সেই সকাল থেকে শুরু হয়েছে ঝড়ো হাওয়া, ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি। চারদিকে কেবল একটানা শোঁ শোঁ আওয়াজ। ঘরের চাল লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে। হাজেরার ক্লান্ত দেহটা আর নড়তে চাইছে না। হ্যারিকেনের সলতেটা সামান্য একটু উসকে দিয়ে বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে পড়লো সে। রাত যত গভীরতর হচ্ছে, ততই দুর্যোগের ঘনঘটা প্রবল আকার ধারণ করছে। হাজেরার কাঁদতে ইচ্ছে হলো। সকালে সেই যে একবার কেঁদে ছিলো, আর কাঁদতে পারেনি। শরীর ব্যথায় টন টন করছে। অথচ ঘুমুতে পারছে না। চোখ দুটো ঘুমের জন্যে জ্বালা করছে। ঘুমুলে আবার এলাহি কাণ্ড বেঁধে যাবে। নবিছদ্দির লোহার মত শক্ত হাতের চড় এসে পড়বে নাকে, মুখে, শরীরে। সকালে একচোট হয়ে গেছে। রাতে আবারও হবে।
বাঁশের আড়ার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকালো হাজেরা। ওখানে একদিন দড়ি ঝুলিয়েছিলো। কিন্তু কি যেন মনে করে খুলে নিয়েছিলো সে দড়িটা। সে তো বেশি দিনকার কথা নয়— মাস কয়েক আগেকার কথা। ঠিক সেই সময় নবিছদ্দি এসে দরোজায় হাঁকতে শুরু করে দিয়েছিলো, এই, এই মাগী, দরোজা খোল।
দরোজায় এক নাগাড়ে লাথি পড়েছিলো অনেকক্ষণ। দরোজা খুলে দিতেই হুড়মুড় করে ভিতরে ঢুকে পড়েছিলো নবিছদ্দি। ওর দিকে একবার ভালো করে তাকিয়ে হো হো করে হেসে সে বলেছিলো, কিরে, তোর যে গতর শুকিয়ে যাচ্ছে? ব্যাপার কি?
মেজাজ সেদিন খুশ ছিলো নবিছদ্দির। ওর গলা জড়িয়ে ধরে বেহেড মাতালের মতো বিছানায় লুটিয়ে পড়েছিলো। কিছুক্ষণ ধ্বস্তাধ্বস্তি করে মুখ ভেংচে বলেছিলো, নাহ্, তোর দেহে আর কোন সত্ব নেই। একেবারে ঝুনো নারকেলের মত হয়ে গেছিস। দূর দূর, একেবারে অখাদ্য।
কথাটা মিথ্যা নয়। সত্যি সত্যি এখন সে অখাদ্য হয়ে গেছে। অথচ একদিন ওরই জন্যে পাগল ছিলো নবিছদ্দি। ক’দিনকার কথা সেসব? একপাল শীর্ণ গরু ঠেঙাতে ঠেঙাতে নবিছদ্দি যখন আবোল তাবোল বোল ছুঁড়তে ছুঁড়তে কসাইখানায় দিকে হেঁটে যেতো, তখন ভরা যৌবন নিয়ে ঘরের বেড়ার ধারে দাঁড়িয়ে অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে থাকতো হাজেরা। ওকে দেখতে পেলেই খিস্তি আরো জোরালো হয়ে উঠতো নবিছদ্দির। মুখে চুমকো দিতে দিতে গরু খেদিয়ে যতক্ষণ না সে আবডালে চলে যেতো, ততক্ষণ তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতো হাজেরা।
নবিছদ্দিরও বেশ ভালো লাগতো এই পরিবেশ। এই ভালো লাগাটাই শেষ পর্যন্ত নেশা হয়ে দাঁড়িয়েছিলো নবিছদ্দির কাছে। সপ্তাহে দুদিন সে যেতো গাড়াগঞ্জের গো হাটে। গরু কিনে সারারাত রাস্তায় রাস্তায় কেটে যেতো। সারারাত মনে পড়তো হাজেরার কথা। হাজেরার সুরত দেখার জন্যে হন্যে হয়ে উঠতো সে। শেষ রাতে বাড়িতে এসে বালিশ বুকে চেপে ধরে হাজেরার শরীরের গন্ধ সে শুঁকতো চোখ বুঁজে। অথচ তখনো ঘরে তার একটা জ্বলজ্যান্ত বউ ছিলো। দিব্য এক স্বাস্থ্যবতী বউ। থলথলে মেদবহুল চেহারা। দোষের মধ্যে একটু কালো।
ভোর বেলা উঠেই ভুজালিটা বের করে বাড়িতে ধার কাটতো নবিছদ্দি। তারপর একটা গরু টেনে-হিঁচড়ে বের করে নিয়ে যেতো কসাইখানায়। দু’তিন জন ধরাধরি করে গরুটাকে চিৎ করে ফেলে দিতো মাটিতে। নবিছদ্দি ভুজালিটা হাতের মধ্যে শক্ত করে ধরে গলায় পোচ মারতো কষে। গরুটার ধড় থেকে আলাদা হয়ে যেতো মুণ্ডুটা। গলগল করে রক্ত ছুটতো তেজে। কয়েকটা নেড়ি কুকুর অদুরে দাঁড়িয়ে থাকতো হিংস্র চোখে। লোকগুলো গরুর কাছ থেকে সরে যেতেই রক্তের উপর ঝাঁপিয়ে পড়তো কুকুরগুলো। তাই দেখে হা হা করে হেসে উঠতো নবিছদ্দি। তারপর সেখান থেকে সটকে গিয়ে ঢুকতো একটা গলির মধ্যে। সেখান থেকে দু’এক ছিলিম দম্বল মেরেই এক ছুটে চলে আসতো গরুটার কাছে। গরুর চামড়া ছিলতে ছিলতে চোখ দুটো লালচে হয়ে উঠতো নবিছদ্দির। সে এক মজার দিনকাল ছিলো ওর। বাজারে তখন নবিছদ্দিরই গরুর গোস্তের একচেটিয়া কারবার। আর কোন দোকান ছিলো না। ঘন্টা দুয়েকের মধ্যেই মাংসের কাটতি হয়ে যেতো। গাঁটে কাঁচা পয়সা করতো ঝনঝন। নবিছদ্দির দেহমনে বয়ে যেতো রঙ-বেরঙের জেল্লা। নেশা করতো সে। মানুষের হাতে কাঁচা পয়সা এলে যা হয়। রাত দিন নেশা করতে করতে চোখ দুটো লাল জবার মত হয়ে গিয়েছিলো।
দুপুর বেলা গরু ঠেঙাতে ঠেঙাতে হাজেরাদের বাড়ির পাশ দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে মনের ফুর্তিতে হেড়ে গলায় গান ধরতো নবিছদ্দি, “মা, আমায় ঘুরাবি কত” ….
