পারস্য উপসাগরের তীরবর্তী বৃক্ষশোভিত স্বপ্নের শহর আল খোবারে এই অগাস্টেও দেশের শারদীয় বায়ুমণ্ডলের স্পর্শ কী করে মেলে তা বুঝে ওঠার বদলে অনেকটাই ফুরফুরে বোধ করে মনজুর। সেই সাথে, নাম জানার যেখানে প্রশ্নই আসে না, বরং নম্বরই শনাক্তকরণে বেশি সহায়ক হতো বলে তার বরাবরের ধারণা, সেখানে, কীভাবে দিলশাদের নাম জেনে ফেলে এবং দেশীয় নারীটির সঙ্গে ক্রমশ অন্তরঙ্গ আলাপেই মেতে ওঠে সে-ভাবতেই পারে না। এ অবস্থায়, আলাপচারিতার এক বাঁকে, হঠাৎ দিলশাদের প্রশ্ন : ‘আপনি কি ঘরে ঢুকেই নাম জানতে চান, মানে, এই লাইনের অন্য মেয়েদেরও?’
মনজুর স্মরণ করিয়ে দেয় যে, সে দিলশাদকে দেখেই কয়েক মিনিট থমকে থাকে। আর, বলে : ‘অন্যদের নামের প্রয়োজন হয় না, কাজ সেরেই বেরিয়ে যাই। অনেকের মধ্য থেকে বেছে নিতে হয় বলে বুকে বা পিঠে নম্বর থাকলেই ভালো হতো মনে হয়।
দিলশাদের কৌতূহল : ‘টানবাজার, দৌলতদিয়ায় যেতেন বুঝি?’
মনজুর নিঃসঙ্কোচ : ‘শুধু টানবাজারে যাওয়া হয় একবার, বাকি সব তো বাসাবাড়িতে।’
‘এই বাসায় আমি একজন বলেই কি আমার নাম জানতে চান? তাছাড়া প্রথমেই চমকে ওঠেন কেন?’
দিলশাদের জিজ্ঞাসায় সম্ভবত এই প্রথমবার নিজের ভেতরে ভিন্নতা টের পায় মনজুর : ‘অবাক হই আপনি সিনিয়র বলে।’
দিলশাদ বিগলিত হয় না এতে : ‘দেশে, এই বিদেশেও, বয়স্ক নারী কি ব্যবহার করেননি?’
: কিন্তু আপনার দৃষ্টি অন্যরকম, আচরণও বাজারে নয়। একাত্তরে ক্লাশ এইটে পড়তেন বলে আর তো এগুলেন না।
নাছোড় মনজুরের আজকের নিষ্কামতায় দিলশাদও নির্ভরতা পায়: ‘এখনো কানে বাজে বাবার সেই ধমক। ছাব্বিশে মার্চের দুপুরে, পাশের পাড়ার পুকুর-পাড় থেকে, কাছাকাছি বয়সের সেজ ফুফুকে দিয়ে আমাকে ডেকে আনিয়ে বাবার সেই কী যে বকা! ছোটবেলার দুরন্ত স্বভাব তখনো অনেকটা অটুট বিধায় বিভিন্ন বয়সের চাচাত-জেঠাত বোনদের সাথে পিকনিক-পিকনিক খেলতে যাই সেই পুকুর-পাড়ের ঝোপঝাড়ে। বাবার ওই সতর্কতায় প্রথম আঁতকে উঠি। টের পাই যে মাতৃভূমি আর পুকুর-গড়-খাল-বিল-ঝিল-নদীর নিরাপদ কূলকিনার নয়।
হঠাৎ দরোজায় টোকা দিয়েই একাত্তরের স্মৃতিচারণে যতি টানে নওশাদ : ‘কিরে মনজুর, হোল নাইট থাকবি নাকি?’
