মাসুদ খান
(পূর্বপ্রকাশিত-র পর)
হিটলার-অন-স্পেশাল-ডিউটি… অন-ইটারনালি-স্পেশাল-ডিউটি
ঘুঘুডাঙ্গা পরগনার চেয়ারম্যান লোকমান হোসেন। যেমন সে উঁচালম্বা, তেমনই তার ফিগার, তেমনই তার গায়ের রং। যেন সাক্ষাৎ কার্তিক। কিংবা মূর্তিমান অ্যাপোলো দেবতা। এমএ পাশ। ডবল এমএ। আগে ছিল আন্তঃদেশীয় ডাকাতদলের ইস্টার্ন কমান্ডের কমান্ডার। দুর্ধর্ষ এক ডাকাতসর্দার। ভয়ে কাঁপত আশেপাশের কয়েক পরগনা। ডাকাতদলে যোগ দেবার ব্যাপারেও আছে এক কাহিনি। রাজধানীতে গিয়েছিল সিনেমার নায়ক হওয়ার জন্য। সিনেমায় চান্স না পেয়ে নানা ঘটনাচক্রে শেষপর্যন্ত সে গিয়ে চান্স পায় আন্তঃদেশীয় ডাকাতদলের নায়কের ভূমিকায়। দেশের ভেতর তো বটেই, দলবলসহ ডাকাতি করতে করতে চলে যেত সীমানা ছাড়িয়ে, বহু-দূর-দূরান্তে। কোথায় সেই গুয়াহাটি, ধর্মনগর, আগরতলা, মায়ানমার। পরে অবশ্য কোনো এক ঘটনায় হোঁচট খেয়ে ডাকাতি ছেড়ে দিয়ে হজ-ওমরাহ সব সেরে-টেরে আত্মনিয়োগ করেছে জনসেবায়। দাঁড়িয়েছে নির্বাচনে, হামানদিস্তা মার্কায়। ভয়ে বসে পড়েছে অন্যসব ক্যান্ডিডেট। তবে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতে যাওয়ার ব্যাপারটা ভালো লাগেনি লোকমানের, অপমানকর ঠেকেছে। তার কথা হলো, চ্যালেঞ্জ নাই তো চার্ম নাই। তাই সেও উঠিয়ে নিয়েছে মনোনয়নপত্র।
যথারীতি পুনর্নিবাচন। এবার লোকমান ছাড়াও আরো জনা তিনেক প্রার্থী। কালাম বিএসসি, জোবদুল হাজি, মোজাহার মণ্ডল। চার প্রার্থীরই প্রচার-প্রচারণা বেশ জোরদার। কারণ কয়েকদিন আগে প্রতিপক্ষ প্রার্থীদেরকে শাসিয়ে এসেছে লোকমান, “খবরদার! এইবার কইলাম বইসা যাইয়েন না। এইবার ওয়াকওভার দিলে কিন্তুক খবর আছে। জানেনই তো, চ্যালেঞ্জ ছাড়া লোকমান কোনো খেলা খেলে না।” আর পাবলিককে ভয় দেখিয়েছে এই ব’লে যে, “হজ করছি দুইবার, ওমরাহ্ চাইরবার। শিক্ষিত, ডবল এমএ। আর আপনাগো জন্যে খাইটা বেড়াই রাতদিন। সবই তো জানেন, সবই দেখতেছেন। তয় হামাক যুদি ভোট না দ্যান, তাইলে কী ঘটবো হেই কতা আর নাই-বা কইলাম, আকলমন্দ-কে লিয়ে ইশারাই কাফি। অহন বিচার-বিবেচনা আপনাগো।”
