চিত্ত গড়ার কাজে নিজেকে নিবৃত করা কঠিন। মানুষ তার আত্মাকে নির্মাণ করার মধ্যদিয়ে বিবেকের ক্ষতিপূরণ দেয়। জীবনের ছোটখাটো ঘটনাকে মহৎ করে তুলতে হবে– আত্মনিয়োগের বাসনা এভাবে পেয়ে বসে মানুষের মধ্যে। একে উচ্চপ্রশংসিত ভিতর-পাঠ বলা যেতে পারে। ভিতর মানে অবান্তর অর্থাৎ যে জিজ্ঞাসা আমাদের ছিটকে দিয়েছে ‘অখণ্ড’ থেকে। অন্তরের এ বিবরণী নিয়ে একটি বক্তৃতা দেওয়া যেতে পারে। বলা যেতে পারে–
পাঠক-পাঠিকা, ভদ্র মহোদয় ও ভদ্র মহিলাগণ। তবে বিবৃতিটির শুরুতে বলে রাখি– আর তা হলো; কোলাহল, আবেগ, অশান্ত নাটুকে জীবনপ্রণালি আমার পছন্দ নয়। তার বদলে বিচক্ষণ, অকপট চিন্তাধারার পক্ষপাতী। যেহেতু আমার স্ত্রী সবকিছুকে বিশ্বাস করেন, ফলে সন্দেহ প্রকাশ করা আমার জন্য সঠিক নয়।
যারা বলেন, ‘পৃথিবীর এ যাবতকালে জন্ম নেওয়া মনুষ্য জাতির কথা– সে কার্ল মার্ক্স কিংবা মোহাম্মদ, হেসাস খিস্ত কিংবা গৌতম বুদ্ধ– সবার কথাই ভেসে আছে ইথারে। এখন কোনটা মোহাম্মদ আর কোনটা হাওয়া বিবির, তা চিহ্নিত করার উপায় বের করতে হবে।’
আমার স্ত্রী নিজেকে হাওয়া বিবি না ভাবলেও আমাকে আদম ভেবে যারপরনাই উদ্বেগ ও উৎসাহ বোধ করেন। এ মানবিক চাপ করায়ত্ত করার জন্য বিশেষ গানগুলো অর্থাৎ বারবার শুনতে ইচ্ছা করে সে ধরনের গানের রেকর্ডিং চালিয়ে দিই। আমার ভেতরে এভাবে মেটাফিজিক্যাল চাপ, দূরাগত স্মৃতি ও অধিকল্পনার জগৎ তৈরি করি। কেননা, আমার ফিজিক্সের ওপর ধেয়ে আসা সৌরঝড় হয়তো আমাদের মনস্তাত্তিক চৌম্বক ক্ষেত্রে আঘাত হানতে পারে! স্ত্রীর কথা থেকে দুঃখবোধের কোনো প্রসঙ্গ এলে শুধু নয়, আমাদের বিবাহবার্ষিকী কিংবা সন্তানের জন্মদিনেও করুণভাবে ‘হ্যাপি বার্থ ডে টু ইউ’-এর শব্দ বিড়বিড়ির মধ্যেও সেই ব্যক্তিগত আবেগের সাংকেতিক ভাবকে জড়িয়ে রাখি। কিন্তু আমার স্ত্রী বদমেজাজি। সামান্য কোনো ঘটনাতেই আজকাল চট করে রেগে যায়।
আমি তাকে বলি, ‘ম্যাডাম, উত্তেজনা ফুসফুসের জন্য ক্ষতিকর। আসুন দু’জনে মিলে ফুসফুসকে বাড়তি কষ্ট থেকে রেহাই দিই।’
তিনি বলেন, ‘বদমেজাজ শব্দটা যত খারাপ তার থেকে আত্মাভিমান আমাকে বেশি গিলে খায়।’
আমি বলি, ‘ঠিক তাই। আত্মশ্লাঘা যার মধ্যে আছে তাকে বদমেজাজি বলা যায় না, বরং আচারনিষ্ঠ গুণের সংমিশ্রণের জন্য প্রশংসা করতে হয়।’
আমি আবার বলি, ‘হাওয়া বিবি বদমেজাজি ছিলেন। গোষ্ঠী-দ্বন্দ্বের কারণে আদমকে আর্সেনিক খাওয়াতে গিয়ে ভুলে প্রেমে পড়ে জোর করে ভালোবাসা আদায় করেছিলেন।’
তার মানে তুমি বলতে চাও, গন্দম ফল মূলত হাওয়া বিবির বিকাশ-উন্মুখ স্তন!
