত অভিচার মিথ্যা
জেনো, এটুকু মিথ্যাই আমার সীমা
একেই সত্য বলে গ্রহণ করো

 

০৬.
চুপ ক’রে থাকাও এক শ্রম, এক ধ্যান
শুঁয়াপোকাগুলি কিছুদিন যেরকম মূক হয়ে যায়
যেমন বনদস্যুকে ঘিরে গড়ে ওঠে বল্মীক
কোমল রেণু রেণু ইলশেগুঁড়ির ভিতর দিয়ে
এইসব কথাই তুমি বলছিলে কিনা জানি না
কিন্তু স্পষ্ট টের পাচ্ছিলাম এক অপরিপূর্ণ যাত্রাপথের
দূর কোনও জলরাশি এসে স্পর্শ করল আমায়
বুঝলাম তুমি, মুহূর্ত মাত্র

 

০৭.
অপেয়কে পানীয় ক’রে তুলতে পার তুমি
কিন্তু প্রস্রবণের সামনে দাঁড়িয়ে যতই কোশেশ কর
সেখান থেকে খরগোশ বেরোবে না, কবুতরও না
কী বলছ, তবে কি জনস্বাস্থ্য কারিগরি বিভাগের
চার দেওয়ালের মধ্যে আটকে দিচ্ছ আমায়?
আমি তো জাদুকর, আমি যে জাদুকর হতে চেয়েছিলাম
রান্নাবান্নাও একধরনের জাদু, বা চাষবাস
সেসব শিখতে পার তুমি
সরু হিলহিলে ধানি লংকা ফলানোয় কৃতিত্ব কি কিছু কম
যদি কৃতিত্ব শব্দে আপত্তি থাকে, বদলে জাদু ক’রে দাও
দ্যাখো, সুন্দরী তরুণীকে কেটে দু’টুকরো করার চেয়ে
তার সম্মোহন কিছু কম না

 

০৮.
পথের মোড়ের অশথতলা অবধি তুমি এলেই, টের পাই
এমন কি নদীর ঘাটে যখন এসে লাগে তোমার নৌকা
জলের মোচড় ছলাত ক’রে এসে লাগে আমার বুকে
বিছানায় যাকে শুয়ে থাকতে দেখছ, প্রমাণ সাইজের পুতুল একটা
তুমি কি ভাবছ, পুতুলের ভিতর খড় ভরা
মোটেই না, দিব্যি রক্ত মাংস, হেঁটে চলে কথা বলে বেড়ায়
কে বক্তৃতা দিচ্ছিল এতদিন, দরাদরি করছিল বাজারে
কে স্প্রে করছিল তেলাপোকা মারার ওষুধ
আমি হে, আমি। স্রেফ তোমার জন্য এই দশা
কার না ভালো লাগে এভাবে অপরকে দোষী করতে
অপর? অপর কে?
কৌতুক না ব্যথা না বিস্ময়, কী যে ঝরে পড়ে তোমার গলায়
মনে হয় কেনা গোলাম হয়ে থাকি
মুশকিল, তুমি আবার দাসপ্রথায় বিশ্বাস কর না

 

০৯.
এই রাত্রি সাক্ষি, মৃত্যুকে আমি ভয় পাইনি
পায়ে পায়ে জঙ্গলের অনেক গভীরে চলে এসেছি
শুকনো পাতার উপর তোমার পায়ের শব্দ আমার সম্বল
আকাশের তারাগুলি নেমে এসেছে বহুদূর
দিগন্ত এদিকেও আছে, বোঝা যাচ্ছে না
তুমি কি গাছেদের ভাষা বোঝ
তবু আমার ভাষা যে তুমি বোঝ না
এমন একটা অহংকার আমাকে বাঁচাতে পারত
কিন্তু কোনও চিহ্ন রেখে আসিনি পিছনে
কিংবা তুমিই ছিলে আমার চিহ্ন, আজ আর নাই

 

১০.
আমার সমস্ত কথা তুমি কেন শুনবে মন দিয়ে
আমি কি শুনেছি তোমার সতর্কবার্তাগুলি
বলেছি, দেখ, যুদ্ধে জয়-পরাজয় আছে, এই ভেবে
তাবড় গোঁয়ার গোবিন্দও হাল ছেড়ে দেয় একদিন
সকালবেলার শিশিরে গা এলিয়ে পড়ে থাকে নিরামিষ সবজির মতো
কিন্তু যে যুদ্ধে লিপ্ত হয়নি কোনওদিন, প্রশ্ন তুলেছ তুমি –
তার অত দার্শনিকতায় কী কাজ?
বিশাল মহাশূন্যের মাঝখানে
নিজেকে একটা উজ্জ্বল জ্যোতিষ্কের মতো দেখতে না-পেলে
আক্কেল গুড়ুম হবে কেন তার!

 

১১.
অবসান শব্দটাকে তুমি সরিয়ে রাখতে পারবে না
বড়জোর ভুলে থাকতে পার দিনের পর দিন
কটা হাড্ডিকাবাব রান্নার খবর আর তুমি রাখ
সকলেই ন্যায় আর  সত্যের পক্ষে দাঁড়িয়ে
ব্যাস, হয়েছে
আমাকে বক্তৃতায় পেয়েছে ভাবছ?
আচমকা চোখের সামনে বহুরূপী দেখলে কে না ভয় পায়
আর আমি তো দেখলাম মনে মনে
জানালাটা একটু ফাঁক ক’রে তাকিয়েছিলাম অন্ধকার রাস্তায়
তুমি কি বোকা হারামের কথা শুনেছ
না শুনলেই বা কী!
ভাব, অনেক উঁচু থেকে চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়ছে একটা ক’রে ফোঁটা
নিস্তব্ধতা ভেঙে ছাঁৎ ক’রে শব্দ হচ্ছে একটা
তারপর ফের সব চুপচাপ

 

১২.
যা বলার তা বলে ফেলাই ভালো
কানুনগোর মতো কেবলই মাপজোক করতে বোলো না
দু’চারটে ভুলভাল কথা বলার নজির রেখে যেতে দাও
কিন্তু বহু দিনের অনুশাসন আমার গলা টিপে ধরে
নিজেদের জিভে জল আসা নিয়ে মিছে কথা বলারও
একটা শেষ থাকা উচিত পুরুষ মানুষের
সকল নারীর হয়ে এই কথাটি ফাঁস ক’রে দিয়েছেন যিনি
তিনিই তো আমাদের শ্রেষ্ঠ ভাববাদী
এ নিয়ে তুমি আর বকাঝকা কোরো না আমায়
বকলেই, আমি তোমাকে বলব জালিম
আর, হাঃ হাঃ, আমিই হলাম নিকিরির নিকিরি, সেরা মজলুম

 

 

গৌতম চৌধুরী # মুঠোফোন +৯১৯৪৩২৩২৩৮৬৫ # বৈডাক [email protected]

Facebook Comments

4 Comments

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top