ভোটের ফল যখন হলো দেখা গেল সব ভোটই পেয়েছে লোকমান। অন্য প্রার্থীরা সব জিরো ভোট। জিরো মানে জিরোই। লোকমান ভাবে, ‘কী তাজ্জব ব্যাপার! আরে! কালাম, জোবদুল, মোজাহার…হেরা কেউই হালার নিজের ভোটটাও নিজেরে দেয় নাই নিকি? ঘটনা কী! হামাক তাইলে এত্তো ভালবাসে পাবলিকে!’ ভেদকথা না বুঝেই আত্মবিশ্বাস আর আত্মতৃপ্তিতে ডগমগ করতে থাকে লোকমান। এবং এভাবেই এককালের দুর্ধর্ষ লোকমান ডাকাত রূপান্তরিত হয় লোকপ্রিয় লোকমান চেয়ারম্যানে। চেয়ারম্যান হবার পর অবশ্য এলাকায় বেশ কিছু কাজটাজ করেছে সে। গরিব-গুর্বাদের টাকাপয়সা দিয়ে সাহায্যও করে মাঝেমধ্যে। তবে, পরগণার তাবৎ মানুষকে সে ভাবে তার প্রজাস্য প্রজা। আর তার গুন্ডাবাহিনী গিয়ে কখন যে কাকে ছোবল মারে, কার মাথা ফাটায়, কার লাশ ফেলে দেয় সেই ভয়ে চুপ থাকে পাবলিক। লোকমানের নামে তারা গোপনে চালু করেছে এক জাঁদরেল খেতাব– ‘হ্যান্ডসাম হিটলার’।
দুই হারু-পাট্টি, কালাম বিএসসি আর মোজাহার মণ্ডল, একদিন আসে লোকমান চেয়ারম্যানের বাড়িতে। চেয়ারম্যানগিরির বছরপূর্তি উপলক্ষে। হাতে তাদের ফুলের তোড়া আর ঢাউস একটা বই। বিশ্ববিখ্যাত সব ভাস্কর্যের রঙিন-ছবিসম্বলিত বই। অভিনন্দন-জ্ঞাপন, চা-নাস্তা ও আলাপপর্বের এক পর্যায়ে কালাম বিএসসি বইটা খুলে গ্রিক দেবতা অ্যাপোলোর বেশ কিছু মূর্তির ছবি দেখায় লোকমান চেয়ারম্যানকে। বলে, “দ্যাখেন দ্যাখেন কী হ্যান্ডসাম! আর ফিগারখান দেখছেন নি? মাথা ঘুরায়ে পইড়া যাওয়ার মতন। আপনেক দেখতে ঠিক এই দেবতার মতন লাগে। খালি আমি না, হগলেই কয়। তাই কই কি, আপনের একখান স্ট্যাচু বানান। জনগণের উদ্দেশে আপনে জ্বালাময়ী বক্তৃতা দিতেছেন— এইর’ম একটা পোজ হবে স্ট্যাচুটার।” কালামদের কথাটা বেশ মনে ধরে চেয়ারম্যানের। মনে মনে ভাবে– তাই তো! হামি হইলাম এই পরগণার একচ্ছত্র অধিপতি, আর দেখতে হামি দেবতার মতন, বহুৎ লোক হামাক দেবতা মানেও। হামার একখান স্ট্যাচু থাকবো না এইডা কুনু কতা হইল?