: ‘মনে হয় তাই। তুই চলে যেতে পারিস।’ বলেই চাচাত ভাইয়ের খালাত ভাইকে আপাতত বিদায় জানায় মনজুর।
ততক্ষণে দিলশাদ স্মৃতি বেয়ে আরো বহু দূর হেঁটে যায়। ওই অতিক্রান্ত দূরত্বে ফিরে না গিয়ে বলে : ‘কুষ্ঠরোগী ইউসুফ চাচাসহ বাবা-জেঠাদের স্বাধীন বাংলা বেতার শোনা, শত বছরের পুরনো মাটির ঘরের লাগোয়া শনের চালার রান্নাঘরটির ঠিক পেছনে কাগজের প্যাকেটে আমাদের প্রাতঃকৃত্য, আমাদের ভাইবোনের সঞ্চয়ে ভরপুর মাটির ব্যাংক দুটি মা-বাবার ভাঙা, সন্ধ্যা থেকেই হারিকেনের চারদিকে কাগজ মোড়ানো, বোমারু বিমান কিংবা গোলাগুলির আওয়াজ শুনলেই আট বছরের ভাইটিকে নিয়ে মা-বাবার সাথে খাটের নিচে গুটিশুটি ইত্যাদি বাল্যশিক্ষার মতো, আমার বর্ণমালার মতো মনে থাকে প্রত্যেক মুহূর্তে, লুকিয়ে থাকে প্রত্যেকটি ক্ষণের গভীরে। ভুলে যাবার কোনো কারণ ঘটে না।’
: তারপর? তারপর??
মনজুরের রীতিমতো উৎকণ্ঠায় নির্বিকার দিলশাদ এলানো স্বরেই বলে : ‘তার আর পর নেই নেই কোনো ঠিকানা গানটা শুনেছেন? নিজের মুরুব্বি পুরুষদের কাপড় খুলে মুসলমান কিনা কাউকে পরীক্ষা করতে দেখেছেন? আমি দেখেছি।’
শেষ বাক্যটির আকস্মিক ঋজুতা ও দৃঢ়তায় স্মিত এলানো দিলশাদ মনজুরকে বুঝি লজ্জিতই করে। যুবকের কিছুক্ষণের নীরবতার পর নারী আবার সরব হয় : ‘দাদি ওজিফা নিয়ে আর আম্মাকে কোরান ধরিয়ে দিয়ে বিছানায় ঘোমটা টেনে বসে পড়েন। আমি ওসবের কী বুঝি! তখন সবে আমার ঋতুস্রাব শুরু হয়। উঠোনে বাবা-কাকারা প্রায় সবাই লাইন করে যার যার লুঙ্গি মেলে ধরে দাঁড়ানো। জেঠা লজ্জাস্থান দেখাতে না চাওয়ায় তাঁর পিঠে যেই বন্দুকের প্রচণ্ড আঘাত এবং তাঁরই মর্মবিদারী আর্তনাদ, ঠিক সেই মুহূর্তেই দেশীয় এক শত্রুসেনার, যাকে আপনারা আজ রাজাকার বলেন আর কি, তার হাত হয়ে ওঠে আমার হাতকড়া। হাতকড়াই তো। হাজার চেষ্টায়ও নিজেকে ছাড়াতে পারি কই! আর কিছু মনে নেই। প্লিজ আর কিছু জানতে চাইবেন না।
অনুরোধ শেষে দিলশাদ বেডরুম থেকে বেরিয়ে কিচেনে ঢুকে মনজুরের জন্যে চা-নাশতা তৈরিতে ব্যস্ত হতেই তার প্রৌঢ় স্বামী আকমল লিভিং রুম থেকে এসে মনজুরের কানে ফিসফিসিয়ে বলে : ‘হেরে আমি দেশ থিকা বিয়া কইরাই আনছি। কিন্তু পাকিস্তানিরা নষ্ট করনে হের মাগি-স্বভাব যায় নাই। তাই আপনেগো মতো খদ্দের পাইলে কামে লাগাইয়া দেই। এহানকার চাকরির পয়সায় দেশে কিছু করন যাইব না। আমার লগে থাইকা টুপাইস এক্সট্রা কামাইয়া দিলে হেরও গতি অইব। আজকে আপনে আমার হোল নাইটের মেহমান। এই হিসাব পরে অইব। আপনে ডিনার কী খাইবেন কন। খেপসা নাকি পাকিস্তানি বিরানি আনুম? এলাচি-দারচিনি বেশি থাকলেও পাকিস্তানি বিরানিটা খুব ভালা অয়। তিতা পানির অভ্যাস থাকলেও কইতে পারেন।’