ওর হৈ হৈ গান শুনে, হাজেরার যুবতি দেহের বুকের খাঁচার মধ্যে মন নামক যে পাখিটি ছিলো, তার তখন উড়ু উড়ু অবস্থা। বেড়ার ফাঁক দিয়ে সে অপলক তাকিয়ে থাকতো নবিছদ্দির দিকে। নবিছদ্দির গান তো নয় একটা ধারালো ছুরি। হাজেরার বুকের খাঁচার পাখিটিকে সে যেন বলি দিয়ে যাচ্ছে। ঘরের মধ্যে দাঁড়িয়ে অস্থির এক যন্ত্রণায় ছটফট করতো হাজেরা।
কোনো কোনোদিন ওদের ঘরের কাছে এসে থমকে দাঁড়াতো নবিছদ্দি। ভাঙাচোরা বেড়ার ঘর। বাইরে থেকে ভেতরের আব্রু দেখা যেতো। হাজেরার কালো দুটো ডাগর চোখ নবিছদ্দির লাল চোখে এসে বিঁধে যেতো। গোঁফ দুটো মুচড়িয়ে রহস্যময় হাসি হেসে চলে যেতো নবিছদ্দি।
কিষাণগঞ্জের বাজারের তখন উঠতি অবস্থা । চারদিকে সবেমাত্র দালান কোঠা উঠছে। একটা তেঁতুল গাছের তলায় টিনের ছাপড়া তুলে গোস্তের দোকান করেছে নবিছদ্দি। কোথা থেকে জোগাড় করে এনেছিলো একটা তক্তপোষ। তার উপরে কাঠের একটি ছোট্ট গোলাকার গুঁড়ি তুলে মাংস কাটতো কাটারি দিয়ে। টিনের বাতার সঙ্গে লাগানো বাঁশের আড়ায় দড়ি ঝুলিয়ে টাঙিয়ে রাখতো গোস্তের খণ্ড খণ্ড অংশগুলো। চারদিকে থেকে দল পাকিয়ে, ভন্ ভন্ করে ছুটে আসত মাছির দল।
সেসব দিনকাল দেখতে দেখতে কোথায় বদলে গেলো। কত অকাম কুকাম সে করে বেড়িয়েছে জীবনে। ছিনতাই, রাহাজানি, কোন কিছুই বাদ যায়নি। মেয়েলোক দেখলে মন ছো ছো করতো। অন্ধকার গলির মধ্যে একাকী মেয়েলোক পেলে জাপটে ধরতো। স্টেশনে শুয়ে থাকা মানুষের বুকের উপর কতবার সে চুপিসারে উঠেছে। তার ইয়ত্তা নেই।
একদিন একাজও বন্ধ হয়ে গেল। সেই যেবার থানার বড়বাবু আচ্ছা করে ধোলাই দিয়ে চোখে দিয়েছিলো ঝাল বেটে। তবুও এ নেশা একেবারে ছাড়তে পারেনি নবিছদ্দি। একদিন কসবি পাড়ার জাঁহাবাজ এক মাগীর গলার হার চুরি করে চম্পট দিয়েছিলো সে। সোনা রুপার দোকানে গয়না বিক্রি করে কয়েকদিন বেহিসাবী আনন্দে ট্রেনে ট্রেনে কাটিয়েছিলো। সেই সময় এক হিন্দুস্থানী ওস্তাদের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিলো ওর। কলকাতার আজগুবি কাহিনী শুনিয়ে বেশ কিছু সাগরেদ বানিয়ে ছিলো কিষাণগঞ্জে। ওস্তাদ নদীর ধারে পেতে বসেছিলো এক তাড়িখানা। সেখানেই আসর গুলজার হয়ে উঠেছিলো। ইয়া দশাসই চেহারা ওস্তাদের। সাইকেলের হ্যান্ডেলের মত পুরু লম্বা গোঁফে তা দিয়ে অকাজ কুকাজ করে বেড়াতো। নবিছদ্দিরও একটা হিল্লে করে দিয়েছিলো ওস্তাদ। সেই ওকে পরামর্শ দিয়েছিলো একটা গোস্তের দোকান খুলবার জন্যে। ওস্তাদ টাকা দিতো। সেই টাকা গ্যাঁটিতে গুঁজে নবিছদ্দি চলে যেতো গাড়াগঞ্জের হাটে। সেখান থেকে গরু কিনে আনতো। লাভ হতো প্রচুর। সকাল বেলা গরু জবাই। আর রাতের বেলা তাড়িখানায় আড্ডা। সেই ওস্তাদই একদিন লাপাত্তা হয়ে গেলো। অবশেষে তার লাশ পাওয়া গিয়েছিলো নদীর দু’মাইল দূরে ধাপের তলায়। ওস্তাদের টাকাগুলো ভাগ করে নিয়েছিলো নবিছদ্দি। পয়সা হাতের মুঠোয় পেয়ে শরীর কামড়াতে লাগলো ওর। কসবী পড়ায় গিয়ে এক মাগীর সঙ্গে পিরিত করলো। কিছুদিন পর তাতেও সে সুখ খুঁজে পেলো না। সে চাইত নিজের মত একটা মেয়েমানুষ। তার হুকুমের বরদার হয়ে থাকবে। যখন যা খুশি তাই করবে, কেউ কিছু বলবে না। অবশেষে সেই ধরনের একটা মেয়েমানুষ সে জুটিয়েও নিয়েছিলো। তাতে বেশ কিছু গাঁটের পয়সা গচ্চাও দিতে হয়েছিলো ওর। বছরখানেক না কাটতেই সে মেয়েমানুষটাকে ভালো লাগলো না আর। হাজেরাকে তখন মনে ধরেছে। সুশ্রী চেহারা হাজেরার। তার জন্যে একরকম পাগলের মত হয়ে উঠেছিলো নবিছদ্দি। বাড়িতে এলে বউয়ের সঙ্গে বনিবনা হতো না। রাতদিন হাজেরার কথা চিন্তা করে করে মন তিরিক্ষি হয়ে থাকতো। সর্বক্ষণ মনে হতো হাজেরা যেন ওকে নিয়ে তামাশা করছে। কোনো কোনো দিন ঘরের কানাচে দাঁড়িয়ে আঙুল উঁচু করে কলাও দেখাতো। রাগে উত্তেজনায় চৈত্র-বৈশাখ মাসের ষাঁড়ের মত এদিকে ওদিকে ছুটে বেড়াতো নবিছদ্দি। নেশা করেও স্বস্তি পেতো না। হাজেরাকে বাগে না আনতে পেরে ঘরে এসে বউকে পিটাতো বেধড়ক। কথায় কথায় গরু জবাই করা ভুজালি বের করে আনতো।
