কোবাইয়াশি ইসার হাইকু: ২

অনুবাদ: নান্নু মাহবুব

*

লণ্ঠনে আলোকিত
অপরূপ এক রাত…
ডাকে ব্যাঙ

 

*

যখন প্রজাপতি
ফিকে নীল,
ফিকে নীল চেরিফুলও

[চেরিফুল হলো ফিকে গোলাপি। ইসা বলছেন, হালকা নীল
প্রজাপতির উপস্থিতিতে তার সেই রঙ পাল্টে গেছে।
এই অসাধারণ কবিতাটি পলকা পতঙ্গ আর ফুলের মধ্যেকার
সম্বন্ধকে ইঙ্গিত করে।]

*

বুনোফুল ফোটে
নিখাদ শুভ্র…
গহন বৃক্ষছায়া

[এই হাইকুটিতে ফুল এবং ছায়ার শাদা-কালো একটি মনোরম
দৃশ্যজ বৈপরীত্য রয়েছে।]

*

বৃষ্টি গেছে থেমে─
খুঁটির ওপরে এক
জমকালো মাশরুম

*

বসন্ত বৃষ্টি─
কেতলির নিচে এক
আগুন মনোহর

*

শীতের প্রথম বরিষণ─
জগৎ ভরে গেছে
হাইকুতে

*

সবুজ দ্রাক্ষালতা
উঁকি দেয় জানালায়…
গ্রীষ্মের দাবদাহ

*

খোলা জানালায়
উজ্জ্বল এক চাঁদ
ডাকে ব্যাঙ

*

ডাকে বুনো রাজহাঁস
রটে আমায় নিয়ে
রটনা

*

মর্নিং গ্লোরি
ফোটে ঘন হয়ে…
অন্য কারোর বাড়িতে

[মর্নিং গ্লোরি: নরম নীলাভবেগুনি ফুল। এক রকম বাগানলতা।
ফুল অন্যান্য রঙেরও হয়। বহু প্রজাতির দেখা যায়। এই লতার
অপরূপ ফুল ফোটে সকালে আর দুপুরের আগেই বুজে আসে।
ছায়াকুঞ্জ তৈরিতে ঘনসবুজ পাতার মর্নিং গ্লোরি অনবদ্য।
জাপানে এই ফুল বহুল আদৃত।]

*

নির্মল নীলাকাশে লিখি
একটি অঙ্গুলি দিয়ে…
‘‘শরৎ গোধূলি’’

*

চোরকাঁটাঝোপ থেকে
জন্ম নিল কি
এমন এক প্রজাপতি?

*

পাইনের ছায়ায়
ঘুমায়, খায়…
ষাটটি প্রদেশ!

[ইসার মৃত্যুর দু’বছর পর তাঁর ছাত্ররা তাঁর রচনাসমূহের একটি
সংকলন প্রকাশ করেন। সেটির ভূমিকায় তাঁরা এই হাইকুটিকে ইসার
ঘরানার নির্দেশক (signature work) হিসেবে বাছাই করেন।
তাঁর মৃত্যুর তৃতীয় বার্ষিকীতে তাঁরা কাশিওয়াবারাতে তাঁর আদি গ্রামে
এই হাইকুটি খোদাই করা একটি প্রস্তর স্মৃতিস্তম্ভ স্থাপন করেন।
ষাটটি প্রদেশ বলে ইসা এখানে সমগ্র জাপানকে উল্লেখ করেছেন।]

*

এই যে! ছোট্ট কুঁড়েটি আমার
দেখি নতুন করে ছাওয়া…
নীল মর্নিং গ্লোরি

*

নড়বড়ে কুঁড়েটি আমার─
অবিকল আগের মতোই…
বসন্ত হলো শুরু

*

শুধালে বয়স কত
বালক নতুন কিমোনো-পরা
মেলে ধরে পাঁচ আঙুলের সবক’টি

[কিমোনো: ঢিলেঢালা আলখাল্লা জাতীয় জাপানি পোশাক।]

*

শরতের হাওয়া─
কাঁপে
পর্বতছায়া

*

সূর্যাস্ত─
একটি ব্যাঙের চোখেও
চকচক করে অশ্রু

*

আমার বাড়িতে
ইঁদুর আর জোনাকিরা
আছে মিলেমিশে

*

চিন্তা নেই, মাকড়সাগণ,
ঘরবাড়ি রাখি আমি
অগোছালো

[ইসা মাকড়সাদের আস্বস্ত করছেন যে তাঁর ঘরটি মাকড়সাদের
জন্যে নিরাপদই আছে!]