আরব জনসমাজে মদ্য নিষিদ্ধ হলেও, দেহবাণিজ্যের পাশাপাশি, মদ তৈরির কাজ ও এর ব্যবহারও যে এখানে চলে গোপনে, শুরুতে দিলশাদের জানা ছিল না। বিয়ের পরে এ দেশে এনে তার স্বামী যে হত্যার হুমকি দিয়ে ঘরে রেখেই তাকে বিক্রি করবে, জানার উপায় থাকেনি তাও। তার বাবার এক মামাতো বোনের সতীন নিঃসন্তান হওয়ায় ওই ফুফুর বাড়ি থেকেই পঁয়ত্রিশ বছর বয়সে বিয়ে হয় দিলশাদের। ওই আশ্রয়দাত্রীই বাহাত্তরের ফেব্রুয়ারিতে তার গর্ভপাত ঘটান। এর আগে বাহাত্তর সালের জানুয়ারি পর্যন্ত তার পিতা-মাতা এক ভয়ংকর লজ্জাবশত তাকে গৃহবন্দি রাখেন।
: ‘জানেন? দেশ যে স্বাধীন হয় তা আমি জানতে পারি পরে। পাকসেনাদের কবলে থাকার সময় আমি মাঝে মাঝে জ্ঞান হারাতাম, তবে কতক্ষণের জন্যে, বলতে পারি না। একদিন সন্ধ্যার খানিক আগে জ্ঞান ফিরে এলে দেখি, আমার সাথীদের অনেকেই নেই। একজন হয়তো আমি অজ্ঞান থাকার সময়েই মারা যায়। তাকে ঘিরে শুধু দুজন, ঠিক কাঁদছে না, গোঙাচ্ছে, কান্নার শক্তি নেই বলে। হামাগুড়ি দিয়ে কাছে গেলে লতিফা আন্টির লাশের ওপর আমি ঢলে পড়ি। ওই দুজন, বান্ধবী বৃষ্টি আর ছোট বোন বিউটি, আমাকে টেনে-হিঁচড়ে কোথায় সরিয়ে আনে, আর মনে আসে না কিছুতেই। শুধু মনে আছে, আমি খালের কোমর পানি ভাঙছি, কাত হয়ে পড়ে ডুবে যাচ্ছি প্রায়। ডাঙায় হাঁটছি, হাঁটু ভেঙে পড়ছে। কিছুক্ষণ হামাগুড়ি আর কিছুদূর বুকে হাঁটা সেরে সেরে অনন্ত পর্যন্ত চলেছি বাড়ির দিকে।’
মনজুরের আর্দ্র কৌতূহল : ‘লতিফাকে কি হত্যা করে ওরা?’
: ‘না। ওর জরায়ু বেরিয়ে যায় মৃত্যুর মাসখানেক আগে। ভোগ করতে না পেরে ওই সেনারা ঘুষি আর পদাঘাতে প্রতিদিনই ওকে মিশমার করে। আমি এখনো আন্টির গলিত লাশেরও গন্ধ পাই। আপনি কি এমন কিছু পান?’
দিলশাদের প্রশ্নে বিব্রত মনজুর কয়েক মিনিট হিমায়িত থেকে জানতে চায় : ‘আপনাদের আবাসন কেমন ছিল?’
: ‘সে তো অনেক। পরিখা, তাঁবু, বাগান, বারান্দা, বিছানা, টেবিল, ঘরের মেঝে, আরো কতখানে!’
এভাবে কথা বলছেন কেন দিলশাদ?-মনজুর নিজেই প্রশ্নবিদ্ধ : তিনি কি সমস্ত পুরুষকেই পরিহাস করছেন? বিবরণ-প্রত্যাশী সে সংক্ষেপণপ্রয়াসী দিলশাদকে সক্রিয় রাখতে চায় কথোপকথনে : ‘পরিখায় কীভাবে যান?’
দিলশাদের কণ্ঠের স্বাভাবিকতায় পরিবর্তন আসে : ‘পাকিস্তানি দুই তরুণ সেনা দু দিক থেকে লোহার হাতে আমার দুই বাহু চেপে, সেই প্রথম দিনই, ওদের ক্যাম্পের পেছনে খোঁড়া দীর্ঘ একটি পরিখার একেবারে কিনারে নিয়ে যায়। কয়েক মুহূর্ত দাঁড় করিয়ে রেখে দুই সেনাই হঠাৎ একত্রে ধাক্কা দিলে আমি উপুড় হয়ে পরিখায় গিয়ে পড়ি কোনো খালার কোল, সখীর হাঁটু এবং বোনের পেট বা পিঠের ওপর। পূর্ব-অপরিচিত তারা পরবর্তী ছয় মাসে আমার এরকম আপনই হয়ে ওঠে। কিন্তু সেই পরিখা ছিল আমার প্রথম কবর। আপনি কি কোনোদিন কবরে বাস করেছেন?
