চাঁদ, প্রজাপতি ও জংলি ফুলের সম্প্রীতি-৮

মাসুদ খান

(পূর্বপ্রকাশিত-র পর)

আঙুর ও কামরাঙা ভরে ওঠে হর্ষবিষাদ রসে…

ঘুমঘুম উদাস দুপুর। সমগ্র চরাচর যেন ঝিমাচ্ছে নিঃশব্দে। ফসলের মাঠে, গাছের পাতায়, করতোয়ার জলে বাতাসের যে হল্লা, হাওয়ার যে গুলতানি ছিল সকালবেলার দিকে, থেমে গেছে সব। কলহপরায়ণ সাতভাই পাখির দল, কলহ থামিয়ে চুপচাপ বসে আছে গাছের ডালে ডালে। চোখের আড়াল হওয়া বাছুরটির জন্য গাভীর যে ঘনঘন ডাক, তা-ও আর শোনা যাচ্ছে না এখন। পাখির কূজন নাই, পাখসাট নাই, শ্যামরঙা ভ্রমরের গুঞ্জন নাই, গাভীর হাম্বারব নাই… সব স্থির, শান্ত, সমাহিত…। এমন সময় হঠাৎ সমস্ত নীরবতা ভেঙে বেজে উঠল ভাটির দিকে বয়ে যাওয়া এক মহাজনি নৌকা…“আমার কাঙ্খের কলসি/ গিয়াছে ভাসি/ মাঝি রে তোর নৌকার ঢেউ লাগিয়া রে/ মাঝি রে তোর নৌকার ঢেউ লাগিয়া//… ধীরে ধীরে মাঝি যদি সাগর দিতা পাড়ি/ তবে কি কলসিখানা ভাসিত আমারই?//” চরাচরজোড়া নিস্তব্ধতা ভেঙে বেজে ওঠা এই গান তার তীক্ষ্ণ সুরসহ তিরের মতো এসে বিঁধল নদীর পাড়ে একা-একা ঘুরতে-থাকা গানপাগলা, বংশীবাদক তপন মল্লিকের কলিজা বরাবর। সুরের প্রহারে শিউরে উঠল তপন। আস্তে আস্তে দৌড়াতে লাগল নদীর ধার ধরে, সুরের পিছে পিছে।

যান্ত্রিক গোলযোগে নাকি খেয়ালি মাঝির হঠাৎ খেয়ালে, ঠিক বোঝা গেল না, তবে গান থেমে গেল সহসা। ফের বেজে উঠল, থামল আবার। অসহ্য লাগছে তপনের। এক পর্যায়ে সে দুই হাতের তালুকে চোঙা বানিয়ে মুখের কাছে এনে ডাক পাঠাল মাঝির উদ্দেশে, “হেই মাঝি ভাই, ওই যে ওই গানটা বাজান-না ভাই একবার… কী জাদু করিলা/ পিরিতি শিখাইলা…। তপনের কথা শুনতে পেয়েছে কি পায়নি, ‘কাঙ্খের কলসি’ জলে ছেড়ে দিয়ে বেজে উঠল, “কী জাদু করিলা/ পিরিতি শিখাইলা/ থাকিতে পারি না ঘরেতে, প্রাণ সজনী/ থাকিতে পারি না ঘরেতে//”। প্রেমের লোকায়ত এই গানখানি যে-ই শুনেছে, আমার ধারণা সে-ই মজেছে… গানের কথা আর তার আধো-রাখালি আধো-ভাটিয়ালি সুরের মধ্যে রয়েছে কী যেন অচেনা এক মায়া ও আবেশ, অনেকক্ষণ জড়িয়ে ধরে রাখে ভেতরে-বাহিরে। “আমারো লাগিয়া/ নিরলে বসিয়া/ তোমারে যতনে গড়িল বিধি” কিংবা ওই যে “পড়ে গো ঢলিয়া/ঢলিয়া ঢলিয়া/ তোমারো মুখেতে পূর্ণশশী”…কথাগুলি এগুতে থাকে ধীর লয়ে, এগুতে এগুতে ওই যে “তোমারে যতনে” কিংবা “তোমারো মুখেতে” পর্যন্ত গেয়ে চূড়ায় উঠিয়ে নিয়ে যখন ছেড়ে দেয় ক্ষণিকের জন্য, এবং ফের ধরে ফেলে… তখন সুরবিরতির ওই ক্ষুদ্র ক্ষণ-অবকাশের মধ্য থেকে ঘটে রুপালি অগ্ন্যুৎপাত সুরের আকাশে… আর নদীপৃষ্ঠার ওপর দিয়ে জলীয় বাষ্প শুষে নিতে নিতে সেই সুর যখন ভাটি থেকে ভেসে আসে উদার অবারিত অববাহিকার দিকে, মর্মী মানুষ কেমন মোহিত হয়ে যায় তখন, ভুতগৃহীতের মতো হাঁটতে থাকে সুরের পিছে পিছে, রসজ্ঞ ভিজে যায় রসে, উদাসী মানুষ হয়ে ওঠে আরো উদাসীন। সুরপাগলা তপনেরও আজ হয়েছে তা-ই। ভাটির দিকে বয়ে যেতে যেতে আস্তে আস্তে কখন মিলিয়ে গেছে সুর, কিন্তু বেজেই চলেছে রেশমি রেশটুকু তার। ওই উদাস আনন্দময় সুর আজ সারাটাদিন ঘুরিয়ে মেরছে তপনকে, বটের মূলে, নদীর কূলে কূলে…