বউ বলতো, এখন মারবেই তো— বড় বাড়ানি হয়েছে কিনা? নবিছদ্দির বুকের ভিতরে তখন ইটের পাঁজার আগুন। হিতাহিতজ্ঞান হারিয়ে ফেলতো সে। জোর এক তাড়া দিয়ে শাসন করতে চাইতো বউকে। এই চুপ করলিনে? মেলা ফ্যাচফ্যাচ করবি তো— গলা কেটে ধড় আলাদা করে দেব।
বউ জবাব দিতো, তাতো কাটবা। আমার সারা জীবনের গয়নাগাটি এখন তোমার হাতের মুঠোয়। তাই দিয়ে আরেকটা নিকে করে আনো গে—
নবিছদ্দি রাগে ঘোঁৎঘোঁৎ করতো।
চুপ হারামজাদী, ফের কথা বলবি তো কেটে নদীতে ভাসিয়ে দেব। নিকে করবো না তো_ তোর মত আকাট বেবুশ্যে নিয়ে ঘর করবো?
বেশ তাই করগে— বেশ্যে ছিলাম, তা তো সবাই জানে। তখন যে হাতে পায়ে ধরে এনেছিলে? দাও, আমায় গয়নাগাটি। এখনি চলে যাচ্ছি।
তা গেলেই তো পারিস।
জিনিস ফেরত দাও চলে যাচ্ছি। তোমার মত মিনসের ঘরে আগুন।
কি? মেয়েমানুষ হয়ে এত্তো বড় কথা? আচ্ছা, দাঁড়া তোর মজা দেখাচ্ছি।
নেকড়ের মত ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো নবিছদ্দি। চুলের মুঠো ধরে চিৎ করে ফেলে দিয়েছিলো নিচেই। তারপর বুকের উপর চেপে বসে ভুজালিটার উল্টো পিঠ ঘষেছিলো বউয়ের গলায়। তোর নিকুচি করি—
ঘরের মধ্যে হৈ-হল্লা শুনে পাড়া প্রতিবেশীরা ছুটে এসেছিলো। এসে দেখে পেল্লায় ব্যাপার। নবিছদ্দি তার বউকে খুন করছে।
পাড়া প্রতিবেশীদের হৈ চৈ শুনে সে যাত্রা রেহাই পেয়েছিলো বউটা।
নবিছদ্দি দুই চোখ লাল করে ভুজালিটা ফেলে দিয়ে, হন হন করে বীর দর্পে হেঁটে গিয়েছিলো সেখান থেকে। এসে সটান ঢুকেছিলো ভাটিখানায়। তারপর আর বাড়ি মুখো হয়নি দুদিন। তিন দিন পর রাগ মিটে গেলে বাড়িতে এসে দেখে ঘর খাঁ খাঁ করছে। খাঁচার পাখি উড়ে গেছে।
মন একটু খারাপ হয়ে গিয়েছিলো নবিছদ্দির। মেয়ে মানুষ হয়ে এমন করে পালিয়ে যাওয়া সে মেনে নিতে পারেনি।
মনে মনে বলেছিলো, চলেই যখন গেছিস, যা। একদিন তোরে খুঁজে বার করবই।
মাসখানেক সে ব্যাপার নিয়ে ধকল সামলাতেই কেটে গেলো নবিছদ্দির। সকাল বেলা গরু জবাই। দুপুরে ভাটিখানা। রাতে কসবি পাড়া। মেয়েলোক নিয়ে শোয়া অনেকদিনকার একটা অভ্যাস হয়ে গিয়েছিলো। সে অভ্যাস সে সহজেই ছাড়তে পারলো না। তারপর সে আবার যাওয়া শুরু করলো হাজেরাদের বাড়ির দিকে। বিশেষ করে দুপুর বেলা সে যেতো। গাড়াগঞ্জের হাট থেকে কিনে আনা গরুগুলো টেনে নিয়ে যেতো হেই হুই করে পথ দিয়ে।
হাজেরা ওর কথার স্বর শুনলেই বেড়ার ফাঁক দিয়ে উঁকি মারতো। দুপুর বেলা এই সময় বাবা যেতো রাজমিস্ত্রির জোগাড় দিতে। মা থাকতো রান্নাঘরে। ঘরে মন দাঁড়াতো না। ছটফট করতো। ওর চোখে চোখ পড়তেই ফিক করে হেসে দিতো। সে হাসিতে বুকের ভিতর বিদ্যুতের ঝিলিক মারতো নবিছদ্দির। নবিছদ্দি দিশেহারা হয়ে যেতো। সে কি করবে ভেবে পেতো না। আনন্দে আত্মহারা হয়ে তখন সে গরুগুলো পিটাতে শুরু করে দিতো। একদিন পথ দিয়ে যেতে হাজেরাদের বাড়ির কাছে পদ্মের পাতায় মোড়ানো এক পোটলা গোস্ত ছুঁড়ে দিলো নবিছদ্দি।
হাজেরা টুপ করে কুড়িয়ে নিলো পোটলাটা।
নিয়ে যাও। রেন্ধে খেয়ো।
হাজেরা পোটলাটা আঁচলের তলায় লুকিয়ে নিয়ে বাড়ির মধ্যে ঢুকে গেল।
মা দেখতে পেয়ে শুধালো, কিরে হাজু?
