পর্ব-১।। পর্ব-২।। পর্ব-৩।। পর্ব-৪।।
নাহার মনিকা
জুতার ফিতা বাঁধা আর রোজ রোজ গলা সাধা বিষময় কাজ ছিল নিধির জন্য। আর নিয়ম করে প্রতি বিকালে বাবার সামনে (যখন বাড়ি থাকতো) বসে গলা সাধা। নিধির গলায় সুর খেলে না এটা বাবা বুঝতে চাইতো না, তার দৃঢ় বিশ্বাস গলায় সুর বাঁধতে পারলে অন্যকাজে (পড়ালেখায়) মনযোগ বাড়ে। নিধির হাত বেলোর কাছে না পৌঁছার বয়সে সে হারমোনিয়ামে বসে গেল। বাবা বাজায়, নি-সা-রে-পা-রে-মা গা’এর কোমল গা’কে অনেকক্ষণ মৃদুলয়ে ধরে থাকলে নিধির ঘুম ঘুম ঝিমুনি চলে আসতো। বাবা তখন একটা কঞ্চি হাতে করে হারমোনিয়ামের বেলোতে মৃদু আঘাত করতো। নিধি হকচকিয়ে উঠে আবার নি সা রে পা রে গা মা…তে সজাগ হয়ে গলা তুলতো। বাবার ঝাঁঝে ভরা সুরের সঙ্গে তার বেসুরো সুর এক কক্ষপথে ঘুরতে চাইতো না। হাল ছেড়ে বাবা তখন পূরবী রাগে নিজেই ‘হামে না ভাবে ইয়ারি, রে সাবারিয়া…র মুখটুকু গাইতে চেষ্টা বসতো। নিধি এক ছুট দিয়ে সামনে থেকে চলে গেলেও তার তখন চোখ বন্ধ!
আর ক্যানভাসের শাদা জুতার সুতলীর মত ফিতা? কী যে সব মুখ গোজ করা দিন কেটেছে! নিধি যতই চেষ্টা চালায় জুতার ফিতারা ততই দূরের আগাছার ভঙ্গীতে দলছুট হয়ে থাকে। সবাই জানতো– নিধির আর তার বাবার মধ্যেকার স্নায়ুযুদ্ধ। বাবা তাকে দুনিয়ায় চলার উপযোগী সব কাজকাম শিখিয়ে যাবে, হাতে স্ক্রু-ড্রাইভার ধরিয়ে দরজার কব্জা পর্যন্ত খোলা শেখায়। নিধির ফুপু তার ঢেউ খেলানো চুল দুলিয়ে হাসে–‘ বাদ দেও না। আরে, জুতার ফিতা বান্ধাও একটা কাজ! আর তোমার মেয়ে কি বড় হয়ে মিস্তিরি হবে’?
কিন্তু এই একটা কাজই কেন যেন নিধির আয়ত্বে আসে না। বাবা তবু রক্তচক্ষু, চেয়ারে বসে মেঝেতে পা ছড়ানো মেয়ের জুতার ফিতা বাঁধা দেখে। নটগুলো ঠিক মাপমত না হলে ধমকে ওঠে। কেঁদে কেঁদে চোখ ফুলে গেলেও ছাড়াছাড়ি নাই। তার এক কথা– ‘জুতা ঠিকঠাক না পরতে শিখলে জীবনে মোটিভেশন আসে না’। অনেকদিন লেগে গেলো নিধির এই ফিতেবাঁধা শিখতে। শেখার পর মনে হলো সে বানরের পিঠা বন্টনের শেষ টুকরাটার ভাগ পেয়েছে, যার নাম লাগাতার অপেক্ষার স্নায়ুবিক চাপ থেকে নিস্তার, আর মোটিভেশনের মানে না বুঝেও জেনেছে – ঐ বস্তু তার আয়ত্বে আসবে না।
দোকানে গেলে অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল মনে মনে শুধু ফিতাবিহীন জুতা খোঁজা। স্কুলের পরীক্ষায় খারাপ করে, কোন কোন বিকেলে এলিফ্যান্ট রোড ধরে রিক্সা করে গেলে দোকানগুলিতে এক লাফে নেমে যেতে ইচ্ছে করেছে। ছেলেরা যখন পাম্প-সু নামের একধরনের চেইন লাগানো বুটজুতা পরে ঘুরে বেড়ায়, তার চোখ লোভে চকচক করেছে। ইর্ষাপ্রসুত সে ইচ্ছা তার বাবা মা বুঝতে পারেনি। জুতার ফিতা ঠিকমত না বাঁধতে পারার ক্লেশ তার এখনো কদাচিৎ ফিরে ফিরে আসে।
