অনুবাদ: তাপস গায়েন
[কবি আব্দুল ওয়াব আল-বয়াতি (১৯২৬-১৯৯৯)-র জন্ম ইরাকের বাগদাদে, দ্বাদশ শতাব্দীর সুফী সাধক আব্দেল কাদির আল-জিলানির দরগাহের কাছে।আরব বিশ্বের কবিতা যা পনের শতাব্দি ধরে আবর্তিত হয়েছে চিরায়ত আঙ্গিকের ভিতরে, অর্থাৎ, মিল এবং ছন্দের স্বাভাবিক বৃত্তে। সেই বৃত্তকে ভেঙ্গে তিনি বিষয়-ভাবনা এবং গঠনকাঠামোর দিক থেকে নির্মাণ করেছেন নতুন কবিতা । – তাপস গায়েন]
(১)
তিনি সনাক্ত হলেন মদ্যপ অভিধায় । তিনি বলেন, আমিই মদ, আর তুমি মদ বহনকারী । হে আমার প্রেয়সী, তুমি নিতান্তই যদি আমার মতো হয়ে উঠতে । “ভালবাসার উন্মাদনায় তিনি কাঁদেন, এবং মদের জন্য বন্ধক রাখেন তাঁর প্রিয়, পবিত্র পোশাক ।” তোমার কাছে যাওয়া-আসার এই ভ্রমণে আমার হৃদয় এখন ধূলিতে আচ্ছাদিত । দ্রাক্ষাকুঞ্জের পদপ্রান্তে উন্মাদ আমি ; আমাকে মদ পরিবেশন করে আমার পোশাক গুঁজে দাও । অলৌকিকতার সাতটি গোলকের নীচে আমার মুখ-গহ্বর থেকে তুলে নিয়ে এসো রুবি, এবং প্রাণবন্ত চুমোয় এই পৃথিবীর গভীরে জ্বালাও আগুন । তুমি ছিলে আমার দর্পণ, আমি এখন হয়েছি দর্পণ । তোমার নগ্নতায়, যা আমি দিয়েছি তোমাকে, সেই আমি এখন নগ্ন । যতক্ষণ পানপত্র কথা কয়ে উঠবে না, ততক্ষণ পর্যন্ত তোমাকে খুঁজে ফিরব আমি, আমার সাবলীলতায়, আমার উন্মাদনায় !
এই পৃথিবীর মৌলের যে সত্তা, আর এই রাতের
রূপালি এবং নীল আলো, দ্যাখো
কীভাবে মাটিতে প্রণত আমি, দিব্যতায় আছি ভাববিহ্বল
অসম্ভব এই রাতের অতিথি মদের মননে মত্ত ।
হে ভালবাসার গিটার, দ্যাখো উন্মত্ত আমি,
আর মদ আমাকে করে রাখে উদ্ভাসিত,
তোমার নগ্নতায় কেঁদে উঠি আমি ।
আমার ভালোবাসা থেকে যেত অনুচ্চারিত, যদি না এই সমুজ্জ্বল
বনবীথি এই প্রবাহে উৎসারিত করে দিত তাদের সকল সবুজ ।
[দুই]
এই পোশাকে আবৃত আছে একটি মানুষ, অন্য কিছু নয়, নিতান্তই মানুষ ।
[তিন]
আমার জন্য তুমি ছিলে দর্পণ, এখন আমিই হয়েছি দর্পণ ।
[চার]
এই বিষণ্ণ-সাহারা-রাতের উটকে আমি বলিদান করি । এই আহত জন্তুর পাশে আমি যন্ত্রণায় গোঙাই ; এবং বলি, একদিন সময় এসে হাজির হবে, যখন মানুষ রূপান্তরিত হয়ে হবে ধূলি তার ভাইয়ের নিমিত্তে (এবং হবে ধূলি সাতটি অলৌকিক গোলকের প্রভুর জন্য), যখন মদের জন্য তিনি তাঁর পবিত্র পোশাক বন্ধক রেখেছেন, এবং যখন ভালোবাসায় তিনি ক্রন্দনরত, উন্মাদ । বন্য ঘাস এবং কালো পাথরের নীচ থেকে আয়েশা জেগে ওঠেন, যেন পলায়নরত সোনালি হরিণ; আমি তাঁকে অনুসরণ করি, দ্রাক্ষাকুঞ্জের নীচে তাঁকে আমি জাপ্টে ধরি, তাঁকে করি বিবস্ত্র, এবং আমি দেখি আমার নগ্নতা । আমার জন্য তুমি ছিলে দর্পণ, এখন আমিই হয়েছি দর্পণ । আমি বলিঃ সময় আসবে ! কিন্তু দরোজার বাহিরে হলুদ গাছ, প্রবল বাতাসে নেচে ওঠে, এবং বাতাস কবির প্রদীপ কুয়ার নীচে ছুঁড়ে দেয় । ভাববিহ্বলতায় আমি উন্মোচিত করতে পারতাম না আমার এই ক্ষত, যদি না আয়েশাকে আমি হারিয়ে ফেলতাম ভাগ্যের পানশালায় । তুমিহীন, আমি আমার গোপনীয়তা কক্ষচ্যুত নক্ষত্রের কাছে প্রকাশ করতে পারতাম না ! একমাত্র শুঁড়িই বিজয়ী ; সুতরাং, আমাকে মদ পরিবেশন কর, আমার পোশাক গুঁজে দাও, দ্রাক্ষাকুঞ্জের পদপ্রান্তে উন্মাদ আমি, সাতটি অলৌকিক গোলকের নীচে আমার মুখগহ্বর থেকে তুলে নিয়ে এসো রুবী ।
[পাঁচ]
আমার তন্দ্রাচ্ছন্নতায়, আমি ঘুরে ফিরি তোমার চর্তুদিকে, এবং উন্মাদ নিন্দ্রাহীনতায় পড়ে থাকি দুঃস্বপ্নে ।
[ছয়]
কবিতার এই শেষ পংক্তি না লিখে আমি হব না পরাজিত । এসো, রাতের এই নীল নভোস্তলের নীচে আমরা মদ পান করি, যতক্ষণ না অনাদি-অনন্ত রাত এসে আমাদের নিয়ে যায় এবং আমরা ঘুমিয়ে পড়ি মাটির গভীরে ।
[সাত]
আমি মারা যাব, তুমিও যাবে
তবে জীবন-উদযাপনের মুহুর্তে কেন তুমি কাঁদো ?
মদের পেয়ালা বহনকারী, সন্তত সাকি, মদ পরিবেশনকালে কেন তুমি শুধু বৃত্তায়িত হও ?
[আট]
এই বিশ্বের পাপিষ্ঠ জাতিসত্তায়, অন্তহীন এই সমুদ্রযাত্রা । এবং এই বিশ্ব, উজ্জ্বল নক্ষত্র সত্ত্বেও, এক পরাজিত ধাবমান মেঘ । ভালোবাসার ব্যালকনি থেকে পতিত, নিষ্ঠুর চোর যেন শাশ্বতের কৃতদাস । কেনো আমরা পলায়নপর, যখন আমরা ইতোমধ্যে পৌঁছে গেছি ? ফুল সংগ্রহের আগে কেনো আমরা মারা যাই ? কেনো আমাদের শিশুতোষ বিয়েয় আমরা কাঁদি, ভয়ে আর্ত আমরা বৃত্তাকারে ঘুরি ? সুতরাং, আমাকে মদ দিয়ে আপ্যায়ন কর, আমিতো উন্মাদ, দ্রাক্ষাকুঞ্জের নীচে আমাকে বিন্যস্ত কর । ধাবমান মৃত্যু অপেক্ষমান পানশালায়, বাজারে, সাকির চোখে, যা বিদ্ধ করছে আমার বুক । আমি কাঁদি । কিন্ত তোমার থেকে এবং তোমার প্রতি আমার অত্যধিক ভ্রাম্যমানতায়, আমি আমার সাবলীলতায় এবং মদ্যপ অবস্থায় তোমাকে নিয়ে ভাবনায় আমি অস্থির । হে আমার প্রিয়, তোমার পবিত্র পোশাক বন্ধক রেখে, তুমি হও আমারই মতো–ক্রন্দনরত, উন্মাদ ।
[নয়]
আমার জন্য তুমি ছিলে দর্পণ, এখন আমিই হয়েছি দর্পণ ।
[দশ]
একমাত্র শুঁড়ি, পানশালার রক্ষক-ই, বিজয়ী ।
নিউইয়র্ক, ডিসেম্বর ০৫-১২, ২০১৩