গোস্ত।
কে দিয়ে গেলো?
ওই গোস্তওয়ালা। জানো মা, ওই লোকটা খুব ভালো মানুষ। গোস্তের পোটলা পেয়ে মা খুশি হয়ে উঠলো। অনেকদিন তারা গোস্ত খায়নি। অভাবের সংসার। ভাতই জোটে না, তা, গোস্ত।
তা লোকটা কি মনে করে দিয়ে গেলো?
আমি কি করে জানবো মা?
মার লোভাতুর দুটো চোখ গোস্তের উপর তখন নিবদ্ধ।
পরদিন দুপুর বেলা আবার এলো নবিছদ্দি। হাতে গোস্তের পোটলা। বেড়ার কাছে আসতেই এদিক ওদিক চেয়ে হাজেরাকে দেখে রেখে দিলো পোটলাটা ।
মা দেখতে পেয়ে ছুটে এলো।
আজ আবার কী দিয়ে গেলো হাজু ?
গোস্ত।
নবিছদ্দির প্রতি মা কৃতার্থ হয়ে গেলো।
হাজেরার সামনেই বলে ফেলে, বেঁচে থাকো বাবা, গরীবের প্রতি তোমার এত দরদ। খোদা যেন তোমায় ভালো করে।
একদিন একশ টাকার একটি নোট বেড়ার ফাঁকের ভিতর দিয়ে হাজেরার হাতের মুঠোর মধ্যে পুরে দিলো নবিছদ্দি। হাতে হাত লেগে গেলো হাজেরার। শরীরটা মুহূর্তেই কাঁটা দিয়ে উঠলো।এই তার প্রথম পুরুষের স্পর্শ পাওয়া।
আস্তে আস্তে বললো নবিছদ্দি, তোমার কাপড় নেই, কিনে নিও।
মা দেখতে পেয়ে ছুটে এলো। কিরে হাজু?
টাকা।
দেখি, দেখি।
তা ভালোই হয়েছে রে মা। ঘরে চাল নেই। টাকার কথা যেন তোর বাপ শোনে না। তা হলে নিয়ে নেবে।
সংসারে দিনে দিনে যেভাবে অভাব-অনটন বেড়ে চলছিলো, তাতে দিনই চলছিলো না হাজেরাদের। ভয়ানক কষ্ট যাচ্ছিল। কোনোদিন না খেয়েও থাকতে হয়। হাজেরার বাপের মুখের দিকে তাকানো যায় না। শুকিয়ে বাদুড়ের মত হয়ে গেছে। পরনে শতছিন্ন কাপড়। বেচারা সেই সকাল বেলা বের হয়। আর ফিরে আসে সন্ধ্যে উৎরে গেলে। ঘরের বারান্দায় একবার ঢুলে পড়লে রাত যে কিভাবে কেটে যায়, তা সে নিজেই জানে না।
হাজেরার মার কাছে ২০০ টাকা তখন অনেক টাকা। কতদিন পেট পুরে তারা ভাত খায়নি। মা’র দেহ শুকিয়ে হাড়ের সঙ্গে লেপ্টে যাবার মত হয়েছিল। বাপের অবস্থা তারও চেয়ে কাহিল। পুষ্টিকর খাদ্যের অভাবে ঘুণ ধরা বাঁশের মত হয়েছে শরীর। তাই নিয়ে প্রত্যহ ইট বয়ে বেড়াতে হয়। বাঁশের সিঁড়ি বেয়ে ছাদে উঠতে গিয়ে হাঁফাতে হাঁফাতে প্রাণ নিঃশেষ হয়ে যায়। বাপের অবস্থা দেখে হাজেরার কান্না আসতো।
হাজেরার বাপ ছবেদালী নিরীহ গোবেচারা লোক। সংসারের যত দায় ঝামেলা তার ঘাড়ের উপর। মুখ বুঁজে অধম গরুর মত সব কাজ করে যেতো।
অনেকেই তাকে গায়ে পড়ে উপদেশ দিতো। বিশেষ করে যারা হাজেরার চেহারা দেখেছে।
কাছে ডেকে বলতো, দেখ, ছবেদালী, বয়স তো কম হলো না, এত কষ্ট করে কি করে তুমি সংসার চালাবে?
কি করব মিয়াসাব, কপালে যে দুঃখ আছে, তা খণ্ডাবে কে?
কেন, তোমার রোজগেরে লোক নেই?
লোক কনে পাবো সাব?