পরে, আরো অনেক পরে আবার যখন ঢাকায় ফিরে এলো নিধি (নিজের এমনকি হাত পা নিয়ে বিব্রত নিধির জীবনে কত কি ঘটে গেছে এর মধ্যে!) একদিন ফুপুর বাসার মোড়ের রাস্তায় এসে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গিয়েছিলো। তার কাঁধে বইয়ের ব্যাগ, সেখানে পকেটে টিফিনের থেকে জমানো পয়সা। বৈশাখ মাসের দুপুর, রীতিমত লালচে হয়ে পুড়ে গেল নিধির গাল, কপাল। মোড়ের রাস্তায় একসারিতে দু’চারটা জুতার দোকানের সেলসম্যানরা তার দিকে অবাক হয়ে দেখছে কিনা খেয়াল করার অবসর পায়নি সে, জুতার ভেতরে পা ঘেমে এমন ভ্যপ্সা হলো যে হাঁটার কথা দু’একবার ভুলে গেল নিধি। খুব বেশী জুতা পায়ে দিয়ে দেখতে পারেনি, যে কয়জোড়া দেখেছে তার কোনটাই নিধির সাইজের ফিতাবিহীন স্যু’র চাহিদা মেটাতে পারে না।
দুই ব্লক দূরের বাসায় ফিরতে ফিরতে নিধির সেদিন পৃথিবীকে দীর্ঘ কন্টকময় মনে হয়, এত বিশাল যে সে হারিয়ে গেলে নিজেও নিজেকে খুঁজে পাবে না। জুতার ভেতরে পায়ের কড়ে আঙ্গুলের বাইরের দিকটায় গোল, টোপা ফোস্কা। জীবনের মোটিভেশন কিনতে গিয়ে সে গলে যাওয়া লাল ফোস্কা নিয়ে বাসায় ফিরেছিল। ফিরতে সেদিন তার দেরী হয়েছিল। কোন উৎকন্ঠিত মুখ দরজায় না দেখে তার অবাক লেগেছে, এমন কি অয়নের ত্রাসে সদা জাগ্রত কাজের বুয়াও না!
নিধি নিজের ঘরে ঢুকে জুতো খোলে, পা ধোয়। ফুপুর বাতিক মোতাবেক সেখানে পেট্রোলিয়াম জেলী মালিশ করলে ঠান্ডা লাগার বদলে জ্বলতে থাকে (ফুপুর ধারণা পৃথিবীর সব চর্ম চিকিৎসার প্রায়োগিক ওষুধ হচ্ছে ভ্যাসেলিন)। তারপর জামা কাপড় না ছেড়ে জানালার কাছে দাঁড়িয়ে থাকে।
তার জানালার বাইরে ব্যস্ত পথ, বেশুমার মানুষের আনাগোনা। হ্যাঁচকা হর্ণ মেরে যেতে গিয়ে আটকে যাওয়া একটা পাঁচটনি ট্রাক,সমগ্র বাংলাদেশ। ট্রাকের হেডলাইটের ঝলসানো আলো কী সহজে ধাক্কা মেরে নাড়িয়ে দিয়ে যায় তার ঘর আর মনের ঘনঘোর। মন খারাপ আর পায়ের ফোস্কার জ্বলুনি একটুও স্তিমিত না হয়ে অতি শৈশবে ঢাকা শহরে বসবাসের স্মৃতি মনে পড়ে নিধির, এই স্মৃতি তার নিজস্ব জাত নাকি মা’র মুখ থেকে শুনে শুনে অকাট্য হয়েছে, সঠিক মনে করতে পারে না।
