পর্ব-১।। পর্ব-২।। পর্ব-৩।। পর্ব-৪।। পর্ব-৫।। পর্ব-৬।। পর্ব-৭ ।।
নাহার মনিকা
নিধি যখন পেটে, বাবা তখন পাটগ্রামের আরো ভেতরের কোন এলাকায় বদলি হলো। নিধির মা কালো স্যুটকেসে কাপড় গুছিয়ে তৈরী, সঙ্গে যাবে, সঙ্গে যাওয়া মানে পেটের ভেতরে বাড়তে থাকা নিধির জন্য বাবারও হাতের ছোঁয়া। বুকের ব্যথায়, পিঠের ব্যথায় সে স্পর্শ যেন বিরামহীন হয়। কিন্তু মা’র শরীরটা তার নিয়ন্ত্রণে থাকছিল না। সকালে বিছানা থেকে উঠতে গিয়ে মাথা ঘুরে পড়ে গেলে দাদী চিল চিৎকারে আপত্তি করে- ‘ঐ বন বাদাড়ে মাথা ঘুইরা পড়লে দেখবো কে?’ বাবা রা কাড়ে না, মা আঙ্গুলে আঁচল প্যাচায়, দাঁতে নখ কেটে খোদল বানিয়ে ফেলে। -‘পর্ত্যেকদিন মাছ, দুধ খাওন দরকার’, দাদী আবারো বয়ান করে। গরমকাল আসি আসি সময়ে তিনমাসের পোয়াতির ভরভরন্ত শরীরের আগ্রাসী ক্ষুধা। মা তখন শশার জাংলা থেকে কচি শশা ছিঁড়ে খায়, ভাতের মধ্যে তেতুল গুলে দেয়। কেবল মাছ, মাংসের গন্ধ পেলে তার পেটের ভেতর গুলিয়ে আসে। আর দুধের নামও শুনতে পারে না। যেন এইসব খাদ্যবস্তু অপার্থিব, অবয়বহীন হওয়ার জন্য চারপাশে ঘোরাঘুরি করছে। একদিন ভোরবেলায় দাদু দেখলো তার ছেলের বউ চুলার পাড়ে উবু হয়ে বসে আছে। তার ছাপা শাড়ির আঁচল মাটিতে গড়াগড়ি যায়। ‘বীণা’ ডাক শুনে স্থির হয়ে বসে থাকে সে, তার মুখে উনুনের পোড়া মাটি, খাবলা খাবলা তুলে চিবিয়ে খাচ্ছে। বাড়ি ভর্তি ফল ফলাদি’র গাছ, হাত বাড়ালে তরতাজা শীম, লাউপাতা, জিয়ল শিং মাগুরের দৈনিক জোগান, আর তার পুত্রবধু কিনা চুলার পোড়া মাটি চিবিয়ে খাচ্ছে! পুত্রবধু’র ফ্যাকাশে মুখ, চোখের নীচে গাঢ় রেখা। দাদুও আপত্তি তুললো। ছেলের সঙ্গে ঘোর মফস্বলে গর্ভবতীকে পাঠানো সমীচিন হবে না। এইবেলা নিধির মা মিন মিন করেছে- পাটগ্রামের চেয়ে মুন্সিগঞ্জ বাপের বাড়ি ভালো, সেখানে তার মা-চাচীরা আছে। মনে মনে প্রত্যাশা ছিল কেউ তার প্রস্তাবে রাজী হবে না। বন্দোবস্ত মেনে নেয়া বাবার শান্ত মুখ দেখে নিধি’র মা’র রাগ হয়। দু’দিন আগেও বাবা পাটগ্রামে তাদের অস্থায়ী সংসারে কেরোসিনের ষ্টোভে পটল ভাজি পুরিয়ে ফেলার কাল্পনিক দৃশ্যে আঁতকে ওঠা মা’কে কেমন জড়িয়ে আদর করলো, সে বিষয়ে বলতে ইচ্ছে করে, কিন্তু চেহারা কঠিন করে রাখে নিধির মা। দিন কয়েক বাদে একসকালে ঘরের জানালার কাঠের পাল্লার ওপাশে সকালের সূর্য খিটিমিটি করে উঠলে বাবা বিছানার পাশের টেবিলে রাখা চা নাস্তা খায়, তারপর ব্রীফকেসের ডালা ঠকাস করে বন্ধ ক’রে তার চৌকোনা ব্যাগে কাপড় ভরে বিদায় নিয়ে চলে যায়। নিধির মা সেদিন ঠায় অনেকক্ষণ জানালার কালো শিক ধরে দাঁড়িয়ে থাকে। বিরহ ব্যথা সহ্যের অভ্যাস কি তখন থেকে শুরু হলো!