মনজুর এবার সত্যিই বরফ হয়ে ওঠে। ভাবে : স্নাতকোত্তর আমি তো আর নিয়মিত গণিকাগামী নই।-নওশাদকে বরং বলা যায় নৈমিত্তিক বনিতাবিলাসী।-আমি তো নই।-তাছাড়া দিলশাদও তো স্নাতক,-সেই নিঃসন্তান দম্পতির ইচ্ছায় ও সহায়তায় তিনি লেখাপড়া সেরে দেশে একটা কিন্ডারগার্টেনে চাকরি করেন বলেও তো শুরুতেই ইঙ্গিত দেন।-আমি তো তাঁকে বুঝতে চাইছি বলেই বিনা কামে তাঁর স্বামীকে টাকা পরিশোধের মৌখিক প্রতিশ্রুতিতে এভাবে রয়ে যাই।-তবু আমাকে বারবার অপ্রস্তুত এবং শঙ্কিত করছেন কেন তিনি?-এ কী তাঁর ওই দেহবাণিজ্যের প্রতিভাস?
এই দফায় মনজুরের নীরবতায় দিলশাদের যেন টনক নড়ে : ‘আপনার কোনো রোমহর্ষক অভিজ্ঞতার কথা তো বললেন না!’
এ কথায় মনজুরের কিঞ্চিৎ রসিকতা বুঝিবা বাঁকা হয়ে ওঠে : ‘এই যে কাম করতে এসে আপনার অভিজ্ঞতা শুনে শুনে আমার মাথার চুলও সটান দাঁড়িয়ে যাচ্ছে! আমি সাংবাদিক, লেখক বা চলচ্চিত্রকার হলে আপনাকে কীভাবে যে জাতির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতাম!’
দিলশাদের এতে উচ্ছ্বাস হয় না। নিজের বয়সের চেয়ে দ্বিগুণ জ্যেষ্ঠের ধরনে বলে : ‘আমাকে নিয়ে বই লিখে বা ফিল্ম করে আপনি বড় বড় পুরস্কার পেতেন, কিন্তু আমার জীবন কারো সাথেই বদল হতো না। বলুন, তবু আপনার অন্তত একটা ঘটনা জানান।’
মনজুরের এবার শুধু মনে পড়ে না, জলজ্যান্ত স্মৃতি পুরো বর্তমানকে অধিকার করে: ‘আমার বয়স তখন এগারো-বারো। দেশ স্বাধীন হবার পরে, এক অপরাহ্নে, আমাদের বাড়ির কাছের পাহাড়ে, রামুর পাহাড়ে, যাই, এক আদিবাসী বড় ভাই মঙদার সাথে। তাঁর ডান হাতে রাম দা। মাথার চারদিকে গোল করে গামছা বাঁধা। খালি গা, লুঙ্গি গুটিয়ে পরা। এক বিরাট গাছের গায়ের বড় গর্তে পাখির ডিমের আশায় তিনি বাম হাত দিতেই,-আমি বলতে পারবো না, আমার বর্ণনার ভাষা নেই,-সাপের ছোবল খাওয়ামাত্র,-৩০ সেকেন্ডও হবে না,-এক নিমেষেরও কম সময়ের মধ্যে,-ভালো করে কিছু বুঝে ওঠার আগেই,-হাতটা বের করেই অপর হাতের দায়ের প্রচণ্ড এক কোপে নিজের কব্জি কেটে ফেলেন। ওই কাটা হাত আমাকে ধরিয়ে দিয়ে তিনি কীভাবে যে পাহাড় থেকে নামেন তা বলে বোঝানো অসম্ভব। ডাক্তার দেখাবার পরে আমাকে সঙ্গী করে কূলে দাঁড়িয়ে নিজের কাটা হাতখানা সেই ডান হাতে সজোরে ছুঁড়ে মারেন মাতামুহুরী নদীতে। গেলবার, তিন বছর আগে, দেশে ছুটিতে গেলে মঙদার সঙ্গে দেখা হয় রামু বাজারে। কাঁধে নাতিকে বসিয়ে চায়ের দোকানে ঢুকছেন। আমাকে দেখেই সেই বাম হাতেই বুকে টেনে নেন।
‘এরকম তো আগে শুনিনি!’ বলে দিলশাদ বিস্ময় প্রকাশ করলেও আর্দ্র নিশ্চয়তায় বলে : ‘সেই একাত্তর থেকে আজ অব্দি কত সাপ বিষ ছড়ায় আমার জঠরে! মঙদার মতো আমি তো দংশিত অঙ্গ ছিন্ন করতে পারলাম না!