তোমার বউডা তো কোথাও কাজ করলে পারে।
মাথা ঝাঁকিয়ে না না করেছে হাজেরার বাপ। সে নিজেই নড়তে পারে না, তা কাজ।
তবে, একটা কাজ করো, তোমার মেয়েডারে আমার বাড়িতে পাঠিয়ে দাও। আমার ছেলে মেয়ে নিয়ে বেড়াবে। মাসে মাসে কিছু টাকাও দেব।
এসব প্রস্তাব শুনে হাজেরার বাপ মাঝে মাঝে অনেক কিছুই ভাবতো। তা পাঠাতে পারলে ভালো হয়। কত লোকের মেয়ে ছেলে তো ধান কলে চাল ঝাড়ে। আর হাজেরা তো পর পুরুষের সামনে ঘুরে বেড়াবে না। থাকবে পাঁচিলের মধ্যে। দোষ কি? যদি কিছু টাকা মাসে মাসে রোজগার হয়? কিন্তু একটা কথা চিন্তা করে পিছিয়ে এসেছে হাজেরার বাপ। হাজার হোক, সে এখানকার আদি মানুষ। সব মানুষ কে সে হাড়ে হাড়ে চেনে। কার কি স্বভাব তার জানতে বাকি নেই। যারা প্রস্তাব দিতো, তাদের স্বভাব নিয়ে পাড়ায় পাড়ায় কতদিন কত গোপন কানাঘুষা শুনেছে সে। পয়সাওয়ালা বলে মুখের সামনে কেউ কিছু বলতো না।
হাজেরার ভবিষ্যৎ চিন্তা করে ছবেদালী কেঁদে ফেলতো। নাহ্ বাপ হয়ে সে মেয়েকে সর্বনাশের পথে ঠেলে দিতে পারবে না। তার চেয়ে উপোস করেই মরবো, পরোয়া নেই। মেয়ের ইজ্জত বেচে খেতে পারব না।
হাজেরার মা’র ওসব চিন্তা ছিলো না। সংসারের আগুনে পুড়ে পুড়ে সে জেরবার হয়ে গেছে। চারদিকে পরিপার্শ্বের অবস্থা দেখে জীবনের প্রতি তার তখন ভয়ানক বিতৃষ্ণা। এই সংসারে এসে কী পেয়েছে সে? প্রতিদিন না খেয়ে না দেয়ে তিলে তিলে সে নিজেকে ক্ষয় করেছে। শুধু কয়েকখানা শুকনো হাড় সম্বল করে বেঁচে থাকার নামই কি জীবন? জীবনের মূল্যই বা কি? চোখের সামনে নিজের সন্তান সন্ততির দৈন্যদশা দেখে পশুর মতো গোঙাতে ইচ্ছা করেছে তার।
সন্ধ্যেবেলা ঘরের দাওয়ায় বসে সে ছবেদালীকে প্রস্তাব দিয়েছে, তুমি যখন বাইরে কাজ করেও সংসার চালাতে পারছো না, তখন একটা কাজ করলে হয় না?
ছবেদালী চোখ তুলে তাকাতে পারেনি হাজেরার মা’র দিকে। বলেছে কী কাজ?
আমারও একটা কাজ করলে হয় না? অনেকের বউরা যেমন কাজ করছে।
কথাটা শুনে খেঁকিয়ে উঠেছে হাজেরার বাপ।
ওসব ধান্ধা বাদ দাও। যে সব মেয়ে মানুষ বাইরে কাজ করে, তাদের স্বভাব খারাপ।
চুপ হয়ে যেতো হাজেরার মা। এ নিয়ে আর বাড়াবাড়ি করত না। তার মনে একটা মস্ত বড় দুঃখ চুলোর আগুনের মত ধিকিয়ে ধিকিয়ে উঠতো। হাজেরার বাড়ন্ত দেহের দিকে তাকিয়ে কেবল দীর্ঘশ্বাস ছাড়তো। এই বয়সে কত জনের মেয়েরা আমোদ আহলাদ করে বেড়ায়। গায়ে গতরে গহনা। ভালো ভালো শাড়ি। আলতা, ফিতে। আর হাজেরার কিছুই জোটে না।
নবিছদ্দি প্রায় আসতো। কোনোদিন গোশ্ত ছুঁড়ে দিতো, কোনোদিন টাকা। টাকাগুলো পেয়ে বুকের অর্ধেক আগুন নিভে যেতো হাজেরার। সে মনে প্রাণে কামনা করতো নবিছদ্দির মত একজন স্বচ্ছল পুরুষ। যে ওর সমস্ত অভাব পূরণ করতে পারে।
একদিন নবিছদ্দি দুপুর বেলা গরু পিটাতে পিটাতে যাচ্ছিল। হাজেরাদের বাড়ির কাছে আসতেই সে দেখতে পেলো, হাজেরা গালের মধ্যে আঙুল ঢুকিয়ে ঘরের কানাচে দাঁড়িয়ে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। কেমন হাসি হাসি মুখ। নবিছদ্দি ওকে দেখে আরো জোরে গরু পিটাতে লাগলো। ও আর মুখ বুঁজে থাকতে পারলো না।
আহা, মারছো কেন?
কেন, তা জানি না।
আর মেরো না। ওরা গালাগালি দেবে।
আচ্ছা, আর মারব না।
হাজেরার মা তখন বারান্দায় বসেছিলো। নবিছদ্দির কথা শুনে ছুটে এলো হন্তদন্ত হয়ে। হাজেরার মা’র সাড়া পেয়ে লম্বা লম্বা পা ফেলে ব্যস্ত হয়ে গরু তাড়াতে লাগলো নবিছদ্দি।
এই যে বাবা, শোন।
নবিছদ্দি থমকে দাঁড়ায়।
কিছু বলছেন?