তখন তারা এলিফ্যান্ট রোডে থাকতো, একটা তিনতলা বাড়ির দোতলার ডান দিকের ফ্ল্যাটে। সেইদিন ঘুমাতে যাবার আগে আগে তার মা’কে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। গলির মুখে ফার্মেসীর বিকেলের চেম্বারের ডাক্তার তখনো বন্ধ করেনি। মায়ের শ্যামলা পানপাতা মুখে একটা ভয়ের ছায়া কুঞ্চিত করে ঝুলিয়ে দিয়ে গেছে লোকটা, হার্টবিটে নাকি খুব বেশী ধীর লয়, কিংবা কয়েক সেকেণ্ডের জন্য বন্ধ হয়ে গিয়েছিল– এ ধরনের কথপোকথন পরিস্কার না বুঝে শুনে গেছে নিধিও। মা মিন মিন করে হাসপাতালে যাওয়ার আগে পরনের কাপড় বদলে নিতে চাইছিল। বাবা রাজী হলো না, সময় ছিল না। ভাগ্যিস সেই শুক্রবারে বাবা এসেছিল। মাকে অগত্যা হলুদ আর কালো ড্রাগনের মুখ আঁকা নরম লিনেনের একহারা নাইটিতে বাসা থেকে বেরুতে হয়েছিল।
নিধি চোখ বন্ধ করে দেখতে পায়– ঘাড় বেয়ে পেছনে একটা ন্যাতানো বেনী নেমে গেছে, মায়ের নাইটিতে ড্রাগনের হা করা মুখ তার হাঁটার সঙ্গে দুলে দুলে ঘর থেকে বের হচ্ছে, গলিতে পরাজিত চাঁদের আলো রাস্তায় দাঁড়ানো বেবীট্যাক্সির গায়ে আলোছায়ার খেলা বানিয়েছিল। মা বাঁকা হয়ে ঝুঁকলে বাবা তাকে ঢুকে বসতে সাহায্য করলো। কপাল কুচকে থাকা মায়ের চোখ বন্ধ, নিধির মনে হচ্ছিল– অসুখ বিসুখ কিছু না, সে দুপুরে বাইরের রাস্তায় চলে গিয়েছিল বলে মা বোধহয় ভ্রু’র কাছে অসন্তুষ্টি জমাট করে রেখেছে। নিধি সামনেই দাঁড়িয়ে ছিল, মা তাকে দেখেও দেখলো না। শরীরের অসুখ বুঝি মানুষকে নিজের সবচেয়ে কাছের করে তোলে– তখন ঝি’ই কি আর জামাই-ই কি, নিজের চেয়ে বেশী মনঃসংযোগ আর কাউকে দেয়া যায় না।
সন্ধ্যাবেলা ঝুপ করে নামার আগে এক রকমের বিষণ্ণ মুহূর্ত যেমন গ্রাস করে ফেলে চরাচর (মা’র কথাবার্তার মধ্যে বহু ব্যবহৃত শব্দ ‘চরাচর’, অথচ কথাটা শহরে বসে বললে কেমন হাস্যকর শোনায়!) মা বাসায় না থাকায় নিধির কাছে চারপাশ তেমন আগ্রাসী শূন্য লেগেছিল। যদিও সে সবকিছু পায় বুয়ার কাছ থেকে,- তার টিফিন, দুধের গ্লাসে ওভাল্টিন, ধোয়া স্কুলড্রেসের ইস্ত্রি করা বেল্ট। বুয়া তার যাদুময়তা দিয়ে সবকিছুতে এক দাগ ওষুধের আরোগ্যস্পর্শ দিতে পারে (আরোগ্যময় তবে ক্লান্তিকর)।
মা’কে নিয়ে বাবা চলে গেলে সে আবার জানালার কাছে দৌড়ে এসে দাঁড়িয়েছিল, সেখান থেকে কিছু দেখা যেতো না, কেবল পাশের বাড়ির পর্দা দেয়া জানালার সঙ্গে পার্থক্যকারী অপরিসর ড্রেনের ফারাকটুকু ছাড়া, রাতের বেলা যেটা নিধির জন্য ভয় উদ্রেককারী গভীর খোঁড়ল। সেদিন চমকে উঠে দেখেছিল, মরা আলোয় এক দঙ্গল অলীক পোকা মাথা ঠুকছে জানলার কাঁচে, প্রবেশের অনুমতিবিহীন অনন্ত ঠোকাঠুকি । জানালাটা খুলে দিতে ইচ্ছে করেছে নিধির, কিন্তু পারেনি। যেমন করে জীবনের কত রকম ভবিতব্য ঠেকাতে পারেনি সে– সন্দেহ, বিচ্ছেদ, মৃত্যুর মত অবশ্যম্ভাবী রকমারী বিষয় আশয়। (চলবে)