বাপের বাড়িতে নাইওর ফিরতে ফিরতে পদ্মার পাড় থেকে বেপরোয়া মেছো গন্ধ এসে নিধির মা’র গা গোলানো মন খারাপ লাগা দ্বিগুণ করে তোলে। দিন কয়েকের মধ্যে তা হালকাও হয়ে যেতে থাকে। কথা বলার লোক খুঁজে পেয়েছে সে, পেটের ওপরে হাত রেখে নিধির সঙ্গে কথা বলে। বাড়ির পেছনে গাছের ডালে একটা রাম পিঁড়ি দড়িতে বেঁধে নিধির মা পড়ন্ত বিকেলে দোল খায় আর বাবা’র সঙ্গে পাটগ্রামে থাকলে কেমন হতো সেসব ফিস ফিস করে। ‘-বুঝলি, ঐখানে মানুষ থাকতে পারে? বাড়ির চারদিকে কোন বেড়া নাই, খা খা করে, দূরে একটা চিকন ইটের রাস্তা। ওই রাস্তাটাই খালি আরো দূরে যায়, সোজা, যাইতে যাইতে আরো চিকন হইতে থাকে। তোর বাবা সারাদিন বাড়িতে থাকে না, সকালে গেলে ফিরা আসতে আসতে বিকাল। প্রত্যেক দিন এক মুঠা শাপলা সঙ্গে নিয়া আসে। বলে- ‘ইলিশ মাছ দিয়া রান্না করো’। ইলিশ মাছের গন্ধে আমার আসে বমি। তোর বাপের কোন বিবেচনা নাই’। তার কথাগুলো উড়ে যায়, ঝুলনের পিঁড়ি থেকে, কাঠাল গাছের মাথায় উঠে, পদ্মা পার হয়ে যেন পাটগ্রামে পড়ে- পেটের ভেতরে গুটলি পাকিয়ে শুয়ে থাকা নিধির কাছে এইমত সাধ যাঞ্ছা করে সে। যেন নিধিই পারে একমাত্র এই দূরত্বের সেতু উপড়ে ফেলতে।
মা নাইওর হয়ে বাপের বাড়িতে থাকলো ঝাড়া এক বছর। বাবা আসে একবার, দু’দিনের ছুটিতে। তখন পেটের ভেতরে নিধির আকুপাকু করা ঢিমে তালের হয়ে গেছে, পা ছোড়াছুঁড়ির স্থান সংকুলান কম। তবু নিধির মা’র ইচ্ছে করে সে যখন এলায়িত শরীরে আয়েশ ভাঙ্গে, বাবা তার পেটে হাত দিয়ে দেখুক। তার মেরুদন্ডে স্থায়ী এক ব্যথা বাসা বাঁধে, গর্ভের শিশুটির বেড়ে ওঠা বইবার আল্লাদী ব্যথা। ঘরের পাটাতনে বসে পড়ে উঠতে গেলে দুই হাতের ভর কোমরে রেখে তবেই উঠতে পারে, সে চায় বাবা তাকে আলগা করে ধরে রাখুক। বাবা পদ্মার টাটকা ইলিশের ডিমের পাতুড়ি, ঘরে পাতা দই, ছানামুখী মিষ্টি, ফজলী আম আর বিলাতি গাবের মধ্যে ডুবে থেকে ছুটি শেষ করে ফিরে গেলে, দুপুরে ভাতঘুম দিয়ে উঠলে বিকেলে পাড়া বেড়ানোর আকর্ষণ ফেলে নিধি’র মা’র একা একা লাগে। তখন সে বই হাতে উদাস হয়ে থাকে। বইও তেমন বেশী কিছু না। বৈঠকখানার সামনে হাতলঅলা চেয়ারে বসে থাকে নিধির মা, শাড়ির ওপর দিয়ে পেট হাতায়, একপাশে ‘ছোট্ট দেশ্লাইয়ের কাঠি’র মত পড়ে থাকে কোন আত্মীয়ের ভুলে ফেলে যাওয়া সুকান্ত।
পহেলা এপ্রিলের পরের দিন নিধির জন্মের সময়, মা দাঁতে দাঁত চেপে ব্যথা সহ্য করে আর কল্পনা করে- পাটগ্রামে বাবা’র দপ্তরে গ্রাম গ্রামান্তর থেকে চাষীরা পাটের গাট্টি এনে প্রাঙ্গনে ফেলছে। তার অধীন কর্মচারীরা সেগুলো মেপে, গুনে গেঁথে টাইট করে প্যাকেট করে গুদামে তুলছে।
