(পূর্বপ্রকাশিত-র পর)
রঙ্গ ও রহস্যভরা প্রদেশ…
রঙ্গভরা বঙ্গদেশে কত যে রঙ্গ-রগড় হয়! এইতো সেদিন আক্কেলডাঙ্গা ইউনিয়নের গমচোরা চেয়ারম্যান আলফাজ উদ্দিন রাগের চোটে, বিগাড়ের বশে ঘোষণা দিয়ে বসল আমরণ অনশনের। গম বরাদ্দ পেয়েছে কম। চেয়ারম্যানের এক পেয়ারা ইল্লৎ অনুচর কুবুদ্ধি দিয়েছে তাকে, “এক কাজ করেন, আমরণ অনশন শুরু কইরা দ্যান। তাইলে দেখবেন, আপনার নাম ছড়ায়া পড়বো, দুইদিন যাইতে না যাইতেই দেখবেন মন্ত্রী, এমপি, ডিসি, এসপি সবাই ছুইটা আসতেছে অনশন ভাঙ্গাইবার লাগি, সবাই আপনেরে সাধাসাধি করবো, মুখে শরবত তুইলা ধরবো, টিভি-ক্যামেরা ছবি তুলবো, এক্কেরে হুড়াহুড়ি পাড়াপাড়ি লাইগা যাইবো…নামও হইবো, কামও হইবো, আর বরাদ্দ আইবো হুড়মুড়ায়া, আর দ্যাখেন-না খালি, হায়বর মণ্ডল কেমুন হায় হায় করে, জিন্দেগিতে আর সাহস করবো না ইলেকশনে খাঁড়াইতে। আপনে পাবলিকের উদ্দেশে বক্তৃতা দিবেন, “ভাইসব, এই আক্কেলডাঙ্গার জনগণের জন্যে, তাদের রাস্তাঘাট আর পাকা পায়খানার জন্যে আমার এই আমরণ অনশন।” পাবলিক সব আপনের কাছে আইসা বইসা থাকবো, আপনের সাথে একাত্মা হয়া সাহস দিতে থাকবো।”
পাবলিক অবশ্য এসেছে বটে অকুস্থলে, যেখানটায় মঞ্চস্থ হচ্ছে আলফাজের অনশননাট্য, ইউনিয়ন পরিষদ অফিসের সামনের সেই ভেরেণ্ডাগাছের তলায়, তবে সাহস দিতে নয়, এসেছে পাহারা দিতে, পালা করে, যাতে লুকিয়ে লুকিয়ে কিছু না খেতে পারে চেয়ারম্যান। চেয়ারম্যানের লোকজন বড় একটা রঙচঙে ব্যানারও টাঙিয়েছে- “আলেক্কডাঙ্গার জনগণের স্বার্থে চেয়ারম্যান আফলাজ উদ্দিনের আমরণ অনশন”। ‘আক্কেলডাঙ্গা’-র জায়গায় ভুলে ‘আলেক্কডাঙ্গা’ লিখেছে আর্টিস্ট। তাই নিয়ে চেয়ারম্যানের শুক্র এমনভাবে শিরোধার্য হয়েছে যে নিজের নামটাই যে ভুল লেখা সেটা খেয়াল করছে না।
এদিকে একদিন যায়, দুইদিন যায়, তিনদিন যায়, সাঙ্গাতরা নানান জায়গায় মোবাইলে খবর পাঠায়, কিন্তু আসে না কেউই। এক অদ্ভুত জীবনমরণ সমস্যায় পড়ে গেছে চেয়ারম্যান। এদিকে জঠরের তীব্র অ্যাসিড, তাতে আবার ধরেছে দাউদাউ আগুন। আচ্ছা এক গ্যাঁড়াকল! না পারে ভাঙতে অনশন, না পারে সইতে ক্ষুধার আগুন। রঙ্গচিঙ্গা চেংড়াগুলা তো মজা দ্যাখে খুব। বলে, “বোঝ ব্যাটা, খিদার জ্বালা কেমন!” আবার, চেয়ারম্যানের