এক
চোখ ফেরাতেই দেখি পৃথিবী ঝুলে আছে গাঢ় অষ্টকের মতো। ধরতেই আটটি পংক্তি তরমুজের মতো ফেটে যায়। প্রথম পংক্তিতে লেখা আছে: এখানে সূর্য সূঁচের মতো চিকন রশ্মিতে গেঁথে ফেলেছে ঘাস, মাটি, নীলচোখ গাঙের শরীর। দ্বিতীয় পংক্তি: উপমাবিদ্ধ চাঁদ, পিঠে তার ভাঁজ-করা চিহ্নের মতো পিছলে-যাওয়া শ্যাওলা। তৃতীয় পংক্তি তীরের মতো, মানুষের ভালবাসার কথা বলে। চতুর্থ, পঞ্চম ও ষষ্ঠ পংক্তি ত্রিভূজের মতো, নাম-না-দেয়া ভূখণ্ডের ত্রিসীমানা আঁকে। সাতের পংক্তি মানেই স্বপ্নের ভেতরে হা-করা দরজা, বাইরে তার অনেক মাঠ, অনেক দিগন্ত। অষ্টম পংক্তি: একটি আবছা রেখা, মুছে ফেললেই পারো। তবে চিহ্ন মোছারও চিহ্ন থাকে, অবশেষে।
দুই
বলে দিচ্ছি আমার এই তেরচা ডিজাইন তোমার কোনো ক্ষতি করবে না, তবে তোমায় সঙ্গে নেবে। কমল, কুমুদী, মালতি, সেউতি মানেই পাঁপড়ির ধীর প্যাঁচ, যা তোমার সঙ্গে যাবে। সবুজ পিরহানে নক্ষত্রের মতো ফুটে-ওঠা বিন্দুবিন্দু চিহ্নগুলো প্রবালের রক্তাভ নৈঃশব্দ্য জড়ো করে তাকে ধ্বনিপুঞ্জের সম্ভারে সঁপে দেবে, যেন সময়ের গভীর থেকে উঠে আসবে ইতিহাসের চিন্তাচিত্র একের পর এক। আর এভাবে তোমাকে ভোলাবে তারা, যেমন ভোলাবে তোমায় মিহিন সুরে ভালোবাসা। এভাবে সঙ্গে যাবে অনেক দৃশ্য; তবে তুলে রেখে দেবো একটি চিহ্ন, পৃথিবীর অন্তিম কৌতূহল।
তিন
[পাবলো নেরুদা: ‘ইন্টারটেক্সট’-এর অন্বেষণে]
পুরনো দিনের স্বপ্নের মতো একটি শাদা হাত বক হয়ে উড়ে যায়। উড়ে যায় সে ঐতিহাসিক মুহূর্তের মতো থমকে-থাকা নীলাভ মেঘের দিকে। আবার ফিরে আসে। তখন সে নিরঞ্জন।
একটি শাদা হাতের মতো নগ্ন তুমি, নির্যাস পৃথিবীর।
একটি শাদা হাতের মতো নিরঞ্জন তুমি, তোমার আছে সময়ের মখমলে জড়িয়ে থাকা নিখাদ চামড়া, বৃত্তের তুমুল ঘূর্ণির মতো উদ্দাম উরু, মাটির টসটসে রসে ভেজা ঘাসের সবুজ গন্ধ, আতশ চালের মতো ধবধবে শাদা হাত।
তোমার শরীরে চাঁদ রেখে যায় আঁকিবুঁকি তার।
নগ্নতায় জ্বলে ওঠো তুমি। আর এভাবে কানু ঘোষালের মতো ঝিম-মেরে বসে-থাকা সময়কে চমকে দাও তুমি। আর তোমার বান-ডাকা উদোম শরীরে দিকভাঙা নাবিক আমি, খুঁজে ফিরি নক্ষত্রমালা।
নগ্নদেহ তোমার দাঁড়িয়ে থাকে, সোনালি মন্দির এক, গ্রীষ্মের স্থির অখণ্ডতা।
চার
দেখবে, এখানে পা রাখার আগে তুমি চলে গেছো দূর সময়ের শিলালিপির মতো অচেনা অন্য নগরীতে। সেখানে নিঃসময় অরণ্যে একটি পাহাড়ি বৃক্ষ শূন্যতার সঙ্গে সংলাপে আবিষ্কার করছে তার নিস্পৃহ অবস্থান: বৃক্ষের মাতৃভাষা পড়তে চেয়েছে এক তরুণ কবি, আর ভাষা তাকে ধ্যানমগ্ন করেছে, কিন্তু পৃথিবীতে কোনো ধ্যান নেই, আছে কেবল আচ্ছন্ন হওয়ার আরশিনগর। নগর তোমাকে ডাকে, নগরী তোমার পা’কে টানে। যেতে না চাইলে তুমি হয়ে পড়ো প্রত্যঙ্গবিহীন।
আসলে তোমার কোনো দর্পণ নেই। তোমাকে তোমার সঙ্গে দেখা করতে হয় আকাশের নিচে। একটু একটু করে তোমাকেই উসকে দেয় তোমারই গাঢ় অনুপস্থিতি। তুমি দেখতে পাও গুটি বসন্তের মতো ছেয়ে-যাওয়া অসংখ্য চিহ্নভরা লালনের মুখের মতো উদ্ভাসিত টেক্সট্, যেখানে অজস্র ক্রস-রেফারেন্সের কাটতি। তুমি শুনতে পাও নদীর নিভুনিভু জ্বলাজ্বলা জোনাকি-জল চিরে বেরিয়ে-আসা সান্ধ্য সিম্ফনি, রসুনের খোসার মতো মসৃণ স্বরবর্ণ, যখন শীত-শীত রাতে লোমভরা আকাশ গা ছেড়ে দিয়ে তোমার অনুপস্থিতিকেই জড়িয়ে ধরে। তোমাকে এভাবেই ধীরে ধীরে নগর থেকে নগরে, অরণ্য থেকে অরণ্যে, বৃক্ষ থেকে বৃক্ষে, এক পা থেকে অন্য পায়ে ঘুরে বেড়াতে হয় চিহ্ন-চোর ধরতে ধরতে।
কিন্তু ইতিহাসের বাইরে কোনো চিহ্ন নেই— কিংবা পৃথিবীতে কোনো স্থির চিহ্ন নেই— যাকে দেখে বলা যায়: এই যে তুমি!