আজ অব্দি কেন? মনজুরের এই প্রশ্নে কিছু বলতে অনিচ্ছুক দিলশাদ শুধু বলে : ‘আবারো একই প্রশ্ন? আপনি রামু থেকে আরবে। আমি চট্টগ্রামের হাটহাজারী থেকে ঢাকায়, তারপর ঢাকা থেকে এই তো, আপনার সামনে।’
: আপনার ওই ত্রাণকর্তা দম্পতি কি ঢাকার?
: না, ঢাকায় থাকেন। আমি কখনো বিয়েই করতে চাইনি। ‘মধ্যপ্রাচ্যে চাকরি করে, ভালো মানুষ, সব জেনে তোকে বিয়ে করতে যে রাজি হয়েছে, এটাই তো বেশি!’-তাঁদের এমন আশ্বাসে এই বিদেশে আকমলের এমন ফাঁদে পড়ি যার গভীরতা সেই পরিখার চেয়ে কম নয়।
: আকমলকে এখনো কেন মেনে নেন?
: আমার পাসপোর্ট তার জিম্মায়। এখানে পুলিশ ডাকলে, আকমলের সাথে খদ্দের শুধু নয়, আমিও আটক হবো। তাছাড়া আকমল নিজেকে উল্টো করে আমাকেই চরিত্রহীনতার অভিযোগে ফাঁসাতে পারে। এ দেশের সামাজিক কিংবা আইনি ব্যবস্থার সাথে তো আপনি অপরিচিত নন। এ মুহূর্তে আপনার হাত ধরে বেরিয়ে যেতে চাইলেও কি পারব? এ দেশে অবিবাহিত নারী-পুরুষের একসঙ্গে হাঁটা দূরে থাক, প্রকাশ্যে কথা বলাও তো অপরাধ। আকমলকে মেনে বা মনে নিইনি। ওর অসহ কর্মকাণ্ডে আত্মহত্যার পথ ধরে শেষে ওকেই বিখ্যাত করে তুলতে নিজের ভেতর থেকে সাড়া পাই না। সংবাদ শিরোনাম হয়ে উঠলে সবাই পুরুষকে মনে রাখে। নারীর খ্যাতি তো কচুপাতার পানি।
দিলশাদের ওই উত্তরে মনজুর নিজের ভেতরে পরিবর্তন অনুভব করে। আলাপের বিষয়ান্তরেও সময় গড়ায় ছোটবেলার মার্বেলের মতো। রাতও গড়াতে গড়াতে সূর্যোদয়ে এসে ঠেকে। চোখে জ্বালা মনজুরের। তারপরও কি সব কথা শোনা হয় দিলশাদের? অপূর্ণতার তৃপ্তিতে হু হু করে ওঠে তার বুক। বেরুবার আগ মুহূর্তে দুই হাজার রিয়াল এগিয়ে ধরে তাকে বিস্ময়ে থামিয়ে দেয় দিলশাদ আর টাকাটা আকমলকে পরিশোধের অনুরোধ জানায় এই বলে : সে আমাকে চার্জের ওয়ান থার্ড দেয়,-সেগুলোর সঞ্চয় থেকে এটা আপনাকে দিচ্ছি,-আকমল তো আর বুঝবে না, সারা রাত আমার সাথে আপনার কথা বলার চার্জও নিয়ে নেবে। রিয়ালগুলো দিলশাদ হঠাৎ তার বুক পকেটে পুরে দিলে টাকা নিতে মনজুরের তুমুল অনিচ্ছা ব্যর্থ হয়।