-‘তখনতো আমরা খালি চিঠি লেখতাম, জরুরী না হইলে কেউ ফোন করতো না। তো তোমার বাবার কাজের জায়গায় ফোন ছিল না, মেয়ে হওয়ার খবর পাইল তিন চাইর দিন পর, তোমার নানার বাড়ি আসতে আসতে সপ্তা শেষ’ নিধি খাটের পাশে পা দুলিয়ে বসে দু’হাত দু’দিকে ছড়িয়ে হা করে গল্প শুনেছে। মা হঠাৎ হঠাৎ একটু চকিত আর অন্যমনস্ক, যেন গভীর অন্ধকার রাতে আকাশের তারা খসা দেখে ফেলে কিছু চাইতে ভুলে গেছে মন। -‘ততদিনে তোমার কলিক কান্না বন্ধ করতে আমরা গ্রাইপ ওয়াটার খাওয়াইতে শুরু করছি। কি যে ছিঁচ কান্দুনি হইছিলি তুই! আর আল্লাদিয়া ঢেপের খই, কোলে থাকলে কান্দাকাটি নাই, নামাইলেই শুরু’। নিধি গা মোচড়ায়- ‘না, আমি ছিলাম না’। যেন নিধি অকুস্থলে আজকের মত, আজকের নিধি’র সাক্ষী। -‘তোমার প্রথম ফটো তুলি একমাস পাঁচদিন বয়সে। তোমার বাবা ক্যামেরা নিয়া আসছিলো, আমি একটা কাজলের টিপ দিলাম পায়ের নীচে, তুমি দুই পা ছড়ায়া ঘুমাইতেছিলা’। -‘পায়ের নিচে ক্যান?’ -‘কপালে ফোটা দিলে আমার মনে হইতো, যাহ্ সুন্দর মুখটায় খুত হয়ে গেল’। এই হলো নিধির মা, সবসময় একটু আলাদা। শাড়ি কোমরের কাছে আলতো গুজে দিয়ে পিঠ ঢেকে দিলে একটা সম্ভ্রান্ত ভাব চলে আসতো। সাজতো এমন যে মনে হয় সাজেইনি, কিন্তু দেখতে অপূর্ব লাগতো। সবাই বলবে নিধির বোঝার বয়স হয়নি কিন্তু সে বুঝতো। কোন অনুষ্ঠানে মা’কে ঘিরে সবার মুগ্ধ চোখ ঠিকই নিধি দেখতে পেতো, সেই ছোটবেলাতেও। “ভোমরাদহে সবচায়া সুন্দরী হইল ইসমত মাষ্টারের ছেলের বৌ” – এইসব চাউর হওয়া খবর। -‘তারপর কতো ফটো যে তোলা হইছিলো আমাদের তুলতুলে পুতুলটার!’ মা’র গালে গাল লাগিয়ে রেখে গল্প শোনে নিধি। কথাগুলো ত্বকের ঝিল্লি বেয়ে তার গায়ের ভেতরে ঢুকে যায়। মা তারপর টুক টুক করে বলতে থাকে সেই সময়ের কোন অবিমৃষ্যকারীতার কাহিনী যখন তাদের বাড়িতে চুরি আর ডাকাতির মাঝামাঝি একটা কিছু হয়। -‘চোরটা মনে হয় পড়াশোনা জানা ছিল, না হইলে গয়নাগাঁটি খুঁজতে গিয়া ক্যামেরা পাইছিস, ভালো কথা, নিয়া যা। ওয়ার্ড্রোবের উপরে রাখা দুই দুইটা এ্যালবামও নিয়া যাবি!’ -‘চোরটা ছবি দিয়ে কি করবে মা?’ -‘কি জানি, ঐ সব ছবি কি আর কেউ কিনবে নাকি বোকা। ও হয়তো ফেলে দিসে, নাইলে ওর ঝুপড়ি ঘরে আমার পরীটার সুন্দর ফটোগুলি লাগায়া রাখছে’। নিধি তখন কোন ঘরের বাঁশের বেড়ায় নিজের শিশু বয়সের শত শত ফটো আঠা দিয়ে আটকানো দেখতে পায়। কোনটাতে সে দুই দাঁত নিয়ে হাসছে, কোনটাতে ছিট কাপড়ের ফ্রক পরে দৌড়ে যাচ্ছে ঘাসের ওপর দিয়ে। নিধির যখন প্লে-গ্রুপে যাওয়ার বয়স, তখন বাবা বদলী হয়ে যাবে হিলি বর্ডারের কাছে। দাদু’র কাছে মা হন্যে হয়ে পড়লো- এইবার সে ঢাকায় বাসা করে থাকবে। মেয়েকে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়াবে। কে না জানে, জুট পার্চেজারের বেতনে ঢাকায় বৌ-বাচ্চা রাখা যায় না, তবু তার শখ হয়েছিল, সঙ্গে জেদ। দাদু কি কারণে যেন কথা রেখেছিল। মাসে দুইবার বস্তা ভর্তি চাল,আনাজপাতি নিয়ে লোক পাঠাতো। ঐ সময় মা একবারও নাইওর যায়নি বাপের বাড়ি, অথচ দূরে ছিল না। নিধির স্কুল ছিল হাঁটা পথের দূর। এক রুমের বারান্দাওয়ালা, স্কুলের কাছাকাছি বাসাটাও খুব কপাল ভালো বলে পাওয়া গেছে। কাঁধে পানির ফ্লাস্ক ঝুলিয়ে নেভী ব্লু স্কার্ট শাদা শার্ট পরে নিধি স্কুলে যায়। প্লে-গ্রুপ থেকে নার্সারী ওয়ানে উঠতে তার দরকারের থেকে বেশী সময় লেগে গেল। সে এক সময় গেছে নিধির আর নিধির মা’র। বাবা মাসে দু’বার আসতো, নিধিকে জুতোর ফিতে বাঁধা শেখাতে। ফুপু আসতো তাদেরকে নিয়ে বাজার সদাই করতে। নিধির জন্য যেমন মা ছিল, মায়ের জন্য ছিল আম্বিয়া বুয়া, সব সামলাতে পারতো, নিধিকে স্কুলে আনা নেওয়া, বাজার, মায়ের মাইগ্রেনের ওষুধ। শুধু নিধির স্কুলের পড়ালেখা নিয়েই যা বিপত্তি শুরু হলো।
একদিন, হয় মাসকাবারে ছুটিতে আসা বাবা, নয়তো বাবার অনুপস্থিতিতে একা থাকতে থাকতে ত্যাক্ত হয়ে ওঠা মা, দু’জন দু’জনের ওপরে রেগে গেল। এর আগে নিধি কখনো ক্রোধে বিবর্ণ বাবা-মা’কে দেখেনি। রাগটা তাদের দু’জনকে কোথাও নিয়ে গেল না, উপরন্ত নিজে ভ্যাবাচ্যকা খাওয়া ঝড়ে আক্রান্ত পাখির মত ঘরের মধ্যে আটকে উড়তে থাকলো, ফৎ ফৎ এ দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে ও দেয়ালে গিয়ে লেগে আবার এ দেয়ালে ফিরে আসে। স্কুলের টিচার আজকে তাদেরকে ডেকে জানতে চেয়েছে যে নিধির শিশু অবস্থায় ভয়াবহ ধরণের টাইফয়েড হয়েছিল কিনা। সে বর্ণমালা ঠিকমত চিনতে পারে না, সংখ্যা গননায় ভুল করে। নিধির জন্য প্রতিটা বিষয়ের একজন টিউটর দরকার, তা নইলে দরকার ওর চিকিৎসা। বাচ্চার জ্বরাক্রান্ত কয়েক রাত্রির কথা মনে আছে, কিন্তু তা কি টাইফইয়েড! ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে থাকে নিধির মা। আর তার ক্রোধান্ধ বাবা খুটিয়ে খুঁটিয়ে জানতে চায়- স্ত্রী’র বাপের বাড়িতে জন্মের পর শিশুকন্যার যত্নের কি কি ত্রুটি ঘটেছিল!