দশা ‘ভিক্ষা চাই না মা কুত্তা সামলা’ নাকি ‘ছাইড়া দে মা কাইন্দা বাঁচি’, কোনটা, তা নিয়েও গবেষণা করে কতিপয় দুষ্ট যুবক। নাটকের শেষ অঙ্কে এসে, পাবলিকের কাছে মাফটাফ চেয়ে আধমরা চেয়ারম্যান নিজে নিজেই ফ্রুটিকা খেয়ে অনশন ভাঙে। এভাবে আচ্ছা আক্কেল পায় আক্কেলডাঙ্গার চেয়ারম্যান।
চা-মিষ্টির এক দোকান আছে মাটিডালিতে। অভাবিতপূর্ব, অনির্বচনীয় একধরনের স্বাদ ও গন্ধ দোকানটার চা ও মিষ্টিতে। একবার খেলে স্বাদেন্দ্রিয়ে তার রেশ লেগে থাকে বহুদিন। দোকান খোলা থাকে অনেক রাত পর্যন্ত। দূরপাল্লার ড্রাইভারেরা বাস-ট্রাক থামিয়ে চা-মিষ্টি খায় এখানে। আগেই বলেছি মিষ্টি খুব পছন্দ কবিদের। কবিতা নিয়ে অবিরাম ভাবনাচিন্তা, তুমুল আড্ডা, তর্কবিতর্ক সারাদিন এইসব করতে করতে কবিদের শরীর থেকে বিকীর্ণ হয়ে বেরিয়ে যায় প্রচুর রেশমি-রেশমি চিনিবাষ্প, হাওয়াই মিঠাই আকারে। তা ছাড়া কবিরা চিনি দিয়ে মিতালি পাতায় পিঁপড়াদের সাথে। কবিদের শরীরে জাগে তীব্র মিষ্টিবাসনা। মহিমাগঞ্জ থেকে আজ বগুড়ায় এসেছে কবি মজনু শাহ। সারাটা দুপুর, বিকাল, সন্ধ্যা আড্ডা দিয়েছি আমরা কয়েকজন। রাত একটু ঘন হয়ে এলে নেউলের মতো বেরিয়ে পড়লাম আমরা তিন নিশাচর… মিষ্টির দুনির্বার আকর্ষণে। রিকশার সিটের দুই পাশে বসেছি দুজন, মজনু আর আমি, দুজনের দুই কাঁধে দিব্যি দুই পা ঝুলিয়ে স্নিগ্ধ ননীচোরার মতো নতমুখে বসে আছে কিশোর কবি অমিত রেজা চৌধুরী। ক্ষীরের সন্দেশের মতো চাঁদ উঠেছে আকাশে। চাঁদ থেকে বিচ্ছুরিত মিহি মসলিন সুতার কোটি-কোটি ঝালর উড়ছে বাতাসে। কবিদের রিকশা চলছে ওইসব সূক্ষ্ম মসৃণ এলোমেলো উড়ন্ত জ্যোৎস্নাতন্তু ঠেলে ঠেলে। তিনজনে মিলে সারা গায়ে শুষে নিচ্ছি সেইসব রেশমি বিকিরণ আর পাঁচ-পাঁচটি ইন্দ্রিয়ের ওপর ঘটিয়ে তুলছি পাঁচ-পাঁচ রকমের ব্যতিক্রমী সালোকসংশ্লেষণ।
চা-মিষ্টি-সন্দেশ খেতে খেতে একই টেবিলে বসা বাসের হেলপার আর কয়েকজন যাত্রীর সাথে গুলতানি মারলাম কিছুক্ষণ। যাত্রী তিনজন কাজ করে ইটের ভাটায়, বাড়ি ভুরুঙ্গামারি, মাস-কয়েক একনাগাড়ে কাজ করে বাড়ি ফিরছে। বেশ কয়েকটি আধুনিক কবিতাও শোনালাম তাদের, বাংলা ভাষার বিখ্যাত বিখ্যাত সব কবিতা, কণ্ঠে বেশ আবেগ ও দরদ লাগিয়ে লাগিয়ে পড়লাম। কিন্তু