সাত সকালে হেঁটেই কখন যে মনজুর উপসাগর-তীরবর্তী রাস্তায় চলে আসে, টেরই পায় না। অদূরে আল খোবার-বাহরাইন ব্রিজ ম্রিয়মাণ, সন্ধ্যা থেকে সারা রাত যা স্বপ্নের সোনায় জ্বলজ্বল করে। টাকা দিয়ে দিলশাদ এ কী করলেন!-এই একটিমাত্র স্বগত জিজ্ঞাসার লক্ষ লক্ষ বিভিন্ন যোগসূত্রবাহী ধাক্কায় নিজের যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড প্রাপ্য বলে বোধ হয় মনজুরের। হাতের বামে রাস্তার ওপারে ওই ব্রিজ রেখে ঘন নিমগ্নতায় সামনে এগুতেই চকিত স্মৃতিচারণায় সে কেঁপে ওঠে : মঙদার সেই ছিন্ন হাতের কথা দিলশাদকে বলা হয়নি!-মঙদার পাশের গ্রামের কিনারে, জলে নিক্ষেপের আট দিন পরে, মাতামুহুরীর ধারে আবিষ্কৃত হয় আংশিক মনুষ্যকঙ্কাল,-স্রোতে ভেসেও আকব্জিআঙুল এক টুকরো মানুষ যেন আঁকড়ে আছে পৃথিবীর কূল।
আকব্জিআঙুল নদীকূল (বইমেলা, ফেব্রুয়ারি ২০১২; প্রকাশক-প্রকৃতি) বইয়ে গ্রন্থিত।
প্রথম প্রকাশ-নতুন দিগন্ত
জানুয়ারি-মার্চ ২০০৮
খালেদ হামিদী
জন্ম: ২৪ জানুয়ারি ১৯৬৩। জন্মস্থান: বাদামতলী, আগ্রাবাদ, চট্টগ্রাম। শিক্ষা: ব্যবস্থাপনায় স্নাতক (সম্মান): ১৯৮৫; স্নাতকোত্তর: ১৯৮৬; চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। পেশা: প্রকাশনা বিভাগের প্রধান, চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ।
প্রকাশিত গ্রন্থ:
কাব্য (০৭টি): আমি অন্তঃসত্ত্বা হবো (ডিসেম্বর ১৯৯৯; একান্তর); হে সোনার এশীয় (ফেব্রুয়ারি ২০০৪; অনন্তর); মুখপরম্পরা (ফেব্রুয়ারি ২০০৭; লিটল ম্যাগাজিন); ধান থেকে শিশু হয় (ফেব্রুয়ারি ২০১০; বাঙলায়ন); স্লামমডগ, মিলিয়নার নই (ফেব্রুয়ারি২০১৩; প্রকৃতি); তুমি কি রোহিঙ্গা মাছি (ফেব্রুয়ারি ২০১৮; খড়িমাটি) এবং
ঘুমোই চশমা চোখে (জানুয়ারি ২০১৯; ঋতবাক; কলকাতা; ভারত)।
গল্প (০১টি): আকব্জিআঙুল নদীকূল (ফেব্রুয়ারি ২০১২; প্রকৃতি)
উপন্যাস (০১টি): সব্যসাচী (ফেব্রুয়ারি ২০১৭; বেহুলাবাংলা)
প্রবন্ধ (০৩টি): কবির সন্ধানে কবিতার খোঁজে (ফেব্রুয়ারি ২০০৭; অনন্তর); না কবিতা, হাঁ কবিতা (ফেব্রুয়ারি২০১৬; খড়িমাটি এবং চেনা কবিতার ভিন্ন পাঠ (ফেব্রুয়ারি ২০১৯; খড়িমাটি)।
অনুবাদ (০১টি): ওঅল্ট হুইটম্যানের কবিতা (ফেব্রুয়ারি ২০১৬; খড়িমাটি)
পুরস্কার: চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন মহান একুশে স্মারক সম্মাননা পদক ২০১৯ ও শালুক বিশেষ সম্মাননা পদক ২০১৯।
দিলশাদের ওই উত্তরে মনজুর নিজের ভেতরে পরিবর্তন অনুভব করে। আলাপের বিষয়ান্তরেও সময় গড়ায় ছোটবেলার মার্বেলের মতো
mojar mojar !!