বলছিলাম কি বাবা, আমাদের বাড়িতে এসো। তুমি তো আর পর নও বাপু।
নবিছদ্দি বিনয়ে মাথা নিচু করে ফেললো।
তা বাবা এসো, কেমন? বাড়িতে তো আর কেউ থাকে না। তোমার সঙ্গে বসে কথা বলা যাবে।
এরপর থেকে গরু ঠেঙাতো না নবিছদ্দি।
এক হাঁড়ি মিষ্টি নিয়ে একদিন এলো হাজেরাদের বাড়ি। সেই মিষ্টি পেয়ে হাজেরার মা কৃতার্থ হয়ে গেলো। আশীর্বাদ জানালো, বেঁচে থাকো বাবা, বেঁচে থাকো। জন্ম-জন্মান্তর সুখী হও।
হাজেরা সেদিন ঘরের দরোজার আড়ালে আঁচলে মুখ ঢেকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখেছিলো নবিছদ্দিকে। নবিছদ্দিও দেখেছিলো ঠারে ঠারে। তারপর হাজেরার বানানো এক পানের খিলি মুখে পুরে উঠে পড়েছিলো সেখান থেকে।
এরপর সেই যে আসা শুরু হয়ে গেল, আর শেষ হলো না। যখন সুযোগ পেতো, তখন আসতো। সকাল, দুপুর, বিকেল। কোন কোনদিন রাতেও। না এলে তার ঘুম হতো না। জ্বালা করতো বুক। রাত্রে এসে বেড়ায় টোকা দিতো। হাজেরার চোখেও ঘুম ছিলো না। বারান্দায় নাক ডেকে সারা দিনের খাটুনি লাঘব করতো হাজেরার বাপ। পা টিপে টিপে বাপের মাথা ডিঙিয়ে বেরিয়ে আসতো হাজেরা। এ সুযোগ তার মা করে দিতো। তারও এতে সায় ছিলো।
রান্নাঘরের মধ্যে এসে দুজনে বেহুশ হয়ে যেতো। সময়ের কোন জ্ঞান থাকতো না। শেষ রাতে শরীরের আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতে হাঁটা দিতো নবিছদ্দি।
একদিন ঘর থেকে বেরোতেই অসতর্ক মুহুর্তে হাজেরা পা চাপিয়ে দিলো বাপের বুকের উপর। বাপ ভয়ে আঁতকে উঠতেই হাজেরা ঢুকে গেলো ঘরের মধ্যে। বাইরে দাঁড়িয়েছিলো নবিছদ্দি। ছায়ার মত তাকে দেখতে পেয়েই হাজেরার বাপ হৈ চৈ করে উঠলো। নবিছদ্দি তখন ভোঁ দৌড়। দৌড় মারতে গিয়ে রাস্তায় ইটে বেঁধে পড়ে গেল নবিছদ্দি। পাড়ার লোকজন তখন হৈ চৈ করে ছুটাছুটি করছে। কোনোরকম নিজেকে সামলে নিয়ে সে যাত্রা রেহাই পেলো সে।
সেদিন থেকেই আসা যাওয়া বন্ধ হয়ে গেলো নবিছদ্দির।
এদিকে তখন হাজেরা একমাস পোয়াতি। সব সময় ঘরের মধ্যে বসে বসে ওয়াক ওয়াক করে বমি করে। মাথায় চক্কর খায়। হাজেরার মা কপালে হাত দিয়ে বসলো।
সর্বনাশ, এখন কি হবে? কি করতে গিয়ে কি করে ফেললো হাজেরা। মেয়ের অবস্থা দেখে দিশাহারা হয়ে গেল সে। পাড়ায় পাড়ায় কয়েকদিনের মধ্যে ছড়িয়ে গেলো ঘটনাটা। পাড়ার বৌ-ঝিরা এসে ভিড় করতে লাগলো হাজেরাদের বাড়িতে।
নবিছদ্দি তখন লাপাত্তা। তার টিকিও দেখা যায় না এ অঞ্চলে। মহা ভাবনায় পড়লো হাজেরার মা। পেট থেকে বাচ্চা ফেলে দিবার জন্যে ঝাড় ফুঁক ও পানি পড়া চলতে লাগলো। কোনো কিছুতেই কিছু হলো না। কথাটা হাজেরার বাপের কানে উঠতেই সেই যে লোকটা চুপসে গেল, আর উঠতে পারলো না।
ভাঙা ঘরে ছেঁড়া মাদুরের উপর শুয়ে কাঁদতে কাঁদতে গতর শুকিয়ে গিয়েছিল হাজেরার। কারোর সামনে মুখ দেখাতে পারতো না। যেদিকেই তাকাতো সেদিকেই মনে হতো জনম অন্ধকার। পৃথিবীর সমস্ত লাঞ্ছনা, গঞ্জনা তার মনের উপর ভারি পাথরের মত চেপে বসেছিলো। ক্ষোভে, দুঃখে বেদনায় ছটফট করতো হাজেরা। সবাই তার সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছিলো। এমন কি তার মাও পর্যন্ত। লোকের কথার আঘাতে মারও দেহ মন গিয়েছিলো ভেঙে। এক এক করে সবাই যখন তার সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করে দিলো, তখন হাজেরা একেবারেই ভেঙে পড়লো। পাড়ায় তাকে নিয়ে সবাই রসিকতা করে। এসব সে সহ্য করতে পারে না।
একদিন সন্ধ্যে বেলা। হাজেরা লক্ষ্য করলো পাড়ার কয়েকজন জোয়ান-মর্দ ছেলে ছোকরারা রাস্তায় দাঁড়িয়ে হৈ হল্লা করছে। তাদের মাঝখানে একটি আজব সঙ। পিছনে পিছনে একপাল ছোকরা রঙ তামাশা করছে। সঙটির মাথায় গাধার টুপি। মুখে চুন-কালি। মাথা নিচু করে আস্তে আস্তে হাঁটছে। সকলেই গায়ের জোরে ঠেলতে ঠেলতে নিয়ে আসছে পাড়ার দিকে। হাজেরা বেড়ার ফাঁক দিয়ে দেখতে লাগলো ব্যাপারটা। ঘটনাটি তাকে কৌতুহলী করে তুললো। সে নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগলো। ছেলেরা উৎসাহে চেঁচাচ্ছে_ বর, বর বর যাচ্ছে। এক সময় তারা এসে থেমে গেলো হাজেরাদের বাড়ির কাছে। সঙটিকে ঠেলতে ঠেলতে কয়েকজন এড়ে বাছুরের মত চেঁচাতে চেঁচাতে ঢুকে গেলো ওদের বাড়ির মধ্যে।
এই যে ছবেদালী, দুলহা এসেছে, দুলহা এসেছে।
কেউ কেউ আবার বলতে লাগলো, অপকর্মটা যখন তোমার দিয়েই হয়েছে, তখন আর লজ্জা কি? একেবারেই কাজটা সেরে যাও। আখেরে ফল পাবে।
এই যে হাজেরার মা, যার কথা বলেছিলে, ইনিই কি তিনি?