এ কী! ও মা, এ দেখি বিরক্ত হয়, কিছুটা রাগ-রাগ ভাবও। বলে, “কী সব পড়েন-না আপনেরা! ছাগলের নাদি আর জঞ্জালের চচ্চড়ি!” বুঝলাম, আমাদের কাছে যা কবিতা, ওদের কাছে তা নির্যাতন, ওদের সৌন্দর্যবোধের ওপর নির্যাতন। অমিত বলে, “আচ্ছা, উৎপলের একটা কবিতা শোনাই?” একজন বলে ওঠে, “কার? লুৎফুলের? হ, হুনছিলাম, মধু শ্যাখের ব্যাটা পাগলা লুৎফুল নাকি কবিতা ল্যাখে। হ্যার কবিতা?” আমি তখন বলি, “তাইলে ছন্দের একটা কবিতা শোনাই?” বেয়াদব হেলপারটা বলে কী জানেন, “থোন ফালায়া আপনাগো ছন্দ। আপনাগো ছন্দ, না পাদ-মারা গন্ধ!” তো, দেখলাম আর এগিয়ে কাজ নাই।
সুবিল। করতোয়ার সরু একটা শাখা। বাড়িঘর, গাছপালার ভেতর দিয়ে এঁকেবেঁকে বয়ে গেছে হালটের মতো। ফিনিকফোটা জ্যোৎস্না। ফেরার পথে দেখলাম অদ্ভুত এক দৃশ্য- ঘোষপাড়ার নিতাই ঘোষ মালকোছা মেরে পলো খালুই নিয়ে গোয়ালঘর আর বাঁশঝাড়ের পাশ দিয়ে দুড়দাড় করে নেমে পড়ছে সেই হালটে। আর বাঁশঝাড়ের ভেতর একটা বাঁশ ধরে দাঁড়িয়ে আছে তার বউ। হালটে কোমর-পানি। সেই পানিতে গভীর রাতে একা-একা নিতাই খপ-খপ করে পলো ফেলে মাছ ধরছে। এত মাছ এলো কোত্থেকে! রিকশা থামিয়ে খেয়াল করে দেখি-কি, হালটের জলে ভেসে যাচ্ছে সোনালি সোনালি সব বাঁশপাতা। আর নিতাই যেই পলো ফেলছে একেকটি বাঁশপাতার ওপর, অমনি খলবল করে উঠছে পানি এক ঝলক আর ওই সোনালি বাঁশপাতা বদলে যাচ্ছে রুপালি বাঁশপাতারি মাছে। নিতাই সমানে সেই মাছ ধরে ধরে রেখে দিচ্ছে কোমরে-বাঁধা খালুইয়ে। অবিশ্বাস্য এই দৃশ্য এখনো মুদ্রিত হয়ে আছে আমার চোখের তারায়। জানি না মজনু আর অমিতের মনে আছে কিনা। কী মজনু, মনে আছে? অমিত, মনে পড়ে? কিছু বলছেন না যে আপনারা?
পরে শুনেছিলাম, নিতাইয়ের নতুন পোয়াতি বউয়ের বাঁশপাতারি মাছের চচ্চড়ি খাওয়ার খুব সাধ হয়েছিল, কয়েকদিন ধরে ঘ্যানঘ্যান করছিল নিতাইয়ের কাছে। নিতাই জোটাতে পারে না। অগত্যা গভীর রাতে হালটের পানিতে নেমেছে নিতাই, আর গর্ভিণী নারীর প্রবল ইচ্ছাশক্তির জোরে বাঁশপাতা রূপান্তরিত হচ্ছে বাঁশপাতারি মাছে। ফিনফিনে অ্যালুমিনিয়াম পাতের মতো চকচকে মাছ, গর্ভিণীর বহুবাঞ্ছিত গর্ভদোহদ।
এরকম মাঝে-মধ্যে ঘটে কিন্তু দুনিয়ায়। ঘটে না?
(চলবে…)
আমি নিয়মিত এই ম্যাগ.এ লিখতে চাই,পড়তে চাই।