সন্ধ্যার পর ওই সুর গানপাগলা বংশীবাদকের অন্তর্গত সাতমহলার নানা অলিগলি ঘুরে, বর্ণাঢ্য সব আঙরাখা কিংখাব ছুঁয়ে ছুঁয়ে উঠে এলো অধরোষ্ঠে। নদীর ধারে, বর্ষীয়ান সেই অশথ গাছের নিচে, পা মেলে বসে আঁড়বাশিতে সুর তুলল রসিক বাঁশরিয়া… “কী জাদু করিলা… পিরিতি শিখাইলা… থাকিতে পারি না ঘরেতে…।” আহ! বাঁশির সুর। সকল বাদ্যযন্ত্রের মধ্যে এই বাঁশিই হচ্ছে সবচেয়ে অর্গানিক! অনেকক্ষণ ধরে ধীর লয়ে, প্লুত স্বরে বেজে চলল বাঁশি। অদ্ভুত বিরহমধুর সুর। তারপর কিছুক্ষণ বিরতি। বাঁশি আর বাজছে না দেখে অদূরে আলো-অন্ধকারে ধনচে-শোলার বেড়ার আড়াল থেকে কাবিল কারিগরের তিরিশ-পেরুনো বউ আম্বিয়া উনুনে রান্না তুলে দিয়ে কিছুটা আহত গলায় বলে উঠল, “ও মল্লিকের ব্যাটা, বাঁশি থামায়ে দিলেন যে! তোলেন-না ফের ওই গানটা, শুনি।” বাঁশরিয়া আবার হাতে তুলে নিলো বাঁশি। একাগ্রচিত্তে, প্রাণমন উজাড় করে দিয়ে সুর তুলল উথালপাথাল। ফিনকি দিয়ে দিয়ে ছুটছে সুরের স্ফুলিঙ্গ, ছড়িয়ে যাচ্ছে আগুন সমগ্র চরাচরে… গাছে গাছে, শস্যে শস্যে, ছনের ছাউনিতে আর ধনচে-শোলার বেড়ায় বেড়ায়। এখন আর কোনো শব্দ নাই, সুরের সূক্ষ্ম স্বনন ছাড়া। সব শব্দ গিয়ে মিশে গেছে যেন এক নিঝুম নৈঃশব্দ্যে। এইবার যা ইচ্ছা তা-ই হোক ওই দূরে, দূরে দূরে,… যত মারণকলের কলরব, পরাক্রমীদের দূরাগত তর্জনগর্জন, সার্কাসের লোম-ওঠা বৃদ্ধ সিংহের গোঙানি, সঙ আর জোকারদের নিভৃত নৈশকান্না… এইবার দুনিয়ার যত আঙুর ও কামরাঙা, ভরে উঠুক সব হর্ষবিষাদ রসে, চণ্ডাল ভুলে যাক চিতা-সাজানোর মুনশিয়ানা, আক্ষেপ জেগে উঠুক শশ্মানপতির, উদ্ভ্রান্ত হয়ে যাক নবীন মৌমাছির ঝাঁক বানডাকা সর্ষেফুলের রূপে, গোরস্তানের পেশাদার রোদনকারী ভুলে যাক রোদন হঠাৎ; দুষ্ট শিশু ধরা খাক মায়ের কাছে, খেয়ে বলতে থাকুক সোনালি-রুপালি মিথ্যা অনর্গল; বাবুই ভুলে যাক বয়নসূত্র আর দাঁড়কাকের ডানায় ভর করে নেমে আসুক আলকাতরার মতো অন্ধকার… আর… ঢেকে দিয়ে যাক স-ব… তারপরও হতে থাকুক… আরো যা যা হয়…

বাঁশি থেমে গেছে। অনেক রাত করে গঞ্জ থেকে বাড়ি ফিরেছে কাবিল কারিগর। খেতে বসেছে। একে তো ঠাণ্ডা ভাত, তার ওপর তরকারিতে নাই লবণ। আলুনি সালুন খেয়ে রাগ চড়েছে কাবিলের। ভাত ফেলে উঠে গিয়ে বকাঝকা করেছে আম্বিয়াকে, দুচারটা ঠোনাও মেরেছে হয়তো। রাতের দ্বিতীয় যামে অস্পষ্ট সুর তুলে কাঁদছে আম্বিয়া। কালা-র প্রাণ-উতলা আনন্দমেদুর সুরের পর, হায়, রাধাকেও তুলতে হয় বিষাদবিধুর ধুন-  এটাই সংসারের বিধি। পিরিতিসুরের সর্বনাশা বিস্তারের পরপরই দহনসুরের ঝালা। রাধিকার নেপথ্যে হয়তো তখন বেজে চলেছে-  “উনানে রান্না তুলে/নুন দিতে যাই যে ভুলে/কালা, তোর কারণে নষ্ট হতে আর কী বাকি?// কালা, তোরই পানে আড়নয়নে চেয়ে থাকি//”
(চলবে…)

Facebook Comments

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top