পাঁচ
[পল এলুয়ার অনুসরণে]
আমি ভেবেছিলাম গভীরতাকে কাচের টুকরার মতো খানখান করে ভেঙ্গে ফেলে দেবো নৈঃশব্দের টলমল জলে; ধ্বনিরা প্রাগৈতিহাসিক ছায়াভূতের মতো ভিড় করে আমার নিভৃত কারাগারে। কুমারী দরজা ভেজিয়ে শুয়ে থাকি একজন অত্যন্ত যুক্তিনিষ্ঠ মৃত মানুষের মতো। যে জানে কীভাবে ধীরে ধীরে মরে যেতে হয়: একজন মৃত মানুষের নগ্ন নেতি, ছাই ও প্রেম ঝলসে ওঠে মুহূর্তের বিলোপ চিহ্নে। মনে হয় রক্তের চেয়ে নির্জনতাই জীবনের কাছাকাছি।
আমি ভেবেছিলাম জীবনকে টুকরো টুকরো করে ভেঙে দেবো প্রবাহিত মুহূর্তের মধ্যে; মৃত্যুর সঙ্গে মৃত্যুকে বদলাবো; শূন্যতাকে ফিরিয়ে দেবো এ হৃদয় আর জীবনকে ফিরিয়ে দেব শূন্যতা।
ভেবেছিলাম একটি চিহ্নের মতো ঝলসে উঠবে তুমি। ছায়ারা সমর্পণ করবে নাশপাতির ঘ্রাণভরা শরীরে; সারা পৃথিবী লুকাবে তোমার মাংসের ভেতরে; ব্রহ্মের মন্ত্র উচ্চারিত হবে মিলনে।
তবুও মিলন গলে যায় গাঢ় অনুপস্থিতির উত্তাপে। মিলন মানেই যা আছে তাকে যা নেই তা দিয়ে স্পর্শ করা। মিলন মানেই যা লুকিয়ে থাকে তাকেই অজস্র ঘাসের মতো ছড়িয়ে-থাকা ইতিহাসে মেলে ধরা।
ছয়
এলো সিসিফাসের দৌহিত্র বেলেরোফেনঃ করিন্থ ভাসে ভেলার মতো মেঘের নদীতে; খুন ঝরে হরফের ওপর টুপটাপ টুপটাপ। ঝরে খুন বেলেরুসের। আর বেলেরোফেন খুন ঝরায়; রাজা নাচে ধেই ধেই ধেই, রাজ্য যায় ভেসে। রানী, পিটাস-প্রেমিক, নক্ষত্রের নীল আগুনে প্রেম প্রেম খেলা খেলে, বেলেরোফেনের আততায়ী আলিঙ্গনে।
চিহ্ন ভাসে চিহ্নের বিনাশে।
সাত
ভুরুর মতো কালো কার্ভে ওঠে-নামে চিহ্ন, যার ভেতরে তুমি থাকো। একটু একটু করে তোমাকে পড়ে নিতে হয়। তারপর তুমি নিভে যাও নিঃশব্দ ঝাপটায়। একটি চিহ্নের জন্ম সেখানেই।
দপ করে আবার তুমি জ্বলে উঠো। বিকেলের বয়সী রোদ নিভে গেলে তোমার শরীরে ঝলমল করে উঠে নক্ষত্র। তবুও নাবিক হারাতে থাকে পথ। রাজনীতি-অর্থনীতি-সমাজ সব ডুবে যায় একটি ভূখণ্ডের অন্বেষায়। চিহ্ন থাকে, চিহ্ন ডাকে, হাত বাড়ালে চিহ্ন সরে যায়। অন্য চিহ্ন চোখের তারায় জ্বলজ্বল করে। হয়তো নক্ষত্র ওটা।
আট
বুঝতে পারো কি এই নগ্নতার বহর? কৈলাসের শ্যাওলা পিঠে মেখে ভাসে চাঁদ। নীল ছাই গায়ে মেখে ভাসতে থাকে নক্ষত্রেরা; ভাসতে থাকে তারা আকাশেরই আঁকাবাঁকা ইতিহাসের পথে।
জীবনকে ভাঙতি পয়সার মতো গুনে গুনে আর কতোকাল? মাথা নোয়ালেই কি পাবে সেই মাটির ঘ্রাণ? দোহাই দিয়ে একবার এসেছিলো এইখানে বেলেরুস।
একা জামনীল রাত ফোঁটায় ফোঁটায় ঝরে, কপালে ঠেকে বুদবুদ, ভালোবাসার ঘাম।
কিছু কি পেলে? এত মৃদুস্বরে কেন এই ভালোবাসা? ঘুড়ির মতো ঘড়ি উড়ে উদ্দাম। রাত মুখ রাখে চিহ্নের চোয়ালে।
চিহ্নপাখি ক্যামনে আসে যায়!
বেশ ভালো লাগল, বিচিত্র চিহ্নবহুল, চিহ্নগর্ভ সব কবিতা। অভিনন্দন, আজফার।