হাজেরার মা তখন কাঁদতে বসেছে।
তা বাবা এনেছো যখন ভালোই করেছ। তা মারধোর করোনি তো?
তা একটু আধটু হয়েছে বৈকি। বেটা কি আসতে চায়? নিয়ে এলাম ধরে। আমরাও লোক চরিয়ে খাই।
পাড়ার ছেলে ছোকরাদের মধ্য থেকেই তোড়জোড় শুরু হয়ে গেলো। কেউ ডাকতে ছুটলো মোল্লা। কেউ মুরুব্বিদের।
সেই রাতেই একটা বিহিত ব্যবস্থা করে ছেলে ছোকরারা হৈ হল্লা করতে করতে হাজেরাকে তুলে দিয়ে এলো নবিছদ্দির বাড়ি।
নাও, এবার তোমার চীজ। যার মাল তার ঘরেই এলো। এখন ফূর্তিতে রাত কাটাও।
নবিছদ্দি নিজের বাড়িতে এসেও একটা কথা বলেনি।
ঘাড় নিচু করে ভামের মত গুম হয়ে বসেছিলো চোয়ালে হাত দিয়ে। একটি কথাও সে মুখে ফুটে বলেনি।
ঘরের মধ্যে বসে পড়ে সারা রাত সেদিন কেঁদেছিলো হাজেরা।
শহরে তখন মিউনিসিপ্যালিটি হয়েছে। নতুন করে ঢালাই করে সাজানো হচ্ছে বাজারটা। ঘিঞ্জি পুতুল মার্কা কিষাণগঞ্জের রূপ বদলে যাচ্ছে। আগে তেঁতুল গাছের তলায় বসতো গোশ্তের দোকান। সেখান থেকে বদল করে নিয়ে আসা হয়েছে নতুন জায়গায়। বাজারের বুকের মধ্যে মেছোহাটার কাছে চার হাত বাই চার হাত ইটের খুপরি তুলে দিয়ে সারি সারি সাজিয়ে দিয়েছে কয়েকটি গোশ্তের দোকান। এক পাশে ভেড়া, বকরীর গোশ্ত বিক্রি হয়, আরেক পাশে গরু। আগে নবিছদ্দি বেচা-কেনা করতো, এখন আরো কয়েকজন জুটেছে। একজনের কাছে খদ্দের গেলে আরেকজন টেনে নেয়। রীতিমতো ঠেলাঠেলির ব্যাপার। নবিছদ্দির পসার গিয়েছে কমে। সারাদিন ভোম্বল দাসের মত দোকানে বসে ঝিমোয়। এসব ভাব ভঙ্গিমা দেখে তার মেজাজও গিয়েছে তিরিক্ষি হয়ে।
পাশের দোকানদারেরা তার দিকে তাকিয়ে মিচকি মিচকি হাসে। কেউ কেউ রসিকতা করে বলে, কি হে নবিছদ্দি, তোমার নতুন বউয়ের খবর কি? কেমন চলছে দিনকাল?
আরেকজন টিপ্পনি কাটে, তা শুনলাম, চুন-কালি মেখে নাকি নিকে করতে গিয়েছিলে? তা বেশ বেশ।
ফুর্তি করো বাবা, ফূর্তি করো।
ওরা যত বলতো, নবিছদ্দির শরীরও জ্বালা করে উঠতো ততো। রাগে দাঁত কটমট করে তাকাতো দোকানদারদের দিকে। অবশেষে যত রাগ পড়তো গিয়ে হাজেরার উপর। যত নষ্টের মূল ও মাগীটা।
অনেক রাতে বাড়িতে ফিরতো নবিছদ্দি। এসে দেখতো দরোজায় খিল এঁটে দিয়ে অসাড় হয়ে
ঘুমুচ্ছে হাজেরা। অনেকক্ষণ হাঁক-ডাক, ধাক্কাধাক্কির পর দরোজাটা খুলে দিতো সে। তাতে মন
আরো রুক্ষ হয়ে উঠতো ওর। সারা পথ সে কল্পনা করতে করতে আসতো, বাড়ি গেলেই বউ আদর করে বুকের কাছে টেনে নেবে। হাসি মুখে কথা বলবে ওর সঙ্গে।
অভিমান করে বলবে, এতক্ষণ কোথায় ছিলে? দেখ, তোমার অপেক্ষায় এখনো রাত জেগে বসে আছি।
কিন্তু কোথায় সেসব ? হাসি মুখে আদর করা তো দূরের কথা, দরোজা খুলে দিয়েই সেই যে গোমড়া মুখে বসে থাকবে হাজেরা, মুখ দিয়ে একটা কথাও বের হবে না।
তবুও সে ইনিয়ে বিনিয়ে বলতো, সারাদিন পরে বাড়িতে এলাম, যদি মুখ গোমড়া করে থাকিস, ভালো হবে না বলছি।
হাজেরা ফ্যালফ্যাল করে তাকাতো নবিছদ্দির দিকে।
কিরে, কথা বলছিস না যে?
কি বলব?
কি বলবি, তার আমায় বলে দিতে হবে?