তারপর আমার তরুণী বধূটি (উলঙ্গ ও মাতাল হয়ে) আশ্রয় নেয় হৃদয়ের আলমারির ভেতর। আমাদের প্রেমটা প্রায়ন্ধ অন্ধকারের মতো। ভাবের সে ঘরে প্রথম ঢুকতে হতো শব্দের খড়িকাঠগুলো ঠেলে, তারপর কবিতার ম্যাচকাঠি দিয়ে প্রতিটি জানালায় জ্বালানো হতো আলো।
আমার স্ত্রী চিৎকার করে বলেন, ‘তুমি আমায় কবিতার গোলকধাঁধায় ছেড়ে দিয়েছ।’
আমি জানি, এটা তার নিছক আপত্তির নামে ভালোবাসার প্রকাশ। এভাবে যে ভয়, ভয়ঙ্কর বিরক্তি কিংবা বন্ধুত্বের ভাব–উদাসীনভাবে হোক আর সমীহ করে হোক, পেট মোটা স্থূল এই টেকো লোকটিকে সে সহ্য করে চলেছে এতকাল। আমরা জীবনটা গোপন রেখেছিলাম কেননা, আমাদের ছেলে টেকোদের নিয়ে অযাথা বিরুক্তি প্রকাশ করে আজকাল। আর আমার স্ত্রীর ধারণা, গোপন না থাকলে আদম-হওয়ার ধর্মজ্ঞান নষ্ট হয়। কাজেই ছেলেমেয়েদের থেকে তিনি আমাদের পাতালপুরীর ভালোবাসার ছবিগুলো দূরে রাখেন।
তিনি আমাকে বলেন, “দোজখ কি ‘অখণ্ড’ থেকে ছিটকে পড়া মানুষের ‘খণ্ডে’ চ্যুত হওয়া আÍজিজ্ঞাসা, নাকি নাড়ি কেটে যাওয়া সম্পর্কের বেদনার নাম”?
আমি বলি, ‘এটা কি মানুষ ও প্রকৃতির দুম করে দরজা বন্ধ হয়ে যাওয়া ঐতিহাসিক ব্ল্যাকহোল?’
‘হয়তো বা’ সে বলে, ‘অদ্ভুত এই কান্ড যার শাখা-প্রশাখা দিয়ে তৈরি এই জীবনের স্বরবর্ণ।’
‘জগতের দিনরাত্রি, জুতোর ভেতরে লুকানো পৃথিবী কিংবা জগৎ পাথারে লুকানো থাকে তাই মানুষের অন্তর।’
এসব অধিবিদ্যা বিষয় ও আগুন জমা হয় আমাদের বক্ষে। প্রশ্ন হয় কত জোড়া জিজ্ঞাসা আছে বেদনার ভেতর।
অতঃপর আমার স্ত্রী বলেন, ‘আগুন ও চাকার পর পৃথিবীর আবিষ্কার কী?’
আমি বলি, ‘আগুন ও চাকার আগে পৃথিবীর আবিষ্কার ছিল রমণীর কেশে ফুল গুঁজে দেওয়া।’
তুমি বলতে চাও ‘কবিতা’ কিংবা ‘প্রেম’ আগুন ও চাকার আগে মনুষ্য জগৎকে জীব থেকে মুক্তি দিয়েছিল?
‘হ্যাঁ, সম্পত্তির মালিক হওয়ার আগে মানুষ পৃথিবী সেলাই করে তার বুকে জুড়ে দিয়েছিল চাঁদের হাসি।’….
আমার স্ত্রীর ধারণা, এসব কথার মধ্যে কাহিনী নেই। ফলে তা গল্পো হয়ে ওঠার কৌতূহল সৃষ্টি করে না।
পৃথিবীর বিষুব রেখা বরাবর এক ক্রূর ক্ষতচিহ্ন এঁকে তিনি শাপ-শাপান্ত করেন। কী হবে মাঠে গজিয়ে ওঠা ঘাসগুলোর… কিংবা বুনো ব্যাঙটা লুকিয়ে তাকে যে গর্তে, সেই ডোবায় এখন নোনাজল….। আমার স্ত্রীর ভাবনা বিষয়ে, আমি এই কথার কোনো কূল-কিনারা পাই না।
দর্শন শাস্ত্রে পড়েছিলাম, ‘আমি আছি তাই আমি ভাবি’ কিংবা ‘আমি ভাবি তাই আমি আছি’। আমার স্ত্রীর এ গোলকধাঁধাময় প্রশ্নে সে কথা মনে জেগে ওঠে।
এরপর আমরা একে অপরের ক্ষতচিহ্নটির কথা উল্লেখ করলাম।
বললাম, মগজের ভেতর থেকে জখম শব্দটি বের করে ফেলা উচিত। তারপর মাথার খুলিতে পুঁতলাম গোলাপের চারা।
আসলে এতক্ষণ যে কথাগুলো বলা হলো তার বেশির ভাগই কবিতার মতো। একে তিনভাগে ভাগ করা যায়। এর ৬৫ শতাংশ কবিতা, যা আম-পাঠককে নন্দন জ্ঞান দেবে। ২৫ শতাংশ পণ্ডিত ও বোদ্ধদের জন্য, যা পাঠ করে তারা বর্জ্যখানায় ছুড়ে ফেলা বোধগুলোকে ফুল ফোটাতে শিখাবেন। বাকি ১০ শতাংশ আমার ও আমার স্ত্রীর জন্য।
মনসুর হাল্লাজ যে কথা বলেছিলেন– ‘আনাল হক’, তা বোঝার জন্য আমার স্ত্রী পৃথিবীর জিহ্বার কাছে এসে আমাকে ডাকলেন।
আমি বললাম, ‘আমি’র মহাকাল নেই। সে চিরকালীন। আছে ও থাকবে।
আমার স্ত্রী কর্কট। আমি সিংহ। ২০১১ সালে আমরা খুলে বসেছি হাওয়া বিবির রাশিচক্রের বই। খোদা জানেন, এই খেয়ালি কথামালার শেষ কোথায়। তারপরও বিশেষ ভাবনা ও স্বপ্ন জগতের উন্মোচন নিয়ে আমরা খাতা ভরে তুলি।