তো, আজকে সেই স্ট্যাচুর মডেল হয়েছে লোকমান চেয়ারম্যান। স্ট্যাচুর জন্য শানবাঁধানো বেদি বানিয়ে রাখা হয়েছিল আগে থেকেই। পেশি-ফুটে-ওঠা জাঁহাবাজ ফিগারের চেয়ারম্যান উদলা গায়ে হাফপ্যান্ট আর গামবুট পড়ে বক্তৃতারত ভঙ্গিমায় পোজ দিয়ে চলেছে, অনেকক্ষণ ধরে। পেছনে তার সিংহচিহ্নিত কুরশিখানা। চেয়ারম্যানের বিচিত্র পোজ আর প্রোফাইলের ছবি এঁকে নিচ্ছে ভাস্কর। পরে সেগুলি বিশ্লেষণ করে ভাস্কর্যের ডিজাইন চূড়ান্ত করবে সে। কিন্তু ব্যাপারটা পছন্দ হচ্ছে না লোকমানের। রাগে টং হয়ে আছে সে। এক পর্যায়ে হেঁকে ওঠে, “কি ভাস্কর সাহেব, স্ট্যাচু বানান বাদ দিয়া কী বালের ছবি-উবি আঁকতেছেন, গুল্লি মারি আপনের আকাঁআঁকির। পিএ-রে কইলাম টাউন থেইকা ভাল দেইখা একজন ভাস্কর ভাড়া কইরা আন, যত ট্যাকা লাগে দিমু, হে যায়া নিয়া আইছে এক বাবরি-আলা মাইয়ালি আর্টিস! এইটা ভাস্কর, নাকি ভচকর? নাকি হাফপ্যান্ট? সোন্দর গাধা জানি কোনহানকার, মিনমিন কইরা কী-সব-কয়-না-কয়, ‘ডাইনে ঘোরেন, বাঁয়ে ঘোরেন, মাথা তোলেন, মাথা নামান, ব্যাঁকা হন..’ হেই মিয়া আপনে কি আর্টিস নি? আর্টিসের কাম আপনে করেন ক্যা? আপনের কাম আপনে করেন। আপনে বানাইবেন স্ট্যাচু, তাইলেই হইচে!” চেয়ারম্যানের কথায় আহত হয় ভাস্কর। রাগ চেপে রেখে বলে, “জি, কী বললেন স্যার, আমার কাজ আমি করব? ঠিক আছে, তাই করি। আপনে একটু জিরান, কোক খান, আমি আসতেছি কিছুক্ষণ পর।”
চলে যায় ভাস্কর। মিনিট দশেক পর ফিরে আসে গাট্টাগোট্টা কয়েকজনকে সঙ্গে নিয়ে। সবাই মিলে ধরাধরি করে নিয়ে এসেছে পানিতে গোলানো কুইক-সিমেন্টভর্তি বড় বড় দুটি প্লাস্টিক ট্রে। প্ল্যান করা ছিল আগে থেকেই, সুযোগ পেলেই হাজির করবে আসল জিনিশ। ভাস্কর বলে, “স্যার, আনছি।” “কী আনছেন?” জিজ্ঞেস করে চেয়ারম্যান। “স্ট্যাচু বানানোর তেলেসমাতি মালমশলা।” “তাই নাকি, শাবাশ! বহুৎ আচ্ছা! আনেন আনেন।” খুশি-খুশি ভাব চেয়ারম্যানের। বলে, “এইটুক্কা মশলা দিয়া কী হইবো?” “খালি দ্যাখেন-না স্যার, কী হয়। আরো তো আসতেছে। এগুলা দিয়ে হবে দুইটা সাব-প্ল্যাটফর্ম। প্ল্যাটফর্মের ওপর সাব-প্ল্যাটফর্ম লাগে না? এগুলা তাই।” এই বলে ট্রে দুটি সেট করে দেয় চেয়ারম্যানের পায়ের তলায়। গামবুট-পরা পা দুটি আস্তে আস্তে ঢুকে যেতে থাকে কুইক-সেটিং সিমেন্টের তেলেসমাতি মশলার ভেতর। দুই পা দুই ট্রে-তে, মানে দুই সাব-প্ল্যাটফর্মে। ‘গুড বাই’ ব’লে বাউ করতে করতে বিদায় হয় ভাস্কর আর তার লোকজন। চেয়ারম্যান হাত নাচিয়ে পেশি কুঁদিয়ে বক্তৃতা চালিয়ে যেতে থাকে। আর উপস্থিত গ্রামবাসী
হা-করে অবলোকন করতে থাকে গর্জনকুর্দনশীল, সদামুখর, পেশিবহুল এক জ্যান্ত ভাস্কর্যের সাবলীল সৌন্দর্য।
এই লেখাটি সর্বমোট 294 বার পঠিত হয়েছে । আজকে 1 জন লেখাটি পড়েছে ।