হাজেরা নিশ্চল পাথরের মত হয়ে যেত। নবিছদ্দির দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলতো শুধু।
ভোর বেলা দোকানে এলে মন অনেকটা হাল্কা বোধ হতো নবিছদ্দির। গরুর গলায় ছুরি চালানোর আগে পর্যন্ত তার মেজাজের কোন পরিবর্তন দেখা যেত না। গলায় ভুজালি চালানোর সঙ্গে সঙ্গে মাথাটা যেত বিগড়ে। বিয়ের দিনকার কথা মনে হতো। বুকের জামা আঁকড়ে ধরে কয়েকজন ছোকরা উত্তম মধ্যম দিয়েছিলো। মাথা ও কান এক আঘাতে ফেটে গিয়েছিলো। রক্তের ধারা নেমে এসেছিলো চোখের কোণ বেয়ে। বুকের জামা ছোপ ছোপ রক্তে ভরে গিয়েছিলো। এ যেন সেই রক্ত। মুখে চুন-কালি মাখানো সমস্ত দৃশ্যটা নবিছদ্দির চোখের সামনে ভেসে ওঠতো। সে আর স্থির থাকতে পারতো না।
গরুর চামড়া ছুলতে ছূলতে ক্রোধে, উত্তেজনায় কাঁপতে থাকতো নবিছদ্দি। তার মনে হতো, এখনি যদি বান্চোতদের হাতের মুঠোয় পেতাম। শালা থাবড়ে দিতাম একেবারে। চোখ দুটে লালচে করে এদিক ওদিক তাকাতে তাকাতে দিশাহারা হয়ে যেত নবিছদ্দি।
চামড়া ছোলা হয়ে গেলে গোশ্ত কাটতে আরম্ভ করতো। গোশ্ত কাটতে কাটতে যেন পাগল হয়ে যেত।
শালা, তোদের যদি সামনে পেতাম, আজ কচুকাটা করতাম এমনি করে। বিড় বিড় করে কথাগুলি বলতো নবিছদ্দি।
তারপর তার চোখের সামনে ভেসে উঠতো হাজেরার ছবি। হাজেরার ছবি মনে পড়তেই প্রত্যেক রাত্রের ঘটনাগুলো এক এক করে তার বুকের মধ্যে ভিড় করতো। ভালো করে কথা বলে না হাজেরা। তা বলবি কেন, শালী, আজ ঘরে এসেছিস্ কিনা? তখন যে বলতিস, তুমি আমার সব, তুমি আমার জীবন। আর এখন শালা আমি হলাম গিয়ে ভাগাড়ের শকুন।
বুকের ভিতর গুমরে গুমরে উঠতো সমস্ত কথাগুলো।
ও এখনো স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে সপাং সপাং করে ওর পিটে লাঠি পড়ছে।
বল শালা, হাজেরার কাছে তুই গিয়েছিলি কি না?
উঃ আর মেরো না।
বল শালা, বল।
উঃ বাবাগো—
বল, শালা, আর করবি কিনা?
উঃ মাগো—
যার কাছে গিয়েছিস, তাকে মা বলতে হবে।
উঃ ছেড়ে দাও, আর যাবো না।
যাবিনে, যাবিনে কেন?
উঃ উঃ!
তোর মা’র কাছে আর যাবি কিনা বল?
উঃ! উঃ! বাবাগো—
কথাগুলো ভাবতেই পায়ের পাতা থেকে মাথা পর্যন্ত রক্ত চনচন করে উঠতো। শরীর ঘামতো দরদর করে। মাংসের উপর ভুজালিটা চেপে ধরে চোখ দুটো পাকিয়ে ফুলতে থাকতো নবিছদ্দি।
শালি, তোর জন্যেই মার খেয়েছি।
হারামজাদি, তুই আমার জীবনের উপর উঠেছিলি।
যে শালারা সেদিন মেরেছিলো, তারা কি তোর নাং?
তোর জন্যে এত দরদ কেন?
তুই কি শুধু আমার সঙ্গে ছিলি?
তোর পেটে যে বাচ্চা, তা কি আমার?
কোন নাং এর সঙ্গে ঢলাঢলি করে বানিয়েছিস, আর দোষ হচ্ছে আমার।
আমি কি তোর কাছে ফোক্ট্সে যেতাম?
বেবুশ্যে, টাকা নিসনি?
আরও কতজনের তুই পার করেছিস, তার কি ঠিক আছে?
কার দিয়ে বাচ্চা পয়দা করেছিস, আর দোষী হবো গিয়ে আমি?
শালি, এখন আমার ঘরে এসে শুধু কান্দিস?
জবাব দে? জবাব দিতে পারিসনে কেন?
তোর নিকুচি করি।
সকাল বেলা এই নিয়েই হদ্দ পিটিয়েছে নবিছদ্দি। দাঁতে দাঁত কসে ফুসতে ফুসতে বেরিয়ে গেছে সে। অন্তরের মধ্যে দারুণ এক ঝড় বয়ে গেছে ওর। সারাদিন আজ অসীম এক উত্তেজনায় উন্মাদের মত ছুটে বেড়ালো নবিছদ্দি। কোথায়ও এক ঠাঁইয়ে বসে থাকতে পারেনি সে। ভাবনাগুলো যেন তাকে ক্ষিপ্ত কুকুরের মত কামড়িয়েছে। শহরের অলি-গলি উদ্ভ্রান্তের মত টহল দিয়ে বেড়িয়েছে। ভাটিখানায় গিয়ে ধেনো মদের বোতলে চুমুক দিয়েছে। কিন্তু তাতে আরো আগুন জ্বলে উঠেছে মাথায়।
সারারাত এইভাবে পথে পথে কাটিয়ে শেষ রাতের দিকে বাড়ির পথে হেঁটে গেছে নবিছদ্দি। মাথায় তার রক্ত টগবগ করছে। আস্তে আস্তে রাত শেষ হয়ে আসছিলো। রাতের অন্ধকার হয়ে আসছিলো ফিকে। বড় বড় ধাপ ফেলে জোরে জোরে হাঁটতে লাগলো নবিছদ্দি।
ভোর হবার আগেই বাড়িতে গিয়ে পৌঁছায় সে। এতকাল সে গরু জবাই করে এসেছে। আজ সে একটা মানুষ জবাই করবে।
জোরে আরো জোরে অন্ধকারে লম্বা লম্বা করে পা ফেলতে লাগলো নবিছদ্দি। শালি, আজ রাতে তোকে ঠিক জবাই করবই। তা যদি না করি আমি কসাই নই।
boro valo laglo! chomotkar golpo!
হোসেন ভাইকে ধন্যবদ|