*

ভেসে গেছে কুয়ো─
ঘাসের ওপরে বসে
ডাকে এক ব্যাঙ

*

একটি মানুষ, একটি মাছি
একটি বিশাল
বৈঠকখানা

*

হঠাৎ প্রবল বৃষ্টি─
আর নগ্ন আমি ছুটি
এক নগ্ন ঘোড়ার সওয়ার!

[এটি ইসার সবচে’ ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য ইমেজগুলোর মধ্যে একটি।]

*

নীল আকাশের মতো
এই গ্রীষ্মকিমোনো
প’রে আছি আমি

*

আমার প্রয়াত মা─
যখনই সমুদ্র দেখি
যখনই…

*

বছরের প্রথম স্বপ্নে
আমার আদি গ্রাম…
অশ্রুজল

*

প্রিয় পুরাতন গ্রাম আমার
গৃহের সমস্ত স্মৃতি
বিঁধছে যেন কাঁটা

[কোবাইয়াসি ইসা সিনানো প্রদেশের কাশিওয়াবারার একটি কৃষক
পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন এবং ছোটবেলা থেকেই লেখালেখি শুরু
করেন। দুর্ভাগ্যতাড়িত তাঁর শৈশবেই তাঁর মায়ের মৃত্যু হয়। তাঁর
বাবা আবার বিয়ে করেন। সৎমা আর সৎভাইয়ের হাতে তার জীবন
দুর্বিষহ হয়ে ওঠে।]

*

রক্তিম ভোর
তোমাকেও কি করে পুলকিত,
শামুক?

*

সরাইখানায়
ভুলে গেছি
শরৎ গোধূলি

[কল্পনা করা যাক সরাইখানায় ইসা এবং অন্য অতিথিরা বিপুল
সাকে (ভাত থেকে প্রস্তুত একজাতীয় মদ্য) পান করেছেন, বিস্মৃত
হয়েছেন সবকিছু।]

*

নাইটিঙ্গেল─
বৃষ্টিস্নাত তার
ভোরের কণ্ঠ

*

শুধু দুঃস্বপ্নই
নিয়তি আমার…
ডাকে একটি কাক

[শিশুপুত্র ইশিতারোর মৃত্যুর পর ইসা এই বিষণ্ণ হাইকুটি লেখেন।]

*

বসন্ত বৃষ্টি─
পাশাপাশি বেড়ে ওঠে
ফিসফাসরত পাইনেরা

*

ভিজে হলো চুপচুপে
বছরের প্রথম বর্ষণে…
আমারই ছোট্ট কুঁড়ে

*

এই দুনিয়ায় মোরা
নরকের ছাদে ঘুরিফিরি
অপলকে চাই ফুলে

*

নিস্তব্ধতা─
পাহাড়ের আতশবাজি
উড়ে গিয়ে পড়ে জলে

*

তাঁর মৃত্যুকালীন কবিতা:

জন্মে এক স্নান
মৃত্যুতে এক স্নান
কি নির্বুদ্ধিতা!

*

পুরোনো পুতুল
ভাংরি দোকানের জানালায়
পোহায় রৌদ্র

*

বৃক্ষের জানালা দিয়ে
দেখি নদী…
ঝরে বসন্ত বৃষ্টি

*

জোনাকির সাথে
জ্বলজ্বলে কুকুরেরা
গভীর ঘুমন্ত

*

কাছে আসি যত
আমার গ্রামের, ব্যথা বাড়ে…
বন্যগোলাপ

[এই হাইকুটির একটি নির্বন্ধে ইসা জানাচ্ছেন ১৮১০ সালের
পঞ্চম মাসের ১৯ তারিখ সকালে ইসা তাঁর গ্রামে ঢুকলেন। প্রথমে
বাবার সমাধিতে গিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করে তারপর ইসা গ্রামপ্রধানের
সঙ্গে দেখা করতে গেলেন। যদিও তাঁদের আলাপের বিষয়বস্তু তিনি
জানাননি তবুও বোঝা যায়, সৎমা আর সৎভাই কর্তৃক বছরের পর
বছর বাড়ি থেকে বিতাড়িত হয়ে থাকার বিষয়টাই ছিল তাঁদের
আলোচনার বিষয়বস্তু।
তিনি সংক্ষেপে যা লিখেছেন, “গ্রামপ্রধানের সঙ্গে দেখা করে
তারপর আমি আমার বাড়িতে গেলাম। ঠিক যা ভেবেছিলাম তাই,
তারা আমাকে এক কাপ চা-ও দিল না, কাজেই আমি তাড়াতাড়ি
সেখান থেকে চলে এলাম।”
ওই একই বছরে লেখা আরেকটি লেখায় তিনি “বন্যগোলাপ”
নামের এই হাইকুটি পুনর্লিখন করে সেখানে স্বাক্ষর করেন:
“ইসা দ্যা স্টেপচাইল্ড”।]
………….

Facebook Comments

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top